বাঙালির যুদ্ধ জয়ের অন্যতম হাতিয়ার ছিল গেরিলা যুদ্ধ। পাকিস্তানি সৈন্যদের কুপোকাত করতে মোক্ষম ভূমিকা রেখেছিল যুদ্ধের এই বিশেষ পদ্ধতি।
‘মানুষ একমাত্র প্রাণী যে তার নিজ প্রজাতির সদস্যকে হত্যা করতে পারে। মানুষই একমাত্র প্রাণী যে ভিন্ন ধর্ম, রাষ্ট্র বা ভিন্ন মতাবলম্বি হওয়ার অজুহাতে অসংখ্য মানুষের বিরুদ্ধে গণহত্যা শুরু করতে পারে। কিন্তু সভ্য মানুষ নিজ রাষ্ট্রের ও একই ধর্ম এবং মতাবলম্বি জনগণের ওপর কখনও ব্যাপক গণহত্যা চালায়নি। এবং পরিকল্পিত গণহত্যা পৃথিবীর কোনো সভ্য মানুষই কখনও সমর্থন করেনি। অথবা ‘সে দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার’ এই অজুহাতে কোনো গণহত্যাকে কোনো সরকার আইনসিদ্ধ করার চেষ্টা কোনো কালেই করেনি। শুধু এখানেই ব্যতিক্রম। ’ আর এই ব্যতিক্রমটুকুর জন্যই বোধহয় আমরা মাত্র নয় মাসে স্বাধীনতার লাল সূর্য জয় করে আনতে পেরেছিলাম।
তৎকালীন শাষকগোষ্ঠীর সব দুঃশাসন, শোষণ, নির্যাতন, নিপীড়ন, চক্রান্ত উপেক্ষা করে সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে আমরা পেয়েছিলাম স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশ। আমাদের এই সংগ্রাম সফল করার পিছনে গেরিলা যোদ্ধাদের সক্রিয় ও সাহসী ভূমিকা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এখন আমরা জানব আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে কোন যোদ্ধাদের বলা হতো গেরিলা যোদ্ধা। গেরিলা যোদ্ধারা কীভাবে কাজ করতো। কীভাবে পরিচালিত হতো গেরিলা ঘাঁটি।
গেরিলা যোদ্ধা তাদের বলা হতো যারা ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে চোরাগোপ্তা হামলা চালিয়ে শত্রুকে বিপর্যস্ত করে তুলতো। যুদ্ধের সময় প্রত্যেকটি গেরিলা ঘাঁটি পরিচালিত হতো অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে। গেরিলা যোদ্ধাদের মধ্যে ছিল তিনটি গ্রুপ।
অ্যাকশন গ্রুপ, গোয়েন্দা সেনা গ্রুপ এবং গেরিলা ঘাঁটি। অ্যাকশন গ্রুপের সদস্যরা শত্রুর বিরুদ্ধে সরাসরি গেরিলা হামলা পরিচালনা করতো। তাদের শতকরা ৫০ থেকে ১০০ ভাগ সদস্য অস্ত্র বহন করতো। গোয়েন্দা সেনা গ্রুপের সদস্যরা সাধারণত সরাসরি সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়তো না। এরা শত্রু পক্ষের খবরাখবর সংগ্রহ করতো। নিয়ম ছিল এদের শতকরা ৩০ ভাগের বেশি সদস্যের হাতে অস্ত্র থাকতে পারবে না।
গেরিলা ঘাঁটিতে গেরিলাদের থাকা খাওয়ার জন্য কয়েকটি নিরাপদ ঘর থাকত। যেখান থেকে যথাযথ খবর পাওয়ার পর পরই পরবর্তী লক্ষ্যস্থলে তারা দ্রুত পৌঁছাতে পারে। প্রত্যেক ঘাঁটিতে একটি করে মেডিকেল গ্রুপ ছিল। যারা যুদ্ধাহত গেরিলাদের চিকিৎসা করাতো। প্রত্যেকটি ঘাঁটি ছিল একজন রাজনৈতিক নেতার দায়িত্বে। এদের দায়িত্ব ছিল বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে পাকিস্তানিদের মানসিকভাবে দুর্বল করে দেওয়া। একই সঙ্গে বাঙালিরা যেন মানসিক সাহস ও শক্তি হারিয়ে না ফেলে সেদিকে লক্ষ্য রাখা। শত্রুর বিরুদ্ধে বড় ধরনের আক্রমণ পরিচালনার উদ্দেশ্যে আরও বেশি সংখ্যক গেরিলা কিংবা নিয়মিত বাহিনীর সৈনিকদের স্থান সংকুলানের জন্য প্রতিটি ঘাঁটিকে প্রস্তুত রাখাও এদের দায়িত্ব ছিল।
এই গেরিলারা ১৯৭১ সালে গ্রামাঞ্চলে বেশ কার্যকর অবস্থান গড়ে তুলেছিল। এক কথায় বলা যায় তখন সারাদেশটাই পরিণত হয়েছিল এক বিরাট গেরিলা ঘাঁটিতে। ফলে তখন যোদ্ধারা যে কোনো দিকে যে কোনো সময় অভিযান পরিচালনা করতে পারতো। প্রতিটি রাতই ছিল তাদের কাছে একান্তভাবে নিজস্ব। কারণ তারা বড় বড় বেশিরভাগ অভিযান চালাত রাতের অন্ধকারে। ফলে পাকিস্তনি সৈন্যরা ভয়ে রাতের বেলায় পারতপক্ষে বাইরে বের হতো না।
সেসময় মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে সাধারণ জনগণের সমর্থন ছিল ব্যাপক। গেরিলাদের সাহায্য করতে পারলে গ্রামাঞ্চলের মানুষ সম্মানিতবোধ ও গর্ব অনুভব করতো। গেরিলাদের খাবার আশ্রয় এবং আহতদের যথাসাধ্য চিকিৎসা ও সেবা দেওয়ার জন্য সবাই ব্যস্ত হয়ে যেত।
এ কারণে ওই সময় গেরিলাদের সহযোগিতা করার অপরাধে পাকিস্তানি সৈন্যরা বহু মানুষকে হত্যা করেছে। তাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিয়েছে। জিনিসপত্র লুট করেছে। লুটের সেই মালামালের ভাগ পুরস্কার হিসেবে রাজাকার আলবদর ও দালালদের দিয়েছে। তারপরও সাধারণ মানুষের পক্ষ থেকে গেরিলা যোদ্ধাদের সহযোগিতার হাত পাকিস্তানিদের বন্দুকের নল, আগুন, লুটতরাজ, নির্যাতন দমাতে পারেনি। বরং তারা আরো প্রত্যয়ী হয়েছে ব্যকুল হয়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করার জন্য। দেশকে স্বাধীন করার জন্য। দেশের সাধারণ মানুষ সেদিন যদি এই ত্যাগ স্বীকার না করতো তাহলে হয়তো এত কম সময়ের মধ্যে দেশ স্বাধীন হতো না। আমরা পেতাম না লাল সবুজ পতাকা।
বাংলাদেশ সময়: ০৫৪৯ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৫৪, ২০১৩
সম্পাদনা: আসিফ আজিজ, নিউজরুম এডিটর