‘ভারতের কৃষকের দুঃখ, ইরানের কৃষকের দুঃখ
বার্মার কৃষকের দুঃখ, নেপালের কৃষকের দুঃখ,
ভুটানের কৃষকের দুঃখ, কাবুলের কৃষকের দুঃখ,
বাংলাদেশের কৃষকের দুঃখ- এক দুঃখ
... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ...
অন্যায়ের প্রতিবাদ করো। জুলুমকে রুখিয়া দাঁড়াও,
যদি কাহাকেও শাসাইতে হয় তাহার সম্মুখে
বীরের মতো বলো।
অজ্ঞাতে কিছু বলিও না। ’
কথাগুলো কে বলেছিলেন জানো? হ্যাঁ, ঠিকই বলেছো। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। গরিব দুঃখী, শোষিত নিপীড়িত মানুষের প্রাণপ্রিয় নেতা ছিলেন তিনি। অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে তিনি ‘মজলুম জননেতা’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিলেন।
ভাসানীর জন্ম ১৮৮৫ সালের ১২ ডিসেম্বর সিরাজগঞ্জের ধানগড়া গ্রামে। তার বাবার নাম হাজী মোহাম্মদ শরাফত আলী খান। মায়ের নাম মজিরন নেসা বিবি। অল্প বয়সে তাঁর বাবা-মা ও ভাইবোনেরা মারা যান। ফলে শৈশবেই তিনি বাড়ি ছাড়া হন। শিষ্য হন সিরাজগঞ্জে আসা ইরাকের পীর নাসিরউদ্দিন শাহ বোগদাদীর। পীর সাহেবের চেষ্টায় ভারতের আসামে পড়ালেখা করেন তিনি।
সামাজিক বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি তিনি ১৯১৯ সালে ইংরেজ বিরোধী আন্দোলন শুরু করেন। শুরু করেন কৃষকদের পক্ষে জমিদারদের বিরুদ্ধে আন্দোলন। আন্দোলনের অংশ হিসেবে বিশাল এক কৃষক সম্মেলনের আয়োজন করেন আসামের ‘ভাসান’ চরে। সেখান থেকে তার নাম হয় ‘মওলানা ভাসানী’।
১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ দুই ভাগ হওয়ার পর ভাসানী ফিরে আসেন পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশে। ১৯৪৯ সালে তিনি পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন করেন। ১৯৫৭ সালে গঠন করেন ‘ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ)’।
ব্রিটিশ ভারতের অন্যতম তৃণমূল রাজনীতিবিদ ও গণআন্দোলনের নায়ক ছিলেন তিনি। ১৯৪৭ সালে সৃষ্ট পাকিস্তান ও ১৯৭১-এ প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট গঠনকারী প্রধান নেতাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ভাসানী। স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায়ও বিশেষ ভূমিকা পালন করেছেন।
তিনি রাজনৈতিক জীবনের বেশিরভাগ সময় মাওপন্থি কম্যুনিস্ট তথা বামধারা রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন। তার অনুসারীদের অনেকে এজন্য তাকে ‘লাল মওলানা’ নামেও ডাকতেন।
তিনি ছিলেন একজন দূরদর্শী নেতা। পঞ্চাশের দশকেই তিনি নিশ্চিত হয়েছিলেন যে পাকিস্তানের অংশ হিসেবে বাংলাদেশ একটি অচল রাষ্ট্রকাঠামো। এজন্য এদেশ অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা একান্ত প্রয়োজন। একথা ভেবেই তিনি ১৯৫৭ সালে কাগমারী সম্মেলনে পাকিস্তানের পশ্চিমা শাসকদের ‘ওয়ালাইকুমাসসালাম’ বলে সর্বপ্রথম পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতার ঐতিহাসিক ঘণ্টা বাজিয়েছিলেন।
পূর্ব পাকিস্তানিদের ওপর পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর শোষণ নির্যাতন দমন নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। এজন্য একাত্তরের আগে তিনি বহুবার জেলও খেটেছেন।
সবশেষে ১৯৭১ সালে অংশ নেন মহান মুক্তিযুদ্ধে। স্বাধীনতার পর নবগঠিত সরকারের সহযোগিতার পাশাপাশি ভুল-ত্রুটিও ধরিয়ে দিতেন তিনি। ১৯৭৬ সালের ২০ মার্চ ফারাক্কার পানি সমস্যার সমাধান না করলে ভারতের বিরুদ্ধে অহিংস-অসহযোগ আন্দোলনের কথা ঘোষণা করেন। ১৭ এপ্রিল এক ঘোষণায় জানান, অবিলম্বে গঙ্গার পানি সমস্যার ন্যায়সঙ্গত সমাধান না হলে তিনি ১৬ মে এক অহিংস মিছিল নিয়ে ফারাক্কার দিকে যাবেন। সেই ঘোষণা মতো তিনি ঐতিহাসিক ফারাক্কা মিছিল নিয়ে সীমান্তের দিকে লংমার্চের নেতৃত্ব দেন।
ওই বছরের ২৮ সেপ্টেম্বর হৃদরোগের সমস্যার জন্য ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে ভর্তি হন। এবং ১৩ নভেম্বর হাসপাতাল থেকে অ্যাম্বুলেন্সে ‘খোদা-ই-খিদমতগার’ সম্মেলনে যোগদানের জন্য টাঙ্গাইলের সন্তোষ যান। সেখানে তিনি জীবনের শেষ ভাষণ দেন। সম্মেলন শেষে ওই দিনই ঢাকায় আসেন এবং পুনরায় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১৭ নভেম্বর রাত ৮.২০ মিনিটে তিনি মারা যান। ১৮ নভেম্বর টাঙ্গাইলের সন্তোষে তার গড়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদ এলাকায় পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাকে দাফন করা হয়। পালন করা হয় এক সপ্তাহের জাতীয় শোক।
৫২’র ভাষা আন্দোলন, ৫৪’র যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন ও স্বেচ্ছাচার বিরোধী ২১দফা সংগ্রাম, ৬২’ শিক্ষা কমিশন আন্দোলন, ৬৯’র আইয়ুব বিরোধী গণআন্দোলন, ৭১’এ মহান মুক্তিযুদ্ধ, ৭৬’এ ভারতীয় পানি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ফারাক্কা লংমার্চে বলিষ্ঠ নেতৃত্ব দিয়ে লক্ষ কোটি মানুষকে উজ্জীবিত করেছিলেন। সুদীর্ঘ ৭৫ বছরের অধিককালে জাতীয় জীবনের এমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা নেই যেখানে মওলানা ভাসানীর সক্রিয় ভূমিকা ছিল না।
তাই তাঁর আসন সব মানুষের মনে ঠাঁই করে নিয়েছে। রাজনীতি সম্পর্কে তিনি বলতেন, ‘রাজনীতি হইতেছে এমন একটি মহৎ কর্মপ্রয়াস যাহার লক্ষ্য সমাজ হইতে অন্যায়, অত্যাচার, শোষণ ও নির্যাতনের অবসান ঘটাইয়া জাতিধর্মনির্বিশেষে সমাজের সকল মানুষের সামগ্রিক কল্যাণ ও মঙ্গলের পথ প্রশস্ত করা। সমাজে ন্যায়বিচার, আইনের শাসন, বাকস্বাধীনতা তথা সামগ্রিক গণতান্ত্রিক অধিকার নিশ্চিত করা। ’
তার মতো আমরাও চাই সমাজে ন্যায়বিচার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হোক, মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার নিশ্চিত হোক। মুক্তবুদ্ধির চর্চা হোক। কল্যাণ হোক সব মানুষের। তার প্রয়াণ দিবসে এটাই আমাদের কামনা।
ইচ্ছেঘুড়িতে লেখা পাঠান এই মেইলে: ichchheghuri24@gmail.com
বাংলাদেশ সময়: ০২০০ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৭, ২০১৩
এএ/আরকে