ঢাকা, সোমবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ইচ্ছেঘুড়ি

তামাকির বৈশাখী উপহার

আশিক মুস্তাফা | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬০৭ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৩, ২০১৪
তামাকির বৈশাখী উপহার

ওরা দুই বোন। বেড়াতে গেল জাপান।

ওদের বাবা স্কলারশিপ নিয়ে পড়ছেন সেখানে। বাবা যাওয়ার কিছুদিন পর দু’বোন গেল মায়ের সঙ্গে। দেশের সকালগুলো আলসেমিতে কেটে যেত তাদের। রাজ্যের ঝক্কি-ঝামেলার পর ঘুম থেকে টেনে তোলা হতো।

তবে জাপানে এমন হচ্ছে না। নিজ থেকেই উঠে পড়ে। আগে আগে উঠে রেডি হয়ে বাবার অপেক্ষায় থাকে। দেরি হলে পানি ছিটায় বাবার মুখে। বাবা জেগে উঠলে বেরোয় মর্নিংওয়াকে। একটু হাঁটে, একটু জিরোয়, একটু খুনসুটি করে। কখনও রাস্তার পাশের স্থাপনায় অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে। কখনও চেরি ফুলে মুগ্ধ হয়। কখনও আবার ভালোলাগা বিলিয়ে দেয় জাপানি ছোট মানুষের মাঝে।

জাপানি ছোট বাবুদের কেউ বাবা-মা, কেউ পরিবারের বড় সদস্যের সঙ্গে বের হয় মর্নিংওয়াকে। তাদের দু’বোনের দিকে প্রায়ই তাকিয়ে থাকে এক পিচ্চি। এক সকালে জাপানি ছোট বাবুটা নিজ থেকেই এসে কথা বলে দু’বোনের সঙ্গে। ঘুমকাতুরে চোখের সেই ছোট মানুষটির নাম তামাকি। তার দিকে তাকালেই নুজাইমা, নুসাইবার ছোট কাকুর দেওয়া জাপানের হাকাতা পুতুলের কথা মনে পড়ে যায়।   

সে যাক গে। কিছুদিনের মধ্যে তামাকির সঙ্গে খুব বন্ধুত্ব হয়ে গেল। জাপানি বাবুটা সব সময় পেছনের দিকে ঝুঁটি করে। লাল-নীল ফিতায় মোড়ানো থাকে ঝুঁটির চুল। তার দেখাদেখি ওরা দু’বোনও ঝুঁটি করে। লাল-নীল ফিতায় চুল মোড়ায়। চেরি ফুলের ব্যান্ড লাগায়। ঘুমকাতুরে চোখের তামাকির কথা মনে পড়লেই দু’বোনের ভালো লাগে। দেশের বন্ধুদের কথা মনে পড়ে যায়। ঢাকায় উনাইজা, আনুশকাদের সঙ্গে কথা বলে ফোনে। তামাকির গল্প করে। বাবার ল্যাপটপ থেকে উনাইজার বাবার কাছে ছবি মেইল করে। উনাইজা, আনুশকা ছবি দেখে বলে, ওমা, এত দেখি পুতুল! এই পুতলিটারে কই পেলি রে নুজাই? নুজাইমা ছোট করে হাসে।

ঠোঁটের আড়ালে হাসি লুকিয়ে বলে, জানিস, সে না পাকা বুড়ি! তোদের বিল্ডিংয়ের লি’র মতো। উনাই শোন, সে কথায় কথায় গল্প বলে। বললাম, এত গল্প কই পাস রে তামাকি? সে বলে, কাকুর কাছে। অ্যাই শোন শোন, ওরা কাকুকে কী বলে জানিস?

-কী?
-ওজিসান।
-কী সান?
-ওজিসান।
-হা হা হা।
-অ্যাই শোন না, সেদিন মর্নিংওয়াকে আমি, নুসাইবা আর তামাকি গল্প করছি চপ স্টিক নিয়ে।
-অ্যাই, চপ স্টিককে কী বলে রে ওরা?
-হাসি।
-আসি?
-অ্যা-ই, আসি না; হাসি! আমরা মজার কথা শুনলে হাসি না? সে-ই হাসি আর কি! বুঝলি?
-ও বুজছি।
-শোন না, তো চপ স্টিকের কথা উঠতেই সে তা নিয়ে গল্প শুরু করল। বলল, অনেক আগে জাপানে এক তরবারি যোদ্ধা ছিলেন। নাম মিয়ামতো। সে তরবারি নিয়ে কারিকুরি দেখাত। মিয়ামতো ভালোবাসতো ছোটদের। একবার সে বাড়ির সামনে পিচ্চিকাচ্চিদের নিয়ে খেলছিলো। আর তখন তার চোখের সামনে, কানের পাশ দিয়ে ভোঁ ভোঁ করে উড়ছিল একটি মৌমাছি। বড্ড বিরক্তিকর! কেউ মন দিতে পারছে না মিয়ামতোর গল্পে। ছোটদের কেউ বসে কেউ দাঁড়িয়ে,  হাততালির মতো করে মৌমাছিটি ধরতে চাচ্ছে। মিয়ামতো কিছুক্ষণ চুপ থেকে তার চপস্টিক জোড়া নিলেন। তারপর চপ স্টিকের মাথা দিয়ে টিং করে উড়ে যাওয়া মৌমাছি ধরে ফেললেন।

পিচ্চিদের তো চোখ ছানাবড়া! তার এই কীর্তির কথা ছোটরা তাদের বাবাকে বলল। মায়েদের বলল। অন্যরা শুনল। সরকার জানল, জনগণ জানল, কানে গেল সুমো কুস্তিগিরদেরও। যেই শুনে সেই অবাক। সবাই চোখের সামনে তরবারি যোদ্ধার মৌমাছি ধরা দেখতে চাইল। একদিন ঘটা করে আয়োজন হলো। রাজ্যের মানুষ এলো। এলেন সেই তরবারি যোদ্ধা মিয়ামতো। তাকে খোলা মাঠে বসিয়ে ছেড়ে দেওয়া হলো মৌমাছি। সে চপ স্টিক বের করল। কিছুক্ষণ চুপ থেকে চপ স্টিকের মাথা দিয়ে ভোঁ ভোঁ করে ওড়া মৌমাছি ধরে ফেলল।

অ্যাই শুনছিস?
-শুনছি। লোকটা সত্যিই ওই পুঁচকে লাঠির মাথা দিয়ে মৌমাছি ধরে ফেলল?
-হুম। জানিস, যেই কোম্পানির চপ স্টিক দিয়ে মিয়ামতো মৌমাছি ধরল। সেই চপ স্টিক কোম্পানির এখনকার প্রধান নির্বাহী হচ্ছে তামাকির বাবা।
-বাপরে, সে তো অনেক বড় চাকরি। অ্যাই নুজাই, তোরা কবে আসবি?
-সেপ্টেম্বরে।
-সে তো অনেক দেরি। তোর জন্মদিনে তো এবার আর মজা করতে পারব না।
-উনাই, শোন...
-বল।
-তামাকির বাবা আমাদের নতুন নাম দিয়েছেন।
-জাপানি নাম, তাই না?
-হু।
-কী নাম দিল, বল না ...
-কিন আর গিন। আমাকে ডাকে কিন আর নুসাইবাকে ডাকেন গিন নামে।
-অ্যাঁ! এ আবার কেমন নাম রে বাবা?
-আমার কাছেও ভালো লাগেনি। তবে নামের অর্থ জানার পর ভালো লেগেছে।
-কী অর্থ?
-কিন মানে সোনা আর গিন মানে রূপা।
-ও তাই! সুন্দর তো! অ্যাই নুজাই। তোর আম্মুর নাম না রূপা?
-হু। তামাকিকে বলেছি এ কথা। সে বলে কি, আমার দাদুর নামও তো তামাকি। তাতে কী?
-আসলেই তো। দু’জনের তো এক নাম হতেই পারে!
-শোন না, সেদিন সন্ধ্যায় তামাকির বাবা এসে আমাদের নিয়ে গেলেন।
-কোথায়?
-রেস্টুরেন্টে। তামাকির প্রিয় একটা খাবার খাওয়াতে। তার আগে আমরা পুতুল উৎসবে গিয়েছিলাম। ওদের পুতুল উৎসবের নাম কি জানিস?
-কী?
-হিনামাতসুরি। জানিস, রাজ্যের পুতুলে একাকার হয়ে যায় এলাকা, উৎসব প্রাঙ্গণ! দোকানে তাকালে মনে হয় জাপানি মেয়েরা সেজেগুজে পুতুল হয়ে বসে আছে!
-থাক, আর বলিস না মন খারাপ হচ্ছে। আচ্ছা নুজাই, তোকে যেই খাবার খাওয়াতে তামাকি নিয়ে গেলো সেই খাবার কী তেলাপোকা দিয়ে রান্না হয়েছিল?
-ওয়াক থু! তুই না একটা ...
-আচ্ছা বল।
-আমরা সুপার মার্কেটের ইয়া বড় একটা রেস্টুরেন্টে বসে খাবারের অপেক্ষা করছি। ভাবছি, না জানি কী খাবার আসে! একটু পর খাবার এলো। আইসক্রিমের মতো দেখতে। অথচ ঠিক আইসক্রিম নয়, জেলির মতো অনেকটা। খাবারে কোমল-নরম কী কী ভেসে বেড়াচ্ছে। সঙ্গে স্ট্রবেরি, কিউই ফলের টুকরো। কিছুটা চুইংগামের মতো। ছোট ডিসে সাজিয়ে দেওয়া হলো। নুসাইবা খাবার নাড়াচাড়া করছে। কীভাবে খাবে বুঝতে পারছে না।

তামাকি বলে, এই খাবারটির নাম হচ্ছে- নাতা দে কো কো।
-কী কো কো?
-নাতা দে কো কো
-ওমা, এ কেমন নামরে নুজাই!
-আনুশকা বলে, ও নুজাই, তুই আশার সময় এক ডিস নাতা দে কো কো নিয়ে আসিস।
-খাবারটা যা মজা হইছে না! জানিস, সেদিনের পর থেকে তো নুসাইবা প্রায়ই বায়না ধরে নাতা দে কো কো খেতে। বাবা কখনও প্লাস্টিক প্যাকেটে, কখনও টিনের আবার কখনও কাচের কৌটায় করে নাতা দে কো কো নিয়ে আসেন।
-আমাদের জন্যও এক কৌটা নাতা দে কো কো আনিস!
-আনব। উনাই, এবার বাংলা নববর্ষ আর আমার জন্মদিনের নতুন প্ল্যান করেছি।
-কী প্ল্যান?

-বৈশাখের প্রথম দিন তামাকি আসবে আমাদের বাসায়। বাংলায় জানাবে বৈশাখী আর জন্মদিনের শুভেচ্ছা। এ জন্য সে বাংলা শিখছে। সেদিন চাচ্চুর সঙ্গে তামাকির কথা বলিয়ে দিয়েছি স্কাইপিতে। চাচ্চু দেশ থেকে তামাকির সাইজের বৈশাখী জামা, চুড়ি, চুলের ফিতে সবই পাঠিয়েছেন। এই বৈশাখে তামাকিও সাজবে আমাদের মতো। অ্যাই উনাই ...
-বল
-জাপানিরা নববর্ষের শুভেচ্ছায় কী বলে, জানিস?
-না তো, বল।
-জাপানিদের নববর্ষ হয় জানুয়ারির প্রথম দিন। তারা নববর্ষের শুভেচ্ছা জানাতে বলে- সিননেন, আকেমাশতে ওমেদেতো গোজাইমাছ।
-কী মাছ?
-গোজাইমাছ। শোন না, এই বৈশাখে তামাকিকে পান্তা-ইলিশ খাওয়াব। তারপর ও-মিয়াগে দেব।
-ও-মিয়াগে  কী রে?
-ও-মিয়াগে মানে উপহার। তাকে উপহার কী দেব জানিস?
-কী দিবি?
-বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা আর একটা বাঘের মুখোশ। এগুলোও চাচ্চু পাঠিয়েছেন তামাকির জন্য।
-তোকে তো তোর চাচ্চু অনেক আদর করেন। পহেলা বৈশাখে তোর জন্মদিন হওয়ায় বৈশাখী নামেও ডাকেন!
-হু, ডাকে তো। চাচ্চুর জন্য, তোদের জন্য খুব মন খারাপ হয় রে।
-আমাদেরও! নুজাই, তোর চাচ্চু আর কী পাঠিয়েছে রে?
-আমাদের জন্যও বৈশাখী জামা পাঠিয়েছেন। চাচ্চু বললেন, তামাকির মতো দেশে তোদের দু’জনকেও বৈশাখে ও-মিয়াগে দেবে।
-তাই?
-কী দেবে রে?

-সে টা তো বলা যাবে না। সারপ্রাইজ! তোরা চাইলে চাচ্চুর সঙ্গে বৈশাখী মেলায় ঘুরে আসতে পারিস। আমরাও টোকিওর মিনাটোয় ঘুরবো। বৈশাখী মেলায় যাব। বিকেলে চেরি ফুল উৎসব দেখব।
-সে যা। এই বৈশাখে তোদের মিস করব রে!
-আমরাও ...

নুজাই কথাটা শেষ করার আগেই লাইন কেটে গেল। উনাইজা আর আনুশকা বলে, যাক জাপানেও ওরা পান্তা-ইলিশ খেতে পারবে। বৈশাখী মেলায় যেতে পারবে। একটু মন খারাপ থাকলেও এবারের বৈশাখটা সবার মতো আমাদেরও ভালো কাটবে!

বাংলাদেশ সময়: ১৫৫৪ ঘণ্টা, এপ্রিল ১২, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।