মঙ্গলবার (১২ মার্চ) ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. মজিবুর রহমানের আদালতে সাক্ষ্যগ্রহণের দিন ধার্য ছিলো। রাষ্ট্রপক্ষের বিশেষ পাবলিক প্রসিকিউটর জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য ৩ জন সাক্ষীর হাজিরা দাখিল করেন আদালতে।
মামলার পলাতক আসামি মামুনুর রশিদ ওরফে রিপনকে গত ১৯ জানুয়ারি গ্রেফতার করে র্যাব। তাকে মঙ্গলবার আদালতে হাজির না করায় ২১ মার্চ নতুন দিন ধার্য করা হয়।
মামলায় মোট সাক্ষী ২১১ জন। মামলাটিতে এখন পর্যন্ত ২০ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়েছে।
গত ৬ ফেব্রুযারি ঢাকার সন্ত্রাস বিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. মজিবুর রহমানের আদালতে নিহত এসি রবিউল ইসলামের ছোটভাই শামসুজ্জামান ও খালাতো ভাই আনোয়ার হোসেন এবং রেস্তোরাঁর ক্রেতা নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির সাবেক শিক্ষক হাসনাত রেজা করিমের স্ত্রী শারমিনা পারভীনের সাক্ষ্যগ্রহণ হয়।
২০১৬ সালের ১ জুলাই ওই রেস্তোরাঁয় হামলার পর অভিযান চালাতে গিয়ে নিহত হন ডিএমপির তৎকালীন এসি রবিউল।
আদালতে শারমিনা পারভীন বলেন, “২০১৬ সালের ১ জুলাই রাত ৮টার দিকে আমার স্বামী হাসনাত করিমসহ ছেলে ও মেয়েকে নিয়ে ওই হোটেলে (রেস্তোরাঁ) যাই। মেয়ের জন্মদিন উপলক্ষে আমরা সেখানে ডিনার করতে গিয়েছিলাম। হোটেলে ঢুকে সেখানকার হল রুমের টেবিলে বসে অপেক্ষা করতে থাকি। মেন্যু দেখে খাবারের জন্য অর্ডার দিই।
এর ৩/৪ মিনিট পরেই দেখি- তিন/চারজন অস্ত্রসহ কাঁধে ব্যাগ নিয়ে হোটেলে প্রবেশ করে। প্রবেশ করা মাত্রই তারা গুলি করতে থাকে। এরপর আমাদের টেবিলের কাছে এসে জিজ্ঞাসা করে- আপনারা মুসলিম? আমরা মুসলিম জানালে তারা বলে, আপনাদের কোনো ক্ষতি করবো না। আপনারা মাথা নিচু করে টেবিলে বসে থাকুন। ”
মামলার চার্জশিট থেকে বাদ যাওয়া হাসনাত করিমের স্ত্রী বলেন, “ওই হোটেলের কাঁচের গ্লাস ঘেরা রুমে আনুমানিক ৮/১০ জন বা তার বেশি ফরেনার/বিদেশি বসে ছিলেন। কাচের গ্লাস ঘেরা রুমে ঢুকে তারা গুলি করতে শুরু করে। তখন আমাদের বলতে থাকে, আপনাদের ছেলে-মেয়েদের চোখ-কান বন্ধ করে রাখুন যেন তারা কোনো কিছু দেখতে বা শুনতে না পায়। তারা দেখে ভয় পেতে পারে। তখন আমি আমার ছেলে-মেয়ের চোখ-মুখ বন্ধ করে রেখেছিলাম। ”
“ওই ঘটনার কিছুসময় পরই তারা একটি ছেলে ও একটি কম বয়সী মেয়েসহ ৪ জনকে আমাদের টেবিলের কাছে নিয়ে আসে। তখন বারান্দার একটা লাইট ছাড়া সব লাইট বন্ধ করে দেওয়া হয়। রাত দেড়টার দিকে একজন ওয়েটার এবং একজন ফরেনারকে বের করে নিয়ে আসে তারা। ওয়েটারকে সরিয়ে দিয়ে ফরেনারকে গুলি করে। এরপর আমাদের আশ-পাশে পড়ে থাকা মৃতদেহগুলোকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কোপাতে থাকে। ”
শারমিনা পারভীন বলেন, “তখন ছিলো রমজান মাস। তাই সেহেরির সময় তারা আমাদের খাওয়ার ব্যবস্থা করে। কিন্তু সেই সময় খাবার খাওয়ার মতো পরিস্থিতি ছিলো না। এরপরও সামান্য কিছু খাবার খেয়ে সেহেরি শেষ করি। ভোরের দিকে আমার স্বামী এবং আরেকটি ছেলে তাহমিদকে ছাদে নিয়ে যায় তারা। এর কিছু সময় আবার তাদের একই টেবিলে নিয়ে এসে বসায়। আমার স্বামীকে চাবি দিয়ে বাইরের গেটের তালা খুলে আসতে বলে। তালা খুলে আসার পর বলে- আপনারা একজন একজন করে বের হয়ে যান। বের হয়ে আসার আগে মোবাইলসহ যা যা নিয়েছিল তা ফেরত দেয়। বের হওয়ার পরপরই আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী আমাদের নিরাপদে নিয়ে যায়। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী আমাদের ডিবি অফিসে নিয়ে যায়। জিজ্ঞাসাবাদের পর আমাদের ছেড়ে দেওয়া হয়। ”
এর আগে গত ২৯ জানুয়ারি হলি আর্টিজান বেকারির হিসাবরক্ষক আরিফ হোসেন সাক্ষ্য দেন। রাজধানী ঢাকার অভিজাত এলাকা গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটে ২০১৬ সালের ১ জুলাই।
বিশ্বজুড়ে আলোড়ন তৈরি করা ওই ঘটনায় জঙ্গিরা সেই রাতে ২০ জনকে হত্যা করে; যাদের ৯ জন ইতালি, ৭ জন জাপান, ৩ জন বাংলাদেশ এবং একজন ভারতের নাগরিক।
এছাড়া সন্ত্রাসীদের হামলায় দুজন পুলিশ সদস্যও প্রাণ হারান। পরে সেনাবাহিনীর কমান্ডো অভিযানে হামলাকারী পাঁচজনও নিহত হয়। ঘটনাস্থল থেকে আরও একজনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়; যাকে পরবর্তীতে হলি আর্টিজানের কর্মচারী হিসেবে শনাক্ত করা হয়।
এ মামলার আসামিরা হলেন— হামলার মূল সমন্বয়ক বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কানাডার নাগরিক তামিম চৌধুরীর সহযোগী আসলাম হোসেন ওরফে রাশেদ ওরফে আবু জাররা, ঘটনায় অস্ত্র ও বিস্ফোরক সরবরাহকারী নব্য জেএমবি নেতা হাদিসুর রহমান সাগর, নব্য জেএমবির অস্ত্র ও বিস্ফোরক শাখার প্রধান মিজানুর রহমান ওরফে বড় মিজান, জঙ্গি রাকিবুল হাসান রিগ্যান, জাহাঙ্গীর আলম ওরফে রাজীব ওরফে রাজীব গান্ধী, হামলার অন্যতম পরিকল্পনাকারী আব্দুস সবুর খান (হাসান) ওরফে সোহেল মাহফুজ, শরিফুল ইসলাম ও মামুনুর রশিদ।
আসামিদের মধ্যে প্রথম ছয়জন কারাগারে; দুইজন পলাতক। মঙ্গলবার কারাগারে থাকা ৬ আসামিকে আদালতে হাজির করা হয়।
গত বছরের ২৩ জুলাই আদালতে চার্জশিট দেয় পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট। তবে আলোচিত হলেও ওই ঘটনায় জড়িত থাকার তথ্য-প্রমাণ না পাওয়ায় নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির সাবেক শিক্ষক হাসনাত রেজা করিমকে চার্জশিট থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
২০১৮ সালের ৮ আগস্ট আট আসামির বিরুদ্ধে আদালত চার্জশিট গ্রহণ করার পর ২৬ নভেম্বর এ মামলার বিচার কাজ শুরু হয়।
এদিকে সম্প্রতি এ মামলার পলাতক আসামি মামুনুর রশিদ ওরফে রিপনকে গত ১৯ জানুয়ারি রাতে গাজীপুরের বোর্ডবাজারের একটি বাস থেকে গ্রেফতার করে র্যাব। আর শরিফুল ইসলাম ওরফে আব্দুস সবুর খান ওরফে হাসান ওরফে সোহেল মাহফুজ ওরফে খালেদকে ২৫ জানুয়ারি চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার নাচোল থেকে গ্রেফতার করা হয়।
বাংলাদেশ সময়: ২০৫০, মার্চ ১২, ২০১৯
এমএআর/এমজেএফ