ঢাকা, সোমবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ইচ্ছেঘুড়ি

অর্ণব রহমান-এর গল্প

সাইকেলভূত

. | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৩৮ ঘণ্টা, মার্চ ১৮, ২০১৪
সাইকেলভূত

ভোলানাথ পোদ্দারের বাড়ি সাফিপুর গ্রামে। শান্তিপুর বাজার থেকে যেতে প্রায় দুই ঘণ্টা লাগে।

প্রতিদিন এই পথটুকু তিনি হেঁটেই যান। একটা সাইকেল অবশ্য সবসময় সঙ্গেই থাকে। কিন্তু তিনি তাতে কখনই চাপেন না। কারণ সেটা অনেক পুরনো, চাপার অযোগ্য।

ভোলানাথ পোদ্দারের দাদু যখন হাইস্কুলে ওঠেন, তখন আসা যাওয়ার সুবিধার জন্য সাইকেলটি কিনে দিয়েছিলেন দাদুর বাবা। মৃত্যুর আগে ভোলানাথ পোদ্দারের বাবাকে সাইকেলটি দান করে যান দাদু। বাবার মৃত্যুর পর এখন এটির উত্তরাধিকারী ভোলানাথ। সাইকেলটি এখন আর চলার মত নেই, জায়গায় জায়গায় জং। আলগা হয়ে গেছে অনেকগুলো জোড়া। কিছু কিছু পার্টসও খুলে পড়ে গেছে।

ভোলানাথ এটা সারানোর যে চেষ্টা করেন নি তা নয়, কিন্তু যতবার সারাইয়ের দোকানে নিয়ে গেছেন ততবারই মদন পাল মুখ কালো করে ফিরিয়ে দিয়েছেন। এক বাক্যে বলে দিয়েছেন এই সাইকেল মেরামতের অযোগ্য। কিন্তু ভোলানাথ কি তা পারেন! এত পুরনো জিনিস। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে তার তিন পুরুষের কত স্মৃতি! তাছাড়া সাইকেলটা তো তার জীবন যৌবন সবটুকু নিংড়ে দিয়েই তার পরিবারের সেবা করেছে। এটাকে ফেলে দেয়া আর বৃদ্ধ বয়সে নিজের পরিবারের একজনকে পরিত্যাগ করার মধ্যে তফাত আছে কোন?

না। ভোলানাথ বেঁচে থাকতে এতটা অকৃতজ্ঞ হতে পারেন না। অনেক ভেবেই তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, সাইকেল যেমন আছে তেমনই থাকবে। লোকে যাই বলুক না কেন? তিনি নিজে যতদিন চলেফিরে বেড়াবেন সাইকেলটিও তার পাশে পাশে চলেফিরে বেড়াবে। সাইকেলের প্রতি এধরনের ভালোবাসা সত্যিই বিরল। গ্রামবাসীর মতে এই সাইকেল সাইকেল করেই বিয়ে করা হলো না ভোলানাথের। বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান ভোলানাথ মা বাবার অনেক অনুরোধ সত্ত্বেও বিয়ে করেন নি। এখন তার সংসারে আপন বলতে এই সাইকেলটিই আছে।

সেদিনও সাইকেলে করে বাড়ি ফিরছিলেন ভোলানাথ। শান্তিপুর গ্রামের শেষমাথায় একটা খাল। শীতকালে খালটি একেবারেই শীর্ণ থাকে, কিন্তু এখন ভরা বর্ষা। বর্ষায় খালের রূপ একদম ভিন্ন, কি বিপুল জল বয়ে চলেছে, মনে হচ্ছে এটা খাল নয় এটা যেন একটা নদী। খালের উপর নড়বড়ে একটা সাঁকো। সাঁকো পেরিয়ে সফিপুর যেতে হয়। রোজই যান ভোলানাথ, কিন্তু আজ কেমন যেন ভয় ভয় লাগছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও সাইকেলসহ সাঁকোতে উঠে পড়েন ভোলানাথ, ধীরে ধীরে এসে পড়েন সাঁকোর একদম মাঝামাঝি। নড়বড়ে সাঁকোর এই অংশটাই সবচেয়ে বিপজ্জনক। এই অংশের প্রায় হাতদুয়েক জায়গায় কাঠ নেই, শুধু একখণ্ড বাঁশ আছে। এই বাঁশের উপর দিয়েই যেতে হবে তাকে।

চোখ বন্ধ করে একবার ইষ্টনাম জপ করলেন ভোলানাথ। তারপর পা রাখলেন বাঁশের উপর। কয়েক পা গিয়েছেন আর অমনি হুড়মুড় করে সাঁকো ভেঙে সাইকেলসহ খালের জলে ছিটকে পড়লেন ভোলানাথ পোদ্দার। দুর্ঘটনায় তার নিজের তেমন ক্ষতি না হলেও, জলের তীব্র স্রোতে কোথায় যেন ভেসে গেলো সাইকেলটা! অনেকক্ষণ খালের জলে ডুব দিয়ে খোঁজার পরও পাওয়া গেলো না ওটা। আপনজন হারানোর বেদনা নিয়ে বাড়ি ফিরলেন ভোলানাথ।
 
কলপাড় থেকে ভেজা কাপড় পাল্টে ঘরে এসে বসলেন তিনি। অন্ধকারে নিজেকে আজ সত্যিই ভীষণ একা মনে হলো তার। আহা রে! এতদিনের সঙ্গী সাইকেলটার সাথে এভাবে বিচ্ছেদ হবে এটা সে কখনোই ভাবেনি। দীর্ঘশ্বাস ফেলে হঠাৎ ঘরের পশ্চিমদিকে তাকান ভোলানাথ। তাকিয়েই অবাক! আরে! ঘরের থামে ঠেস দিয়ে দিব্ব্যি দাঁড়িয়ে আছে সাইকেলটা! ঠিক যেমন করে প্রতিদিন বাড়ি ফিরে রাখেন তিনি। হতবাক হয়ে উঠে দাঁড়ান ভোলানাথ।

ভালোমতো ব্যাপারটা বুঝে উঠার জন্য সাইকেলটার কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই মানুষের মত স্পষ্ট ভাষায় কথা বলে উঠে সাইকেলটা, “কি অবাক হচ্ছ?” ঘটনার আকস্মিকতায় সারা শরীর কেঁপেও ভোলানাথের। বিস্ময়ে তিনি কোনো কথাই বলতে পারেন না। ভোলানাথকে নিশ্চুপ থাকতে দেখে সাইকেলটা আবার বলে ওঠে, ‘অবাক হইওনা। আমি তোমার সেই সাইকেল না। একটু আগে খালের জলে ডুবে মৃত্যু হয়েছে আমার। আমি হচ্ছি তোমার সেই সাইকেলের ভুত। ”

ভোলানাথ পোদ্দার ভয় পান না উল্টে আরও ভাবনায় পড়েন, কিন্তু বেশ দৃঢ়তার সাথেই বলেন, “কেন মিথ্যে বলছ? তুমি জানো না ভুত বলে কিছু নেই?”

“তাই নাকি?” শব্দ করে হাসে সাইকেল ভূত, “কিন্তু যদি বলি ভুত আছে। আর ভুত যে আছে আমিই তো তার প্রমাণ”।
“না আমি বলছি ভূত বলে কিছু নেই”। ঘাড়ের রগ ফুলিয়ে বাচ্চাদের মতো গো ধরেন ভোলানাথ।
“ভূত যে নেই এ ব্যাপারে তোমার কাছে কোনো যুক্তি আছে?” ভোলানাথকে প্রশ্ন করে ভূতটা।
“আছে তো বটেই”।

“আচ্ছা তাহলে তোমার যুক্তিগুলো শোনা যাক”।
“ঠিক আছে বলছি শোনো তাহলে।

ভূত যে নেই তার প্রধান যুক্তি হলো......উমম, প্রধান যুক্তি হলো উমম......” তোতলাতে থাকেন ভোলানাথ। কারণ যুক্তি দিতে গিয়ে তিনি আবিষ্কার করেছেন, ভূত নেই এ কথা বহুবার বহু জায়গায় বললেও এ বিষয়ে আসলেই তার কাছে কোনো যুক্তি নেই।

“কি হলো বলছ না কেন?” অট্টহাসি হাসে সাইকেলের ভূত। “আমি ভালোভাবেই জানি কোনো যুক্তিই তোমার কাছে নেই। সুতরাং, আমি যে একটা ভূত মেনে নেয়াই ভালো”।

এভাবে একটা সাইকেল বা সাইকেলভূতের কাছে হেরে যেতে কিছুতেই মন চায় না ভোলানাথের। তাই তিনি মরিয়া হয়ে বলেন, “না ঘর যেহেতু অন্ধকার, আর আমারও যেহেতু মন ভালো নেই। তাই আমি হয়ত ভূল দেখছি চোখে। আরে তাই তো!” হঠাৎ একটা কথা বিদ্যুচমকের মতো ঝিলিক দিয়ে উঠে ভোলানাথের মনে, “ঠিক আছে দেখো তাহলে” বলতে বলতে সুইচবোর্ডের দিকে এগিয়ে যান ভোলানাথ। সঙ্গে সঙ্গে আতঙ্কে চেঁচিয়ে উঠে সাইকেলভূত, “কি করতে চাইছ তুমি?”

“তেমন কিছুই না। আমি শুধু আলো জ্বালাতে চাইছি”। বলেই তিনি সুইচে হাত রাখেন।
“না না আল জ্বেলো না”। রক্তহিম করা চিৎকার ছাড়ে সাইকেলভূত।
কিন্তু নির্বিকারভাবে সুইচ টিপে আলো জ্বালান ভোলানাথ। সঙ্গে সঙ্গে আলোকিত হয়ে যায় ঘর এবং প্রমাণ শেষ পর্যন্ত হয়েই যায় যে, ভূত বলে আসলেই কিছু নেই!

ইচ্ছেঘুড়িতে লেখা পাঠান এই মেইলে: ichchheghuri24@gmail.com


বাংলাদেশ সময়: ১৩৩৮ ঘণ্টা, মার্চ ১৮, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।