গাইটার গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে ওকে মুখে তুলে খাইয়ে দিল বাদল। গাইটা ওর খুব প্রিয় বন্ধু।
তবে কয়েকদিন ধরে বাদলের ভীষণ মন খারাপ। এক বছর আগে কালীকে কেনার সময়ই আব্বা ভেবে রেখেছিল, পরের কোরবানিতে বেচে দেবে। কালী ওদের গাইয়ের নাম। কুচকুচে কালো রং, তাই বাদলই এই নাম রেখেছে।
আব্বা যখন কোরবানিতে বিক্রি করার আশায় কালীকে কেনেন, তখন বাদল এভাবে ভাবেনি। কালীকে পেয়েই ও খুব খুশি ছিল। আস্তে আস্তে সময় গড়িয়েছে, দেখতে দেখহতে পেরিয়ে গেছে একটা বছর। এখন আবার কোরবানি এসে গেছে। আব্বা কালীকে বিক্রি করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। বেশ অনেকদিন আগে থেকেই ওর যত্ন-আত্তি বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। আর এই কালীটা কদিন পর থাকবে না, তাই স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে বাদলও তার পেছনে সময় দিচ্ছে।
আব্বা বলেছে, কালীকে বিক্রি করে দেবে, কিন্তু ওর বাচ্চাটাকে রাখবে। কোরবানির সময় ওইটুকু বাছুর কেউ কেনে না।
বাদল ভেবে পায় না বাছুরটা মাকে ছাড়া থাকবে কী করে। আব্বাটা যে কী নিষ্ঠুর!
কালকে বাদল আর ওর বাবা কালীকে হাটে নিয়ে যাবে। কালীর পেছনে এই এক বছরে বাবা খরচ করেছে ৫০ হাজার টাকা। বাবা আশা করছে কালীকে বিক্রি করে অন্তত ৭০ হাজার টাকা পাবে।
আজকে বাদল এক মুহূর্তের জন্যও কালীকে ফেলে কোথাও যায়নি। সারাক্ষণ ওর কাছে থাকছে। বাছুরটাকেও কালীর কাছ ছাড়া করছে না। কালকের পর তো আর বাছুরটা মাকে পাবে না।
আজকে বাদল বাবার সাথে কালীকে নিয়ে হাটে এসেছে। কালীকে আনার আগে মা ওকে খুব আদর করেছে। তারপর আঁচলে মুখ ঢেকে পাশের বাড়ি চলে গেছে। কালীকে নিয়ে যাওয়ার দৃশ্য সে দেখতে চায় না। আর বাছুরটা তো মাকে যেতেই দেবে না। অবলা জীব, কী বুঝেছে কে জানে! দড়ি খুলে মায়ের কাছে চলে আসতে চাচ্ছিল। অনেক কষ্টে শক্ত করে বেঁধে-ছেদে রেখে আসতে হয়েছে।
এবার গরুর দামই নেই। ব্যাপারীদের মূলধনও উঠছে না। কালীর দাম উঠেছে ৪৫ হাজার টাকা পর্যন্ত। বাবা অনেক চেষ্টা করছে, ৬০ হাজার হলেও কালীকে বেচে দেবে। কিন্তু সে দাম উঠলে না!
হাটে একটা বাচ্চা ছেলে এসেছে। ছেলেটা বাদলের বয়সী। এসেছে বাবার সাথে। বাদলও বাবার সাথেই এসেছে। সে এসেছে গরু বিক্রি করতে, আর এই ছেলেটা এসেছে গরু কিনতে। খুব শখ করে এসেছে, কখনো হাট দেখেনি, গরুর হাট দেখবে, সুন্দর গরু কিনে বাড়ি যাবে। কিন্তু শহুরে ছেলে তো, হাটে এত গরু-ছাগল আর মানুষের ভিড়, গরম, দুর্গন্ধ- সব মিলে অস্থির হয়ে যাচ্ছে।
অনেক গরু দেখেছে এই ছেলেটা আর ওর বাবা। কালীকে দেখেই ছেলেটা বলল, বাবা, এই গরুটা আমরা নেব। কী সুন্দর কালো কুচকুচে রং! আর চোখ দুটো দেখো! মনে হচ্ছে আমার দিকেই তাকিয়ে আছে। ওর আমাকে পছন্দ হয়েছে। ও চাচ্ছে আমরা ওকে কিনি। আমরা এই গরুটাই কিনব।
বাদল মনে মনে বলল, আমার কালীরে আমি চিনি না! ও তো দুঃখে তাকায় আছে। বাছুরটারে রাইখা চইলা আইছে। বুঝতে পারছে, অরে বেইচ্চা দিমু। ও কহন চাইল ওই পোলাডা অরে কিনুক! শহরের পোলা, গরুর কথা হেয় কী বুঝব!
ছেলেটার বাবা কালীকে টিপেটুপে গায়ে মাথায় হাত দিয়ে দেখলেন। কালী শান্ত মেয়ে, কিছুই বলল না। খুব মন খারাপ করে রইল। লোকটা কালীর জন্য ৪০ হাজার টাকা দিতে চাইল। বাদলের বাবা কোনোভাবেই বেচবে না। সে বলল, সাব, আমার কালীর জন্য এই এক বছরে ৫০ হাজার ট্যাকা খরচ করছি। আমরা গরিব মানুষ। আপনেরা এমুন করলে আমাগের তো না খাইয়া মরা লাগব! আপনে গো পয়সা আছে, দুই পয়সা বেশি দিয়া একখান গরু কিনবের পারেন। আমরা তো এক কেজি মাংসও কিনবার পারি না।
লোকটা খুব তাচ্ছিল্য করে বলল, অমন কথা সবাই বলে। এই তো এক রোগা-পটকা গরু, তার জন্য নাকী ৫০ হাজার টাকা খরচ! আমাকে শেখাবে তুমি?
ছেলের হাত ধরে লোকটা অন্য দিকে চলে যাওয়ার জন্য ঘুরে দাঁড়াল। কিন্তু ছেলেটা কোনোভাবেই যাবে না। সে অন্য কোনো গরু কিনবে না। তার মনে হয়েছে, কালী তাকে পছন্দ করেছে। কালীকেও তার পছন্দ হয়েছে। সে কালীকেই চায়। অনেকক্ষণ বোঝানোর পরও ছেলেটা বুঝল না। এরপর সে কাঁদতে শুরু করল। বাধ্য হয়ে লোকটা আবার বাদলের বাবার সাথে কালীকে কেনার জন্য দরদাম করতে লাগল। শেষমেশ ৪৮হাজার টাকায় রাজি হয়ে গেল বাদলের বাবা। দুই হাজার টাকা লোকসান দিয়ে হলেও কালীকে তার বেঁচতে হবে। কালীর জন্য অনেক ধার-দেনা হয়েছে। সেসব পরিশোধ করতে হবে। আর এবার যা বাজার! কেউ ৫০ হাজার টাকা দিয়েও কালীকে কিনবে না।
কালীকে বাদল আর ওর বাবা লোকটার বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে এল। তারপর খুব মন খারাপ করে ফিরতি পথ ধরলো। বাদল একবারের জন্যও পেছন ফিরল না। কালীকে আর দেখে কষ্ট পেতে চায় না সে। সে শুনতে পেল তার বয়সী ওই ছেলেটা আনন্দে চিৎকার করছে। কালীর গায়ে হাত রেখে আদরও করছে। বাদল মনে মনে বলল, তোরে ওরা কোরবানি দিব। কিন্তু এই কয়ডা দিন আমার কথা আর তোর মনে পড়ব না। ওই পোলাডা তরে অনেক আদর করব। আমার থেকেও বেশি।
এসব ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ বাদল শুনতে পেল ছেলেটার আনন্দের চিৎকার পরিণত হয়েছে হাহাকার আর ভয়ে।
আর তার সাথে সাথে বাড়ির অন্যরাও চেঁচাচ্ছে। বাদল পেছন ফিরে চাইল। যেন নিজের চোখ দুটোকেই বিশ্বাস করতে পারল না। শান্তশিষ্ট কালী, যে কখনো কাউকে গুঁতো পর্যন্ত দিতে চায়নি, সেই কালী চোখ লাল করে শিং বাগিয়ে ছুটে আসছে। ওই বাড়ির লোকেরা সবাই পেছন পেছন ছুটছে, কালীকে ধরতে পারছে না।
বাদল কোনোকিছুকে পরোয়া করল না। ক্ষিপ্ত কালীর দিকে ছুটে গেল সে। চিৎকার করে ডাকল, কালী!
কালী তার পরিচিত ডাক শুনে কেমন শান্ত হয়ে গেল। তার ক্ষিপ্ত ভঙ্গিমা পালটে গেল, নিজেকে খুব নিরাপদ মনে করল যেন। বাদলের কাছে এসে বাদলের গায়ে মাথা ঘঁষে আদর নিতে লাগল।
বাদল কালীকে একটু আদর করে বলল, কী দুষ্টু মেয়েরে তুই! এমন করে কেউ!
ততক্ষণে ওই বাড়ির মানুষগুলো চলে এসেছে। সাথে সেই ছেলেটাও আছে। সে বলল, আমাদের গরুকে দিয়ে দাও। তুমি ওকে রাখবে না। দিয়ে দাও।
বাদল যত্ন করে কালীর গলার দড়িটা আবার বেঁধে কালীকে বাড়িটাতে ঢুকিয়ে বেঁধে দিয়ে এল। কালী যেন বাদলকে বলতে চাইল, তুমি এতদিন আমার বন্ধু হয়ে থেকে আজ আমাকে ফেলেই চলে যাচ্ছ? আমাকে নিয়ে যাও না। বাড়িতে আমার বাছুরটা আছে তো। কতক্ষণ আমাকে দেখে না। নিয়ে চলো না আমাকে। করুণ স্বরে সে ডেকেই চলল, হাম্বা! হাম্বা!
বাদল থামল না। বাবার সাথে বাড়ির পথ ধরল।
আজ কোরবানির ঈদ। বাদলের বাবা কাজী বাড়ি থেকে মাংস নিয়ে এসেছে। মা মশলা বেটে রান্নার প্রস্তুতি নিচ্ছে। বাদল বসে আছে বাড়ির উঠোনে, কালীর ঘরের পাশে। এই ঘরে দুদিন আগেও একটা সুন্দর কালো গরু আর তার বাচ্চা খেলা করত। আজকে শুধুই বাচ্চাটা আছে, মায়ের স্থান শূন্য।
বাদলের মা ডাক দিল, বাদল! আয় শিগগির! গোশত রান্না হইয়া গেছে। গরম গরম খা, আয়। বাদল আস্তে আস্তে রান্নাঘরে গেল। বাবা খুব মজা করে গরুর মাংস দিয়ে পিঠা খাচ্ছে। মা বাদলকে একটা প্লেট্টে গরম গোশত আর পিঠা তুলে দিল। বাদল একটা পিঠা আর একটু মাংস নিয়ে মুখের কাছে তুলল। তারপর কী মনে করে হঠাৎ সেটা প্লেটে নামিয়ে রেখে প্লেটটা হাতে নিয়ে ছুট লাগাল। বাড়ির সামনে পুকুরে নিয়ে প্লেটটা ছুঁড়ে ফেলল সে। তারপর জোরে জোরে শ্বাস নিতে লাগল।
মা-বাবা ছুট এল। ভয় পেয়েছে দুজনই। বারবার জানতে চাইল, এই বাদল! কী হইছে তোর?
বাদল কিছু বলল না। চুপ করে রইল। সে জানে তার কী হয়েছে।
আজকে তার কালীকেও কোরবানি করা হয়েছে। তার কালীর মাংসও নিশ্চয়ই রান্না হয়েছে। সবাই মজা করে সেই মাংস খাচ্ছে। বাদলের আদরের কালীকে সবাই খাচ্ছে! সেই যে ছেলেটা, যে কালীকে এত আদর করেছিল, সেও এক্ষন আনন্দ করে কালীর গোশত খাচ্ছে।
যেই মাংস বাবা এনেছে, এটা কালীর মাংস না। অন্য গরুর মাংস। কিন্তু বাদল কীভাবে তাকে খাবে? এই গরুটাও হয়তো কোনো বাছুরের মা, কোনো বাদলের প্রিয় কালী।
বাদল আস্তে আস্তে কালীর ঘরটার দিকে হেঁটে গিয়ে বাছুরটাকে খুলে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। মা-বাবা শুধু দেখল, হলুদ সরষে ক্ষেতের ভেতর দিয়ে ধীর পায়ে বাছুরটাকে নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে বাদল। দূর থেকে দেখে মনে হলো, বাদল কাঁদছে। মা হারা বাছুরটার মায়ের জন্য কাঁদছে। তার কালীর জন্য কাঁদছে।
বাংলাদেশ সময়: ১০০০ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৩, ২০১৩
এএ/এমজেডআর