তার নাম ফারহানা মিস। মানে নামটা কিন্তু ফারহানা মিস না, নাম হচ্ছে ফারহানা শারমিন নাফীস।
ক্লাস ওয়ান থেকে ফাইভ যদি হয় ছোট ক্লাস, তবে বলা চলে ফারহানা মিস মোটামুটি বড় মেয়েদের ক্লাস নেন। তিনি ক্লাস সিক্স থেকে টেনের ক্লাস নেন। মিস মূলত হোম সাইন্স, অর্থাৎ গার্হস্থ্য বিজ্ঞানের শিক্ষক। এছাড়া ধর্মও পড়ান।
ফারহানা মিস আমাদের সবার অতিপ্রিয় শ্রদ্ধেয় একজন শিক্ষক। পুরো স্কুলের কোনো মেয়ে বলতে পারবে না ফারহানা মিসকে তার পছন্দ নয়।
ফারহানা মিস হচ্ছেন তেমনই একজন টিচার। । তাকে অপছন্দ হওয়ার কোনো কারণ নেই। মিস ঠিক আমাদের মতো। কথা বলবেন আমাদের মতো, ভাববেন আমাদের মতো করে, বুঝবেনও আমাদের মতো করে। তাই মিসের সাথে একটা বন্ধুত্ব ভাবও আছে আমাদের।
এই ফারহানা মিসের যদি বর্ণনা দিতে হয়, তবে তা দাঁড়াবে এমনঃ
মিস লম্বা, মাঝারি স্বাস্থ্য, ফর্সা, অসম্ভব সুন্দর, চোখে চশমা পরেন। খুব সাধারণ ভাবে চলাফেরা করেন। শাড়ির সাথে ফুলস্লিভ ব্লাউজ এবং মাথায় ঘোমটা। দেখলেই ভালো লেগে যাওয়ার মতো।
আমাদের ফারহানা মিস যে কতটা অসাধারণ এবং তাকে শিক্ষক হিসেবে না পেলে যে সত্যিই আফসোস করা উচিত সেটা প্রমাণ করার জন্যই ফারহানা মিসের সাথে আমাদের দুটি ঘটনার কথা বলছি।
অল্প কিছুদিন আগের কথা। ফারহানা মিস ক্লাস নিচ্ছেন। ধর্ম ক্লাস। যে ক্লাসই হোক, মিস ক্লাস নিলে আমরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো চেয়ে থাকি শুধু। হাঁ করে মিসের সব কথা গিলতে থাকি। আমাদের সব টিচারদের ক্লাসে হয় সবাই ঘুমিয়ে পড়ে, নয়তো গল্প শুরু করে নিজেদের মধ্যে। সেগুলো না হলে নিচু স্বরে মিসদের সমালোচনা করে হাসাহাসি করে। ব্যতিক্রম শুধু ফারহানা মিসের ক্লাস। এ ক্লাসে আমরা শুধুই মিসের কথা শুনি। মনে হয় যেন একটা বিটোফোন সুর তুলে চলেছে, কখনো মনে হয় বৃষ্টিতে বাজছে নূপুরের ছন্দ, আবার মিসের কথাকে মনে হয় শান্ত নদীর অশান্ত ঢেউয়ের আনন্দ আর উচ্ছ্বাস নিয়ে খুশিতে খুশিতে পাড়ে আছড়ে পড়ার মধুর শব্দ। অনেক সময় মিসকে মনে হয় পরী, আর কথাগুলোকে লাগে রূপকথা। যেন একটা পরী রূপকথা শোনাতে শোনাতে নিয়ে চলেছে পরীর দেশে।
তো, সেই ফারহানা মিস, মানে পরী মিসের ক্লাসে এমনটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সেদিন একটা অস্বাভাবিক ব্যাপার দেখা গেল। আমাদের অগ্নিলা তার বান্ধবীর সাথে গল্প করছিল মিসের ক্লাসে! অস্বাভাবিকই বটে। মিসের ক্লাসে কেউ কখনো কথা বলে না। বললেও মিস কখনো শাস্তি দেন না। অগ্নিলাকেও দিলেন না। শুধু বললেন, বাইরে কী দেখছ মা? কী আছে বাইরে? মিসকেও দেখাও না।
অগ্নিলা তড়িঘড়ি করে কিছু ভাবার চেষ্টা করল। তারপর বলল, মিস, ফড়িং!
-কোথায় ফড়িং? জানতে চাইলেন মিস।
-ওই তো মিস, আকাশে উড়ে বেড়াচ্ছে। কত্ত ফড়িং!
মিস জানালার ধারে গেলেন। সত্যি! আকাশে অনেক ফড়িং ছিল। একসাথে উড়ছিল। মনে হচ্ছিল কোনো পার্টিতে যাচ্ছে দলবেধে। কিংবা সভা-সমাবেশ করছে। মিস ভীষণ খুশি হলেন। ছোট বাচ্চাদের মতো হাততালি দিয়ে উঠলেন। বললেন, তোমরা কী কেউ এটা দেখেছ মা? আমরা তো সারাদিনই ব্যস্ত। ফড়িং দেখার সময় কোহায় আমাদের?
আমরা চিৎকার করে উঠলাম। ‘দেখেছি!! দেখেছি!’ আমি জোরে চেঁচিতে বললাম, ‘এপাশটায় তো আরো ফড়িং, মিস। দেখে যান। ’
মিস দেখলেন। আবারো বাচ্চাদের মতোই খুশি হয়ে উঠলেন। তারপর আস্তে আস্তে বললেন, আমার কী করতে ইচ্ছে জানো? ইচ্ছে হচ্ছে তোমাদের নিয়ে মাঠে গিয়ে চুপ করে বসে ফড়িং দেখি।
আমরা সবাই চিৎকার করে মিসের সাথে একমত হলাম।
-নাহ! মাঠে যাওয়া যাবে না। তারপর তোমরা অনেক অনেক চিৎকার করবে, তারপর বড় আপুদের পরীক্ষার ডিস্টার্ব হবে, আর সবাই বলবে এই তো! সব ফারহানা মিসের বুদ্ধি! চোখ পাকিয়ে বললেন মিস।
আমরা সবাই প্রমিজ করলাম, একদম কথা বলব না। একদম চিৎকার করব না। শুধুই ফড়িং দেখব।
পরের ক্লাসটা ছিল তাসলিমা মিসের। মিসের সিলেবাস শেষ। ফারহানা মিস আমাদের আবদারের কথা তাসলিমা মিসকে জানালেন। মিসও খুশি হয়ে সায় দিলেন। ফারহানা মিসের নেতৃত্বে আমরা ক্লাস সেভেন সৈন্যদল মার্চ করতে করতে নিচে নেমে এলাম।
আকাশটা সত্যিই কী সুন্দর দেখাচ্ছে! এত্ত এত্ত ফড়িং! একসাথে উড়ে বেড়াচ্ছে। অনেক মজা ওদের। আমি ভাবছিলাম, আচ্ছা, ওরা কী পার্টিতে যাচ্ছে, নাকী আমাদের মতো ফড়িংদের ক্লাসের টিচার কোনো কিছু দেখাতে ওদেরকে উড়তে নিয়ে এসেছে? কিছুক্ষণের মধ্যেই শুধু আমার কথাকে সত্যি করতেই অন্যরকম একটা ফড়িং দেখা গেল। সেটা অন্য ফড়িংদের চেয়ে আলাদা। ফারহানা মিসকে বললাম, মিস, এটা নির্ঘাত ফড়িংদের ফারহানা মিস। মানে ফারহানা মিস ফড়িং। মিস হেসে উঠলেন সশব্দে।
আমরা অনেকক্ষণ বসে রইলাম। বসে বসে ফড়িং দেখলাম। তাদের ওড়াওড়ি, ছোটাছুটি, লুকোচুরি খেলা। ফারহানা মিসও আমাদের সাথেই বসে রইলেন। চুপচাপ আনমনে চেয়ে রইলেন ফড়িংদের দিকে। কে জানে! হয়তো ভাবলেন, আজকের বাচ্চারা কিছু ফড়িং দেখেই কত খুশি হয়। অথচ এই সামান্য কিছু ফড়িংও আমরা তাদের দেখাতে পারি না! কী দিচ্ছি আমরা আমাদের বাচ্চাদের?
তার কিছুদিন পরের কথা। সেদিনও ছিল মিসের ক্লাস। আকাশটা মেঘলা ছিল। একপাশের জানালা থেকে দেখা যাচ্ছিল ঘন কালো মেঘের আনাগোনায় কালচে আকাশ, অন্যপাশে কালো মেঘ এখনো জমাট বাঁধেনি। সাদা মেঘে শুভ্র সাজে সেজে আছে আকাশটা। বৃষ্টি আসবে জোরেশোরে। দেখেই বোঝা যাচ্ছিল সেকথা। মিস আমাদের পড়াচ্ছিলেন আর বারবার বাইরে তাকাচ্ছিলেন। একটু পর বইটা বন্ধ করে মিস বললেন, আকাশটা দেখেছ তোমরা মা?
-জ্বি মিস! একযোগে উত্তর দিলাম আমরা।
-পড়তে ইচ্ছে হচ্ছে?
-নো মিস!
-তবে কী করবে?
এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার সময় আমাদের মধ্যে মতানৈক্য দেখা দিল। কেউ বলল বৃষ্টিতে ভিজব, কেউ বলল ঘুমাব।
মিস বললেন, আমার ইচ্ছে হচ্ছে তোমাদেরকে নিয়ে মাঠে বসে আড্ডা দিই আর মেঘ দেখি, বৃষ্টি দেখি। বৃষ্টি শুরু হলে ভিজে জবুথবু হই।
বলতে বলতে মিসের চোখ দুটো হারিয়ে গেল দূর মেঘেদের দেশে, মনটাও হয়তো উড়াল দিল সেই সাথে।
আমরাও আনন্দিত হয়ে উঠলাম। বারবার মিসকে অনুরোধ করলাম, মিস, নিয়ে যান না... প্লিজ...
মিস বারবারই আমাদের কথা রাখলেন না। বললেন, সবাই বলবে, ফারহানা মিস কিচ্ছু পড়ায় না। শুধু ক্লাস ফাঁকি দিয়ে মাঠে নিয়ে যায়। পড়তে হবে তো, চলো, পড়া শুরু করি।
আমরা কেউ মিসের কথা মানব না। একপর্যায়ে মেনে নিলাম, তবে খুব হতাশ হয়ে মন খারাপ করে বই খুললাম। মিস ভালোভাবে আমাদের দেখলেন। তারপর বইটা আবারো টেবিলে রেখে বললেন, লাইন করে নিচে চলো।
সবাই চিৎকার করে উঠালাম। এটাই আমাদের আনন্দ প্রকাশের ভাষা। মিস চোখ বড় বড় করলেন, এই! এভাবে চিৎকার করলে বই খুলে পড়ানো শুরু করব কিন্তু!
আকাশের খুব মন খারাপ। যেপাশটা সাদা ছিল, সেটাতেও জমাট বেঁধেছে কালো মেঘ। হালকা হালকা বাতাস। গাছের ডালগুলো নাচছে, একজন আরেকজনের সাথে লেগে অদ্ভুত এক ছন্দ তুলছে। কোথে থেকে মিষ্টি একটা ঘ্রাণ ভেসে আসছে। খুব পরিচিত... সোঁদা মাটির ঘ্রাণ। একটু পরই মুষল ধারায় বৃষ্টি নামবে তারই আগমনী বার্তা।
আমরা সবাই ঘাসের উপর গোল হয়ে মিসকে ঘিরে বসে আছি। কে একজন বৃষ্টির একটা গান গাইছে, খুব আস্তে। মিস বললেন, সবাই মিলে গাও না মা!
কয়েকজন মিলে গান শুরু করল। বৃষ্টির গান। শ্রাবণের গান, শ্রাবণের আকাশে জমাট বাঁধা মেঘেদের গান। আমরা চুপ করে বসে রইলাম। বৃষ্টিকে আমরা ডাকছি, আরো কাছে, আরো আরো কাছে আসতে... আস্তে আস্তে বৃষ্টি শুরু হচ্ছে। টিপটপ... টিপটপ...
মিস বললেন, মা, ভিজে যাবে তো! চলো চলো, ক্লাসে চলো। ঠাণ্ডা লেগে গেলে ফারহানা মিসকে মা-বাবারা এসে...
কে একজন আস্তে করে বলল, আমাদের জন্য না হয় একটু বকা খেলেনই মিস। থাকি না, আর কিছুক্ষণ। বৃষ্টিটা নামুক। কখনো তোও ভিজতে পারি না, ভিজিই না একদিন।
মিস চুপ করে গেলেন। হালকা হেসে সায় দিলেন শুধু।
বৃষ্টিটা আমাদের ভিজিয়ে দেওয়ার প্রস্তুতি নিতে লাগল। আমরা কেউ উঠলাম না। ঠায় বসে রইলাম। ফারহানা মিসের চোখ দুটো আবারো দূর আকাশের মেঘের ভেলায় হারিয়ে গেল। এবার কী ভাবছেন, কে জানে!
আমার চোখ দুটো গভীর শ্রদ্ধার সাথে মিসের দিকে তাকাল। ভাবলাম, সবাই কেন ফারহানা মিসের মতো হয় না? বই, পড়া, ক্লাসওয়ার্ক, হোমওয়ার্ক- এই কী জীবন? এইটুকুই কী একজন টিচারের দায়িত্ব? মায়ের পরই শুনেছিলাম শিক্ষকের স্থান। কিন্তু কয়জন শিক্ষককে স্থান দেওয়া যায় মায়ের পর পর? কাউকে কাউকে যায়। তবে সে শুধুই দুই-একজন। আমাদের এই ফারহানা মিসের মতো একজন। নিজের প্রথম প্রশ্নটার উত্তর নিজেই দিয়ে দিলাম, সবাই যদি ফারহানা মিস হত তবে আমরা এভাবে আমাদের ফারহানা মিসকে আলাদা করে উপলব্ধি করতাম না। হয়তো সেজন্যই সবাই ফারহানা মিস নয়। ফারহানা মিস তো শুধু একজনই। প্রতিটা স্কুলেই হয়তো দুজন, চারজন, পাঁচজন- এমন টিচার থাকবেন। তবে তারা ফারহানা মিস নন। অন্য কেউ।
আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে গালে ভেজা কিছুর অস্তিত্ব টের পেলাম। নাহ! আমি কাঁদছি না। শুধুই বৃষ্টির একটা ফোঁটা এটা। আলতো করে আমাকে আদর করে দিচ্ছে। মিসের দিকে আবারো তাকালাম। মিসের গালেও বৃষ্টির ফোঁটাগুলো পরম যত্নে আদর ছুঁয়ে দিচ্ছে। তবে মিসের চোখের কোনটাও ভেজা মনে হল। এটাও কী বৃষ্টির কারসাজি? নাকী এবারেরটা চোখের বৃষ্টি? আমি জানি না। আমার চোখ দুটোকে আমি পাঠিয়ে দিলাম দূর দিগন্তে। তোরা দেখ, যা কিছু সুন্দর, সব দেখ।
তখনো গাছের ডালের- পাতার নৃত্যের ছন্দে ছন্দে আমাদের কিছু বান্ধবীরা গান গেয়ে চলেছে, শ্রাবণের মেঘগুলো জড়ো হলো আকাশে, অঝোরে নামবে বুঝি শ্রাবণ...
ততক্ষণে অবশ্য শ্রাবণ নেমেই গেছে।
বাংলাদেশ সময়: ২৩০১৮ ঘণ্টা, অক্টোবর ০৫, ২০১৩
এএ/আরকে-ichchheghuri@banglanews24.com