মঙ্গলবার (১৩ জুন) বিচারপতি শাহিনুর ইসলামের নেতৃত্বে দুই সদস্যের ট্রাইব্যুনালে সপ্তম সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণের পর তাকে আংশিক জেরা করেন আসামিপক্ষের রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবী গাজী এম এইচ তামিম।
ট্রাইব্যুনালে রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন প্রসিকিউটর রানা দাশগুপ্ত।
গত বছরের ০১ নভেম্বর পলাতক লিয়াকত-রজবের বিরুদ্ধে অভিযোগ (চার্জ) গঠন করেন ট্রাইব্যুনাল। ০৩ ডিসেম্বর থেকে রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীদের সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়।
একাত্তরে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নাসিরনগর থানার ফান্দাউক ইউনিয়ন রাজাকার কমান্ডার সে সময়কার মুসলিম লীগ নেতা মো. লিয়াকত আলী ও অষ্টগ্রাম থানার আলবদর কমান্ডার রজব আলীর বিরুদ্ধে হত্যা, গণহত্যা, আটক, অপহরণ, নির্যাতন, ধর্ষণ ও লুটপাটের সাতটি মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে লাখাইয়ের কৃষ্ণপুরে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ১২৭ জন এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ফান্দাউকে নিরীহ নারী-পুরুষকে হত্যা, ধর্ষণ ও লুটপাটের অভিযোগ।
তারা দু’জনে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাশাপাশি তিন থানা হবিগঞ্জ জেলার লাখাই, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর ও কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রামে এসব অপরাধ সংঘটিত করেন বলে অভিযোগ করা হয়েছে।
এ মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা মো. নূর হোসেন ২০১৪ সালের ০৫ নভেম্বর থেকে ২০১৫ সালের ২৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত তদন্তকাজ সম্পন্ন করেন। ওইদিন তাদের দু’জনের বিরুদ্ধে তদন্তের চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করেন ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা। ওইদিনই এ তদন্ত প্রতিবেদন ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশনের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এর ভিত্তিতে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) তৈরি করে ট্রাইব্যুনালে দাখিল করেন প্রসিকিউশন।
গত বছরের ১৮ মে লিয়াকত-রজবের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আমলে নিয়ে তাদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন ট্রাইব্যুনাল। তবে আসামিদের গ্রেফতার করা যায়নি।
গত বছরের ২৯ সেপ্টেম্বর অভিযোগ গঠনের শুনানি শেষ হয়।
১৯৭১ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজের ছাত্র ও মুসলিম লীগের নেতা লিয়াকত আলী ফান্দাউক ইউনিয়নে রাজাকার কমান্ডারের দায়িত্বে ছিলেন। স্বাধীনতার পর দীর্ঘদিন পালিয়ে ছিলেন তিনি। পরে এলাকায় ফিরে একসময় লাখাই উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও মুড়াকরি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানও হয়েছিলেন।
অন্যদিকে কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম থানার আলীনগর গ্রামের রজব আলী ভৈরব হাজী হাসমত আলী কলেজে একাদশ শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় ইসলামী ছাত্রসংঘের কলেজ শাখার সভাপতি ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় ভৈরবে পাকিস্তানি সেনা ক্যাম্পে অস্ত্র প্রশিক্ষণ নিয়ে রজব আলী এলাকায় আলবদর বাহিনী গঠন করেন। দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭২ সালে তার বিরুদ্ধে দালাল আইনে তিনটি মামলা হয় এবং ওইসব মামলার বিচারে তার যাবজ্জীবন সাজা হয়।
১৯৮১ সালে রজব ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুক্ত হন। এরপর তিনি ‘আমি আলবদর বলছি’ নামে একটি বই প্রকাশ করেন।
লিয়াকত-রজবের বিরুদ্ধে সাত অভিযোগ
লিয়াকত-রজবের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইনের ৩(১), ৪(১) ও ৪(২) ধারায় হত্যা, গণহত্যা, আটক, অপহরণ, নির্যাতন, ধর্ষণ ও লুটপাটের সাতটি মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছে।
প্রথম অভিযোগে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর ভোর ৫টা থেকে বেলা পৌনে দুইটা পর্যন্ত লিয়াকত আলী, আমিনুল ইসলাম (রজব আলী) ও তাদের সঙ্গী রাজাকাররা পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে নিয়ে লাখাই থানার কষ্ণপুর গ্রামে হামলা চালিয়ে গণহত্যা ও লুটপাট করেন। নৃপেণ রায়ের বাড়িতে রাধিকা মোহন রায় ও সুনীল শর্মাসহ ১৫ জন জ্ঞাত ও ২৮ জন অজ্ঞাত হিন্দুকে গুলি করে হত্যা করেন।
দ্বিতীয় অভিযোগে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর বেলা ২টা থেকে বেলা পৌনে ৩টা পর্যন্ত লিয়াকত আলী, আমিনুল ইসলাম (রজব আলী) ও তাদের সঙ্গী রাজাকাররা পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে নিয়ে চণ্ডিপুর গ্রামে চন্দ্র কুমার ও জয় কুমারসহ ৯ জন হিন্দু লোককে গুলি করে হত্যা এবং গ্রামের বিভিন্ন বাড়িতে লুটপাট করেন।
তৃতীয় অভিযোগে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর বেলা ৩টার দিকে লাখাই থানার গদাইনগর গ্রামে লিয়াকত আলী, আমিনুল ইসলাম (রজব আলী), রাজাকার ও পাকিস্তানি সেনারা চিত্ত রঞ্জন দাসের বাড়ির বাইরের আঙ্গিনায় জগদীশ দাস, পিয়ারি দাস ও মহাদেব দাসসহ ২৬ জন জ্ঞাত হিন্দুকে হত্যা করেন। অজ্ঞাত আরও ৭/৮ জন আহত হয়ে বেঁচে যান।
চতুর্থ অভিযোগে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর লিয়াকত আলী, আমিনুল ইসলাম (রজব আলী) ও রাজাকাররা পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে নিয়ে কৃষ্ণপুর এলাকায় হামলা চালান। এ সময় হরিদাস রায় ও ক্ষিতিশ রায়সহ ১০ জন হিন্দু লোককে অপহরণ করে অষ্টগ্রাম থানার সদানগর গ্রামের শ্মশানঘাটে এনে রাত ১০টার দিকে পাকিস্তানি সেনারা তাদেরকে হত্যার উদ্দেশ্যে গুলি ও বেয়নেট চার্জ করে। এতে ঘটনাস্থলে ৮ জন মারা যান এবং ২ জন আহত হয়ে বেঁচে যান।
পঞ্চম অভিযোগে বলা হয়েছে, লিয়াকত আলী, আমিনুল ইসলাম (রজব আলী) ও তার সঙ্গী রাজাকাররা ১৯৭১ সালের ভাদ্র মাসের প্রথম সপ্তাহে যেকোনো দিন সকাল দশটার দিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নাসিরনগর থানার ফান্দাউক বাজার থেকে রঙ্গু মিয়া ও বাচ্চু মিয়াকে অপহরণ করে নিয়ে রাজাকার ক্যাম্পে টর্চার সেলে নিয়ে নির্যাতন করেন। পরের দিন বেলা ১২টার দিকে রঙ্গু মিয়াকে নাসিরনগর থানার ডাকবাংলোর পাশে দত্তবাড়ির খালে হত্যা করে মরদেহ পানিতে ফেলে দেন। অপহৃত বাচ্চু মিয়া অর্থের বিনিময়ে রাজাকারদের হাত থেকে মুক্তি পান।
ষষ্ঠ অভিযোগে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালের ৭ নভেম্বর বেলা আনুমানিক ১২টার দিকে লিয়াকত আলী ও আমিনুল ইসলাম (রজব আলী) রাজাকার ও পাকিস্তানি সেনাদের নিয়ে অষ্টগ্রাম থানার সাবিয়ানগর গ্রামে চৌধুরী বাড়ির উত্তর পাশে খালি জায়গায় ইশা খাঁ ও আরজু ভূঁইয়াসহ ৫ জনকে গুলি করে হত্যা করেন।
সপ্তম অভিযোগে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালের ৭ নভেম্বর বেলা আনুমানিক ১২টা থেকে সাড়ে ১২টার দিকে লিয়াকত আলী ও আমিনুল ইসলাম (রজব আলী) রাজাকার ও পাকিস্তানি সেনাদের নিয়ে অষ্টগ্রাম থানার সাবিয়ানগর গ্রামে খাঁ বাড়িতে হামলা চালিয়ে মনির খাঁ ও সফর আলীসহ আওয়ামী লীগ ও স্বাধীনতাকামী ১০ জনকে গুলি করে হত্যা করেন। ওই সময় রাজাকাররা বাড়িতে লুটপাট করে।
বাংলাদেশ সময়: ২১৪৫ ঘণ্টা, জুন ১৩, ২০১৭
ইএস/এএসআর