সঞ্জীব চৌধুরী, সাংবাদিক ও সঙ্গীতশিল্পী। তবে তার পরিচয় শুধু সাংবাদিক-গায়ক-সুরকার-গীতিকার হিসেবেই সীমিত ছিল না।
সঞ্জীব চৌধুরী জন্মেছিলেন ১৯৬২ সালের ২৫ ডিসেম্বর। তার গ্রামের বাড়ি হবিগঞ্জের বানিয়াচং। বাবা ননী গোপাল চৌধুরী এবং মা প্রভাষিনী চৌধুরীর নয় সন্তানের মধ্যে সঞ্জীবের অবস্থান ছিল সপ্তমে।
হবিগঞ্জ সরকারী উচ্চবিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণীতে ভর্তি হয়ে পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণীতে তিনি বৃত্তি পান। নবম শ্রেণীতে এসে ভর্তি হন ঢাকার বক্শী বাজার নবকুমার ইন্সটিটিউটে। সেখান থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়ে মেধা তালিকায় ১২তম স্থান লাভ করেন। ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশ নিয়েও স্থান করে নেন মেধা তালিকায়। ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে। প্রথম বিভাগে প্রথম হয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি শেষ করেন। `৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে ছিল তার সক্রিয় অংশগ্রহণ। সে সময় প্রগতিশীল ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে জড়িত সঞ্জীব চৌধুরী গলায় হারমোনিয়াম ঝুলিয়ে তাৎক্ষণিক গান লিখে সুর দিতেন আর দলবল নিয়ে রাজপথ কাঁপাতেন কোরাস গান গেয়ে।
ফিচার সাংবাদিকতার ধারা বদলে দেওয়া সঞ্জীব চৌধুরীর সাংবাদিকতা শুরু সাপ্তাহিক উত্তরণ পত্রিকা দিয়ে। এরপর দৈনিক আজকের কাগজ হয়ে দৈনিক ভোরের কাগজে। এক সময়ের তুমুল জনপ্রিয় এই দৈনিকটিতে সূচনালগ্ন থেকে সম্পৃক্ত হয়ে জীবনের দীর্ঘ একটা সময় পার করে দেন। পাঠক ফোরাম গঠনের আইডিয়াটা প্রথম তার মাথা থেকেই আসে। তার সেই আইডিয়া থেকেই আজ দেশের জনপ্রিয় দৈনিকগুলোতে রয়েছে পাঠকদের সংগঠন। এরপর দৈনিক যায়যায়দিন বাজারে আসার প্রস্তুতি নিলে ফিচার এডিটর হিসেবে যোগ দেন সেখানে । সাংবাদিকতার পাশাপাশি সঙ্গীতেও তিনি মেধার পরিচয় রেখে গেছেন। পারিবারিকভাবেই ছোটবেলায় সঙ্গীতচর্চায় হাতেখড়ি হয়েছিল তার। গান গাওয়ার পাশাপাশি নিজেই গান লিখতেন, সুরও দিতেন। সঙ্গীতজ্ঞ বারীণ মজুমদারের ছেলে বাপ্পা মজুমদারকে সঙ্গে নিয়ে ১৯৯৩ সালে গঠন করেন ব্যান্ডদল দলছুট। দলছুটের অন্যতম ভোকাল সঞ্জীব চৌধুরী বাউল সম্রাট আব্দুল করিমের ‘গাড়ি চলে না’ গানটি গেয়ে জয় করে সমগ্র দেশ। ‘সাদা ময়লা রঙিলা পালে আউলা বাতাস খেলে’, ‘তোমার বাড়ির রঙের মেলায়’, ‘আগুনের কথা বন্ধুকে বলি’, ‘আমাকে অন্ধ করে দিয়েছিল চাঁদ’, ‘আমি তোমাকেই বলে দেব’, ‘রিক্সা কেন আস্তে চলে না’সহ বহু মনমাতানো গানের সুরস্রষ্টা তিনি।
২০০৭ সালের ১৯ নভেম্বর সঞ্জীব চৌধুরীর আকস্মিক মৃত্যুতে স্তম্ভিত হয়ে যায় গোটা দেশের সংস্কৃতি অঙ্গন। বেঁচে ছিলেন মাত্র ৪৪ বছর। বেঁচে থাকা অবস্থায় হয়তো তিনি ধারণাও করতে পারেননি তার এই জনপ্রিয়তা। মৃত্যুকালে সঞ্জীব চৌধুরী স্ত্রী আলেমা নাসরীন শিল্পী (প্রজ্ঞা নাসরীন) আর তিন বছরের একমাত্র কন্যা কিংবদন্তিকে রেখে যান। কিংবদন্তির এখন ছয় বছর, এখনো সে বিশ্বাস করে কোনো এক মধ্যরাতে ঘুম থেকে টেনে তুলে বাবা তাকে গান শোনাবে। এখনো মধ্যরাতে এফএম রেডিওতে তার সেই হৃদয়ছোঁয়া গান বেজে উঠলে কাঁপন জাগায় হাজারও বোহেমিয়ান অন্তরে ‘আমি তোমাকেই বলে দেব ... ছুঁয়ে কান্নার রঙ ছুঁয়ে জোছনার ছায়া’।
বাংলাদেশ স্থানীয় সময় ১৮৩০, ডিসেম্বর ২৪, ২০১০