ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

আইন ও আদালত

বিচারের কাঠগড়ায় যখন সাবেক প্রধান বিচারপতি!

খাদেমুল ইসলাম, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০০৫০ ঘণ্টা, অক্টোবর ৫, ২০২১
বিচারের কাঠগড়ায় যখন সাবেক প্রধান বিচারপতি!

ঢাকা: এক সময় বিচার বিভাগের প্রধান কর্তাব্যক্তি ছিলেন। তিনিই এখন বিচারের কাঠড়ায়।

বাংলাদেশের সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার (এসকে) সিনহার বিরুদ্ধে ব্যাংক ঋণের মাধ্যমে প্রায় চার কোটি টাকা আত্মসাৎ ও মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগে রায় হতে যাচ্ছে মঙ্গলবার (০৫ অক্টোবর)। এভাবে কোনো সাবেক প্রধান বিচারপতির বিচার হওয়ার ঘটনা দেশের ইতিহাসে নজিরবিহীন বলছেন সংশ্লিষ্টরা।

দেশের একুশতম প্রধান বিচারপতি হিসেবে ২০১৫ সালের ১৭ জানুয়ারি দায়িত্ব গ্রহণ করেন এসকে সিনহা। দুই বছর ৯ মাস ২৪ দিন দায়িত্ব পালনের পর ২০১৭ সালের ১১ নভেম্বর ছুটিতে বিদেশে থাকা অবস্থায় দায়িত্ব থেকে পদত্যাগ করেন তিনি।

এসকে সিনহার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক দুর্নীতির অভিযোগ আপিল বিভাগের অন্য বিচারপতিদের কাছে একই বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর উপস্থাপন করা হয়। পরদিন সিনহার সঙ্গে বৈঠকের পর আপিল বিভাগের সতীর্থ বিচাপতিগণ তার সঙ্গে একত্রে দায়িত্ব পালনে অস্বীকৃতি জানান। ২০১৭ সালের ২ অক্টোবর তিনি এক মাসের ছুটিতে যান। এরপর ১৩ অক্টোবর থেকে ১০ নভেম্বর পর্যন্ত বিদেশে থাকার অনুমতি নিয়ে দেশ ছাড়েন তিনি। ছুটি শেষে দেশে ফেরার ঘোষণা দিলেও ১১ নভেম্বর সিঙ্গাপুর দূতাবাসের মাধ্যমে তিনি রাষ্ট্রপতি বরাবর পদত্যাগপত্র পাঠান।

পদত্যাগের এক বছর আট মাস পর ২০১৯ সালের ১০ জুলাই ক্ষমতার অপব্যবহার করে ফারমার্স ব্যাংক (বর্তমানে পদ্মা ব্যাংক) থেকে ভুয়া ঋণের মাধ্যমে চার কোটি টাকা স্থানান্তর ও আত্মসাৎ করার অভিযোগে দুদকের পরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেন বাদী হয়ে মামলা করেন। পাঁচ মাসেরও কম সময়ের মধ্যে সেই মামলায় আদালতে চার্জশিট দাখিল করা হয়।

২০২০ সালের ১৩ আগস্ট বিচার শুরু হয়। এক বছর এক মাসে বিচার প্রক্রিয়া শেষে রায়ের জন্য ৫ অক্টোবর দিন ধার্য করা হয়।

একজন সাবেক প্রধান বিচারপতির বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোকে দুর্ভাগ্যজনক বললেও এতে আইনের শাসনের দৃষ্টান্ত দেখছেন দুদক কৌঁসুলি মীর আহমেদ আলী সালাম।

তিনি বাংলানিউজকে বলেন, একজন প্রধান বিচারপতির ফৌজদারি অপরাধে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়ানোর ঘটনা এর আগে কখনো ঘটেনি। এমনকি সুপ্রিম কোর্টের কোনো বিচারপতির এভাবে বিচার হওয়ার ঘটনাও আমার জানা নেই। তবে প্রধান বিচারপতি ছিলেন বলেই অপরাধ করে পার পেয়ে যাবেন, তা হয় না। অপরাধী যতো বড় প্রভাবশালীই হোক না কেন তাকে বিচারের মুখোমুখি হতে হবে, এই মামলায় তাই প্রমাণিত হলো।

এই মামলায় আইন অনুযায়ী সিনহাসহ আসামিদের সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের শাস্তিই হবে বলে প্রত্যাশা দুদকের এই কৌঁসুলির।  

এই মামলায় সাবেক প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা শুরু থেকেই পলাতক থাকায় আদালতে তার পক্ষে আইনজীবী নিযুক্তির সুযোগ ছিল না। তবে দুই আসামি ফারমার্স ব্যাংকের অডিট কমিটির সাবেক চেয়ারম্যান মো. মাহবুবুল হক চিশতী (বাবুল চিশতী) ও ভাইস প্রেসিডেন্ট মো. লুৎফুল হকের পক্ষে মামলায় আইনজীবী ছিলেন শাহিনুর ইসলাম। তিনি এসকে সিনহার বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

এসকে সিনহাসহ এ মামলায় মোট আসামি ১১ জন। এর মধ্যে ফারমার্স ব্যাংকের অডিট কমিটির সাবেক চেয়ারম্যান মো. মাহবুবুল হক চিশতী (বাবুল চিশতী) কারাগারে। একই ব্যাংকের সাবেক এমডি এ কে এম শামীম, ফার্স্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট স্বপন কুমার রায়, ভাইস প্রেসিডেন্ট মো. লুৎফুল হক, সাবেক এসইভিপি গাজী সালাহউদ্দিন, টাঙ্গাইলের বাসিন্দা মো. শাহজাহান এবং একই এলাকার বাসিন্দা নিরঞ্জন চন্দ্র সাহা জামিনে রয়েছেন।  

অপরদিকে, এসকে সিনহা, ফারমার্স ব্যাংকের ফার্স্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট সাফিউদ্দিন আসকারী, রণজিৎ চন্দ্র সাহা ও তার স্ত্রী সান্ত্রী রায় পলাতক।

আসামিদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ৪০৯/৪২০/১০৯ ধারা ও ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারা এবং ২০১২ সালের মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের ৪(২)(৩) ধারায় অভিযোগ গঠন করা হয়। যার মধ্যে সরকারি কর্মচারী হিসেবে ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে অপরাধমূলক বিশ্বাসভঙ্গ করার সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। এছাড়া মানি লন্ডারিং আইনের ৪(৩) ধারায় সর্বোচ্চ ১২ বছর, সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে অপরাধের জন্য দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারায় সাত বছর ও দণ্ডবিধির ৪২০ ধারায় প্রতারণার অভিযোগে সাত বছর কারাদণ্ডের শাস্তির বিধান রয়েছে।

মামলার বিবরণে বলা হয়েছে, ২০১৬ সালের ৬ নভেম্বর আসামি শাহজাহান ও নিরঞ্জন চন্দ্র ফারমার্স ব্যাংকের গুলশান শাখায় দুটি অ্যাকাউন্ট খুলে দুই কোটি টাকা করে মোট চার কোটি টাকা ঋণের আবেদন করেন। তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট এবং ঋণের আবেদনে উত্তরার ১০ নম্বর সেক্টরের ১২ নম্বর রোডের ৫১ নম্বর বাড়ির ঠিকানা ব্যবহার করা হয়, যার মালিক ছিলেন তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা।

জামানত হিসেবে আসামি রনজিৎ চন্দ্রের স্ত্রী সান্ত্রী রায়ের নামে সাভারের ৩২ শতাংশ জমির কথা উল্লেখ করা হয় ঋণের আবেদনে। ওই দম্পতি এস কে সিনহার পূর্ব পরিচিত ও ঘনিষ্ঠ বলে উল্লেখ করা হয়েছে মামলার এজাহারে। দুদক বলছে, ব্যাংকটির তৎকালীন এমডি এ কে এম শামীম কোনো ধরনের যাচাই-বাছাই ছাড়াই, ব্যাংকের নিয়ম-নীতি না মেনে, ক্ষমতার অপব্যবহার করে ঋণ দুটি অনুমোদন করেন।

ওই বছরের ৭ নভেম্বর ঋণের আবেদন হওয়ার পর ‘অস্বাভাবিক দ্রুততার’ সঙ্গে তা অনুমোদন করা হয়। পরদিন মোট চার কোটি টাকার দুটি পে-অর্ডার ইস্যু করা হয় এস কে সিনহার নামে। এরপর ৯ নভেম্বর সোনালী ব্যাংকের সুপ্রিম কোর্ট শাখায় এস কে সিনহার অ্যাকাউন্টে জমা হয়।

পরে বিভিন্ন সময়ে ক্যাশ, চেক ও পে-অর্ডারের মাধ্যমে ওই টাকা উত্তোলন করা হয়। এর মধ্যে এস কে সিনহার ভাইয়ের নামে শাহজালাল ব্যাংকের উত্তরা শাখার অ্যাকাউন্টে দুটি চেকে দুই কোটি ২৩ লাখ ৫৯ হাজার টাকা স্থানান্তর করা হয় ওই বছরের ২৮ নভেম্বর।

মামলা তদন্ত করে ২০১৯ সালের ৯ ডিসেম্বর চার্জশিট দাখিল করেন দুদক পরিচালক বেনজীর আহমেদ। ২০২০ সালের ১৩ আগস্ট একই আদালত ১১ আসামির বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন। চলতি বছর ২৪ আগস্ট মামলাটির সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হয়। মামলায় ২১ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করেন আদালত। দুদক ও আসামিপক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে গত ১৪ সেপ্টেম্বর এই মামলায় রায়ের জন্য ৫ অক্টোবর দিন ধার্য করা হয়।

>>এসকে সিনহার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড চায় দুদক

বাংলাদেশ সময়: ০০৪৬ ঘণ্টা, অক্টোবর ০৫, ২০২১
কেআই/এনটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।