ঢাকা, সোমবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

আইন ও আদালত

‘আমরা উঠে যাচ্ছি’

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪১০ ঘণ্টা, মে ২৩, ২০১৭
‘আমরা উঠে যাচ্ছি’

ঢাকা: ‘এখন সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল ব্যবস্থা নেই, আইনও নেই। আইন না থাকলেও নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ হিসেবে রাষ্ট্রপতি একজন বিচারপতিকে অপসারণ করতে পারেন’।

ষোড়শ সংশোধনীর আপিল শুনানিতে আদালতের প্রশ্নের জবাবে মঙ্গলবার (২৩ মে) এ মন্তব্য করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম।

এরপর অ্যাটর্নি জেনারেলের প্রতি কয়েকটি প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে এজলাস ত্যাগ করেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ।

সংসদের মাধ্যমে বিচারপতিদের অপসারণে আনা সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলে হাইকোর্টের  রায়ের বিরুদ্ধে আপিল আবেদনের পক্ষে রাষ্ট্রপক্ষের যুক্তিতর্ক (আর্গুমেন্ট) উপস্থাপন চলছে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে সাত বিচারপতির আপিল বেঞ্চে।

মঙ্গলবার শুনানির পঞ্চম কার্যদিবসে রাষ্ট্রপক্ষে তৃতীয় দিনের মতো যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন অ্যাটর্নি জেনারেল। বুধবারও (২৪ মে ) আপিল মামলাটি কার্যতালিকার ১ নম্বরে রয়েছে।

পরে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘আমি বলেছিলাম, এ মামলায় হাইকোর্টের রায়ের একটি অংশে সংসদ সদস্যের ক্রিমিনাল রেকর্ডের কথা আছে। যদি এ বক্তব্য সঠিক না হয়, তাহলে ওনাকে রিমুভ (রায় প্রদানকারী বিচারপতিকে) করা উচিত’।

এরপর সাংবাদিকদের সঙ্গে আর কথা বলতে রাজি হননি তিনি।

তবে অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মুরাদ রেজা বলেছেন, ‘অ্যাটর্নি জেনারেল সঠিক কথা বলেছেন। এর আগে রাষ্ট্রপতি কয়েকজন বিচারককে অপসারণ করেছেন। যেমন বিচারপতি এস এম হোসেন ও বিচারপতি আব্দুর রহমানকে সামরিক সরকারের আমলে অপসারণ করা হয়েছে’।    

মঙ্গলবারের শুনানির শেষ পর্যায়ে এসে (বেলা একটার কিছুক্ষণ পরে) অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘হাইকোর্টের রায়ে একজন বিচারপতি সংসদ সদস্যদের ফৌজদারি অপরাধের রেকর্ড থাকার কথা বলেছেন। এ বক্তব্য সত্য না হলে তাকে অপসারণের জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানো উচিত’।

অ্যাটর্নি জেনারেলের এ বক্তব্যে ক্ষোভ প্রকাশ করে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা বলেন, ‘এটা কি বললেন? আইন না থাকলেও রাষ্ট্রপতি একজন বিচারপতিকে সরিয়ে দেবেন? কতো হাজার বছর পেছনে নিয়ে যাচ্ছেন? বিচার বিভাগকে কি মনে করছেন? আইন না থাকলেও রাষ্ট্রপতি কি একজন বিচারপতিকে অপসারণ করতে পারেন?’

জবাবে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘এখন সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল ব্যবস্থা নেই, আইনও নেই। আইন না থাকলেও নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ হিসেবে রাষ্ট্রপতি একজন বিচারপতিকে অপসারণ করতে পারেন’।

মাহবুবে আলম বলেন, ‘এটি আমার অভিমত। আপনারা বিষয়টি রায়ে বলে দিতে পারেন’।

প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আপনি কেন এ মন্তব্য করলেন? তাহলে জুডিশিয়ারির থাকলো কি?’

এরপর ‘আমরা উঠে যাচ্ছি’ বলে এজলাস ত্যাগ করেন প্রধান বিচারপতি। সঙ্গে সঙ্গে বাকি ছয় বিচারপতিও এজলাস ত্যাগ করেন।

এর আগে সকালে রাষ্ট্রপক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শুরু করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম।

শুনানির শুরুতে অ্যাটর্নি জেনারেলের উদ্দেশ্যে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘অধস্তন বিচার বিভাগ কব্জা করে নিয়ে নিচ্ছেন। এখন চাচ্ছেন, সুপ্রিম কোর্টকে নিয়ে নিতে। সুপ্রিম কোর্ট, অধস্তন আদালত পঙ্গু হয়ে গেছেন। একটি জেলায় ৫ মাস ধরে জেলা জজ নেই। বিচার বিভাগ কি রকম কার্যকর আছে? জেলা জজ না থাকলে বিচার বিভাগ কার্যকর হবে কি-না? উচ্চ আদালতের বিষয়টি সংসদে নিয়ে গেলেন। তাহলে আর কি থাকলো?’

সংবিধান সংশোধন প্রসঙ্গে তিনি অ্যাটর্নি জেনারেলকে বলেন, ‘আমেরিকার সংবিধান কতোবার টাচ হয়েছে জানেন?’

জবাবে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘বিচার বিভাগ তখনই অকার্যকর হয়ে পড়বে, যখন দেশে অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। কিন্তু এখনও সে পর্যায়ে নেই দেশ’।

তিনি বলেন, ‘আমেরিকার মূল সংবিধানের পরিবর্তন করা হয়নি, সংযুক্ত হয়েছে। বিচার বিভাগ বলতে পারেন না যে, মূল সংবিধানের এ ব্যবস্থা ঠিক না। শুধুমাত্র সংশোধনী সম্পর্কে বলতে পারেন’।

এক পর্যায়ে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলতো সামরিক আইন জারির মাধ্যমে হয়েছে। সে কলঙ্ক মুছে ফেলতেই ৯৬ অনুচ্ছেদের সংশোধন করা হয়েছে’।

প্রধান বিচাপরতি বলেন, ‘সামরিক আইনের কলঙ্ক মুছে ফেলতে একমাত্র বিচার বিভাগ ভূমিকা রেখেছেন’।

এ সময় অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মুরাদ রেজা বলেন, ‘একজন প্রধান বিচারপতিও শপথ ভঙ্গ করে সামরিক আইন প্রশাসক হয়েছিলেন। সংবিধান স্থগিত করেছিলেন’।

প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘ওই সময়তো অনেক কিছু হয়েছে’।

এক পর্যায়ে প্রধান বিচারপতি অ্যাটর্নি জেনারেলকে বলেন, ‘সংবিধানে ৭০ অনুচ্ছেদ রেখেছেন কেন?’

জবাবে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘এর একটি ইতিহাস আছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে হর্স ট্রেডিং হচ্ছে’।

প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘তাদের (সংসদ সদস্য) প্রতি আস্থা রাখতে পারছেন না? তাহলে বিচারকদের ক্ষেত্রে হর্স ট্রেডিং হবে না, তার নিশ্চয়তা কোথায়? সংসদ সদস্যরা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছেন কি-না? আপনারা নিজ দলের সদস্যদের ওপর আস্থা রাখতে পারছেন না কেন?’

এ মামলায় সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীদের রিট করার এখতিয়ার নিয়ে প্রশ্ন তুলে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘তাদের রিট করার এখতিয়ার নেই’।

এ সময় বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহ্‌হাব মিঞা বলেন, ‘এ যুক্তি ঠিক নয়। যারা এসেছেন, তারা পরিচিত আইনজীবী। তারা এ বারেরই (আইনজীবী সমিতি) সদস্য। বিচার বিভাগের মর্যাদা রক্ষার স্বার্থে তারা এটি করতে পারেন’।

প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘তারা এই সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী। তারা সচেতন নাগরিক। তাদের রিট করার এখতিয়ার আছে’।

তিনি বলেন, ‘আপনি বলছেন, তাদের এখতিয়ার নেই। তাহলে কি আমি প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিজে রিট করবো?’

এ সময় তিনি ভারতের বিচারক নিয়োগ সংক্রান্ত রায়ের উদাহরণ দিয়ে বলেন, ‘ওই মামলায় আবেদনকারী ছিলেন সেখানকার বার কাউন্সিলের চেয়ারম্যান’।

পরে রিট আবেদনকারীদের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ সাংবাদিকদের বলেন, ‘আদালতে শুনানির শেষ পর্যায়ে এ আলোচনা এসেছে। তখন আদালত বলেছেন, আমরা এখন উঠে যাবো। ওই আলোচনাটি এমন একটি পর্যায়ে গিয়েছিল, যেটি বিচার বিভাগের জন্য, আইনজীবীদের জন্য বা বিচারকদের জন্য, সকলের জন্য বিব্রতকর’।  

বাংলাদেশ সময়: ২০১০ ঘণ্টা, মে ২৩, ২০১৭
ইএস/এএসআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।