“ডান হাতে তাজা গ্রেনেড আমার
বাম হাতে রাইফেল
বিদ্রোহী আমি মুক্তি পিয়াসী
প্রাণ সদ্য উদ্বেল।
আমি তোমাদের চেনা
আমি যে মুক্তিসেনা”
ভাওয়ালরত্ন নুরুল ইসলামের কবিতাটি বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের সর্বপ্রথম (সমস্ত দেশের মধ্যে) স্মারক ভাস্কর্য জাগ্রত চৌরঙ্গীর স্মৃতির উদ্দেশ্যে রচিত।
১৯৭১ সালের ১৯ মার্চ। সংঘটিত হয় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে গাজীপুরবাসীর প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধে। চান্দনা চৌরাস্তায় পাকিস্তানি সৈন্যদের গুলিতে শহীদ হুরমত আলীসহ ( ১৪) অন্য শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সমুন্নত রাখতে নির্মিত হয় এ ভাস্কর্য।
১৯৭১ সালের মার্চ মাস। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের পর পরই পাকিস্তান সরকার তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে তাদের সামরিক শক্তি বাড়াতে তৎপর হয়। পাশাপাশি শুরু হয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি সৈন্যদের নিরস্ত্র করা। এরই অংশ হিসেবে ১৯ মার্চ দুপুরে ঢাকা থেকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একদল সৈন্য জয়দেবপুরে অবস্থিত সেনাবাহিনীর ছাউনিতে পৌঁছে পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলস বাহিনীর একটি দলকে নিরস্ত্র করার চেষ্টা করে। ফলে পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলস বাহিনীর সঙ্গে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ব্যাপক সংঘর্ষ হয়।
এ সেনাবিদ্রোহের খবর আশপাশে ছড়িয়ে পড়ে। মুহূর্তেই স্থানীয় জনগণ জয়দেবপুর শহরে জমায়েত হয় ও তাৎক্ষণিক প্রতিরোধ গড়ে তোলে। বড় বড় গাছের গুঁড়ি ফেলে জনগণ জয়দেবপুর শহরে ঢোকার বা বের হওয়ার একমাত্র রাস্তাটি বন্ধ করে দেয়। এতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে স্থানীয় জনগণের সংঘর্ষ বেধে যায়। একদিকে ভারি অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানি সেনাবাহিনী, অন্যদিকে মাত্র তিনটি বন্দুক নিয়ে স্থানীয় জয়দেবপুরবাসী।
বাধাপ্রাপ্ত হয়ে পাকিস্তানি সৈন্যরা নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে। এতে হুরমত আলীসহ কমপক্ষে ২০ জন নিহত ও ১৬ জন আহত হন। কিন্তু পাকিস্তান সরকার তা অস্বীকার করে। সরকারি হিসাব মতে, তিনজন নিহত ও পাঁচজনকে আহত দেখানো হয়।
বিকেল পৌনে ৪টা থেকে ৫টা পর্যন্ত প্রতিরোধ ও গুলিবর্ষণ চলে। এরপর সন্ধ্যা ৬টা থেকে জয়দেবপুরে অনির্দিষ্টকালের জন্য সান্ধ্য আইন জারি করা হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সারা দেশে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়।
অসহযোগ আন্দোলন শুরু হওয়ার পর দেশের বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তানি সৈন্যদের হাতে বাঙালি হতাহতের ঘটনা ঘটলেও এটিই ছিল মুক্তিযুদ্ধের সূচনাপর্বে প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধ। আর এই প্রতিরোধ যুদ্ধে শহীদ হুরমত আলী ও অন্য শহীদদের অবদান এবং আত্মত্যাগকে জাতির চেতনায় সমুন্নত রাখতে জয়দেবপুর চৌরাস্তার সড়কদ্বীপে স্থাপন করা হয় দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্যকর্ম জাগ্রত চৌরঙ্গী।
মুক্তিযুদ্ধের সর্বপ্রথম এ স্মারক ভাস্কর্যটির নকশা প্রণয়ন করেন বরেণ্য শিল্পী আব্দুর রাজ্জাক। ১৯৭৩ সালে জয়দেবপুর রাজবাড়িতে অবস্থানরত ১৬ ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক সেনাবাহিনীর সাবেক মেজর জেনারেল আমিন আহমদ চৌধুরীর তত্ত্বাবধানে নির্মাণ করা হয় ভাস্কর্যটি।
ভাস্কর্যটির উচ্চতা মাটি থেকে ১০০ ফুট। দু’পাশে ১৬ ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের ১১ নম্বর সেক্টরে একশ, ৭ জন এবং ৩ নম্বর সেক্টরে একশ’ জন শহীদ সৈন্যের নাম খোদাই করা রয়েছে।
বাংলাদেশ সময়: ১৭৪২ ঘণ্টা, মার্চ ১৮, ২০১৩
সম্পাদনা: আসিফ আজিজ, বিভাগীয় সম্পাদক, ইচ্ছেঘুড়ি-ichchheghuri@banglanews24.com