আজ তোমাদের হিমালয়ের দুরারোহ চূড়ায় বসবাসকারী কল্পিত এক প্রাণীর কথা বলবো। ভয়ঙ্কর এ প্রাণীর নাম ইয়েতি।
তবে আরেক অভিমত হচ্ছে, ইয়েতিরা উচ্চতায় প্রায় ১২ ফুট, মুখমণ্ডল মানুষ ও গরিলার মাঝামাঝি। আর বরফের উপর দিয়ে এরা তীব্র গতিতে চলাফেরা করতে পারে।
১৮৩২ সালের দিকে অভিযাত্রী হাডসনের বর্ণনার পর ইয়েতির ব্যাপারে সারা বিশ্ব আগ্রহী হয়ে ওঠে। এরপর ১৮৯৯ সালে লরেন্স ওয়েডেল নামের এক অভিযাত্রী দাবি করেন তিনি ইয়েতির পায়ের ছাপ দেখতে পেয়েছেন।
অভিযানকালে তার সঙ্গে থাকা গাইডের কাছেও তিনি ইয়েতির পায়ের ছাপের কথা শোনেন। কিন্তু সেটি তুষারমানবের কিনা সে ব্যাপারে তিনি সন্দিহান ছিলেন।
ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে ইয়েতি প্রসঙ্গ আবারো বিশ্বজুড়ে আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসে। এরই মধ্যে ১৯১৩ সালে একদল চৈনিক শিকারি হিমালয়ের তুষার ঢাকা অঞ্চলে শিকারে বের হন এবং পরে দাবি করে তারা হিমালয়ের বরফে ঢাকা অঞ্চলে সারা শরীর কয়েক ইঞ্চি লম্বা রূপালি হলুদ চুল বা লোমে ঢাকা বানরের মতো কুৎসিত থ্যাবড়া মুখাকৃতির বিকট একটি প্রাণী দেখেছেন।
বানরের সাথে এর সাদৃশ্য থাকলেও আকৃতিতে বানরের চেয়ে অনেক বড়। দু`পেয়ে প্রাণীটি অনেকটা মানুষের মতোই চলাফেরা করে এবং দেখে সহজেই ধারণা করা যায় প্রাণীটি অসাধারণ শক্তিশালী।
১৯২১ সালে কর্নেল সি কেক হাওয়ার্ড বেরির নেতৃত্বে একদল অভিযাত্রী এভারেস্ট অভিযানে যান এবং সে উদ্দেশে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ২০ হাজার ফুট ওপরে পৌঁছান। সেখানে তারা হিমবাহের কাছে কয়েকটি বিশাল আকৃতির মানুষের পায়ের ছাপের মতো পদচিহ্ন লক্ষ্য করেন। তুষারশৃঙ্গ এভারেস্ট থেকে মাত্র ৭৮৬ ফুট নিচে অবস্থিত একটি জায়গার নাম রংবুক যেটি অশান্ত ও রহস্যময় স্থান নামে পরিচিত।
জায়গাটির আয়তন ২৬৫ বর্গকিলোমিটার এবং সব সময় সেখানে প্রচণ্ড ঝড়ো হাওয়া বয়। ১৯২২ সালের দিকে বেশ ক`জন পর্বতারোহী সেখানে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিলেন। ওই অভিযাত্রী দলটিতে একজন চিকিৎসক ছিলেন। তার নাম আলেকজান্ডার কিউলাস্ক। সেখানে আকস্মিক কিউলাস্ক অসুস্থ হয়ে পড়েন। তারপর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তিনি মারা গেলেন। মারা যাওয়ার সময় তিনি বার বার প্রলাপ বকছিলেন। প্রলাপের সময় তিনি এক লোমশ দানবের কথা বলছিলেন।
১৯২৩ সালে এভারেস্ট অভিযাত্রী ব্রিটিশ নাগরিক মেজর আলান ক্যামেরুন জানিয়েছিলেন অভিযান চলাকালে তিনি হিমালয়ের হিমরেখার ঊর্ধ্বে খাঁড়া শৈল প্রাচীরের গা ঘেঁষে সংকীর্ণ একটা পথে একদল মানবাকৃতির প্রাণীকে হেঁটে যেতে দেখেছেন।
ইয়েতিদের সন্ধানে অনেক দুঃসাহসিক অভিযানও পরিচালিত হয়েছে। তবে এদের মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত অভিযানটি পরিচালনা করেন স্যার এডমন্ড হিলারি। ১৯৬০-৬১ সালের দিকে হিলারিকে ওই এলাকায় পাঠায় শিকাগোর ওয়ার্ল্ড বুক অফ এনসাইক্লপিডিয়ার প্রণেতারা। এই হিলারই আবার শেরপা তেনজিংকে নিয়ে মাউন্ট এভারেস্ট জয় করেন পরে। ইয়েতির সন্ধানে বেরিয়েই যে এভারেস্ট জয়ের ঘটনা ঘটে এ কথা অনেকেরই অজানা।
সে যাই হোক, স্যার হিলারি তার সঙ্গীদের নিয়ে হিমালয়ের পথে রওনা হন নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডু থেকে। দুর্গম পথে চলতে চলতে তারা তিব্বতের এক গ্রামে এসে পৌঁছান। গায়ের নাম খুমজুং। গ্রামে যে মঠ রয়েছে সেখানে সযত্নে ও সতর্কতার সাথে রক্ষিত আছে একখানা চামড়া। গায়ের লোকদের মতে এটি ইয়েতির চামড়া।
চামড়াটি গর্বের সঙ্গে দেখানো হলো তাদের। চামড়াটি দেখে মনে হলো বেশ পুরানো। দেখে মানুষের চামড়া বলেই মনে হয়। মাথার দিককার চুলগুলো লম্বা। চামড়াটি কোথা থেকে এলো সে প্রশ্ন করতেই শোনা গেল এক চমকপ্রদ কাহিনী। কাহিনীটা অনেকটা এরকম।
প্রায় দুশো বছর আগে ইয়েতিরা এই গ্রামটি দখল করে নেয় এবং গ্রামবাসীদের ধরে ধরে খেয়ে ফেলতে শুরু করে। অবস্থা ক্রমে এমন দাঁড়ালো যে গ্রামে মানুষের চেয়ে ইয়েতিদের সংখ্যা বেড়ে গেল। এসময় একজন বিজ্ঞ লামা ইয়েতিগুলোকে সমূলে ধ্বংস করার জন্য অভিনব পরিকল্পনা করেন। তিনি দেখলেন ইয়েতিরা অনুকরণপ্রিয়।
মানুষ যা করে ইয়েতিরাও তাই অনুকরণ করে। বিজ্ঞ লামা তাদের এই অনুকরণপ্রিয়তাকেই কাজে লাগালেন তার পরিকল্পনায়। তিনি গ্রামে এক মহোৎসবের আয়োজন করলেন। সেখানে সমবেত গ্রামবাসী ও ইয়েতিদের মধ্যে বিতরণ করা হলো চাঙ জাতীয় বন্যমদ। লামার শিখিয়ে দেয়া বুদ্ধিমতো গায়ের লোক গোগ্রাসে মদ পানের ভান করল, কিন্তু আসলে পান করল না।
তারপর মাতাল হয়েছে এরকম ভাব করে কোমরের খাপ থেকে তলোয়ার বের করে পরস্পরকে আক্রমণ করে বসলো। তারপর সে কি লড়াই! যুদ্ধে প্রায় সবাই জখম হয়ে লুটিয়ে পড়তে লাগল। মনে হল তাদের কেউই আর বাঁচবে না। মদ পানে মত্ত ছিল ইয়েতিরাও। মানুষের দেখাদেখি প্রচুর চাঙ পান করে ইয়েতিদের নেশাও হয়েছিল প্রচণ্ড।
এবার মানুষের মতোই তারাও নিজেদের মধ্যে খুনোখুনি শুরু করে দিল। ওদিকে হয়েছে কি মানুষের ব্যবহৃত তলোয়ারগুলো ছিল কাঠের। যার ফলে তারা কেউই নিহত বা জখম হয়নি। কিন্তু মরার ভান করে কিছুক্ষণ পড়ে থেকে ঘটনাস্থলে একরাশ লোহার ধারালো তলোয়ার ফেলে রেখে রাতের আধারে অদৃশ্য হয়ে গেল।
ইয়েতিরা কিছুক্ষণ পরে দেখে তাদের পাশে অনেক অস্ত্র পড়ে আছে। তারা ত্রস্ত হাতে সেগুলি কুড়িয়ে নিয়ে পরস্পরের বুকে তীক্ষ্ণধার ফলা ঢুকিয়ে দিতে শুরু করল। এর ফল হলো মারাত্মক। রাত পোহালেই দেখা গেল, ইয়েতিদের প্রায় সবাই মরে পড়ে আছে। শুধু একটি ইয়েতি মাতাল হয়ে পড়েছিল এক পাশে। গ্রামবাসী তাকে হত্যা করে চামড়াটা গা থেকে ছাড়িয়ে নেয়। সেই চামড়াটাই তারা স্যার হিলারিকে দেখাল সেদিন। বস্তুটি বহুকাল যাবৎ সেই মঠে সংরক্ষিত আছে।
অভিযাত্রীরা পরদিন মঠের লামার কাছে একটা প্রস্তাব রাখেন। তারা বলেন, বিজ্ঞানসম্মত পরীক্ষার জন্য তারা চামড়াটা ইউরোপ ও আমেরিকায় নিয়ে যেতে চান। বহু আলোচনার পর গায়ের লোকেরা চামড়াটা ছয় সপ্তাহের জন্য ধার দিতে রাজি হয়। এর বিনিময়ে গায়ের লোকজনকে আট হাজার রুপি প্রদানে সম্মত হয়।
এরপর অভিযাত্রীরা তিব্বত থেকে কাঠমান্ডু হয়ে ব্যাংকক ও হনলুলু হয়ে শিকাগো পৌঁছালেন বিমানযোগে। সেখানে একদফা পরীক্ষা চলল কথিত ইয়েতির চামড়ার।
জাতীয় ইতিহাস জাদুঘরের বিজ্ঞানীরা এ পরীক্ষা চালালেন। এরপর সেখান থেকে অভিযাত্রীরা প্যারিস হয়ে গেলেন লন্ডনে।
সেখানকার রয়্যাল জুলজিক্যাল সোসাইটির বিশেষজ্ঞরা বিজ্ঞানভিত্তিক পরীক্ষা নিরীক্ষা চালালেন।
কিন্তু দুঃখের বিষয় সব পরীক্ষা নিরীক্ষাতেই জিনিসটা ভুয়া বলে প্রমাণিত হলো। দলটি ক্ষুণ্ণমনে কাঠমান্ডু হয়ে তিব্বতে ফিরে এলেন এবং যাদের জিনিস তাদের ফেরত দিলেন।
লামারা কিন্তু পাত্তাই দিলেন না সাহেবদের কথায়। তারা বললেন, তোমাদের পরীক্ষায় আমাদের কি আসে যায়। বিচিত্র ও রহস্যময় এ পৃথিবীর কতটুকুই বা জান তোমরা?
বাংলাদেশ সময়: ১৬০৬ ঘণ্টা, অক্টোবর ০৩, ২০১৩
এএ/এমজেডআর-ichchheghuri@banglanews24.com