[পপসম্রাট ও মুক্তিযোদ্ধা আজম খান ১৪ জুলাই বুধবার বেলা ১টায় উন্নত চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরের উদ্দেশে রওনা হবেন। মুখগহ্বরের ক্যান্সারে আক্রান্ত এই শিল্পীকে মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে ভর্তি করানো হবে।
আমি এমন এক বাবার ঘরে জন্ম নিয়েছি, যিনি সারা বিশ্বের বাঙালির কাছে একজন বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব। আমি তার সন্তান এটা ভাবতেই ভীষণ গর্ববোধ করি। কারণ বাংলা পপ গানের জনক, কিংবদন্তি এবং মুক্তিযোদ্ধা শ্রদ্ধেয় আজম খান। তার স্বপ্ন একটি আধুনিক, উন্নত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ দেখবেন। যেখানে এ দেশের সব মানুষ শান্তিতে বসবাস করবেন এবং বিশ্বের অন্যান্য দেশের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারবেন। বাংলাদেশ হবে একটি স্বর্গরাজ্য। অথচ দুর্ভাগ্য, আমার সেই বাবা আজ ক্যান্সারের মতো জীবনবিনাশী রোগে আক্রান্ত।
তাকে বাঁচিয়ে রেখে এ স্বপ্ন পূরণ করতে মিডিয়ার যারা সবার প্রথমে এগিয়ে এসেছেন তারা হলেন ফরিদুর রেজা সাগর (চ্যানেল আই), মাহফুজুর রহমান (এটিএন বাংলা), এনায়েতুর রহমান বাপ্পি (এনটিভি), মতিউর রহমান (প্রথম আলো), আইয়ুব বাচ্চু (এলআরবি), কুমার বিশ্বজিৎ (মিউজিক অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ), মনিরুল আলম টিপু (কার্নিভাল), হামিন আহমেদ টোকন (বাম্বা), সুমন (অর্থহীন), ঢাকার মেয়র সাদেক হোসেন খোকাসহ অনেকে।
সহযোগিতায় এগিয়ে এসেছেন বাংলালিংক, স্কয়ার, বাংলাভিশন, বৈশাখী টেলিভিশন, ট্রান্সকম গ্রুপ, এনভয় গ্রুপ, তামির গ্রুপ, অরিয়ন গ্রুপ প্রভৃতি প্রতিষ্ঠান। অশেষ আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই এরশাদুল হক টিংকু, মতিন, ডা. সজল আশফাক, ডা প্রাণগোপাল দত্ত ও ডা. কামরুজ্জামানকে যারা তার জীবনকে বাঁচিয়ে রাখার যুদ্ধে আমাদের আন্তরিকভাবে সঙ্গ দিয়েছেন। পরম করুণাময়ের কাছে নিবেদন, যেন তিনি সর্বদা তাদের সহায় হোন।
সাধারণত একটি নতুন বিষয় জাতির মাঝে কতটুকু গ্রহণযোগ্যতা পাবে তা নির্ভর করে জনগণের চিন্তাধারা, রুচিশীলতা এবং গ্রহণ করার মানসিকতার ওপর। নতুন একটা কিছু করতে গেলে তা নিয়ে শুরু হয় নানা রকম আলোচনা-সমালোচনা। এেেত্র সকল প্রকার সমালোচনা উপো করে আজম খান পপসঙ্গীতের সুর ধরে গেয়ে গেছেন গান, যাকে সাদরে বরণ করে নিয়েছিলেন এ দেশের জনগণ। কারণ তখন জনগণের তাগিদা ছিল যুদ্ধের ধকলে ধসে পড়া বাংলাদেশকে কীভাবে শক্তিশালী করা যায় আর তার কোন কোন েেত্র প্রয়োজনীয় উপাদানের জোগান দিয়ে পুনর্গঠন করা যায় সে বিষয়ে। তিনি অনন্য, কারণ তার অতি ুদ্র সাধ্য থেকে তিনি ভীষণ ত্যাগ, বিসর্জন আর অর্জনের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতিকে দিয়েছেন আন্তর্জাতিক পর্যায়ের সঙ্গীত সাধনের সফল সোপান। একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবেও তিনি দেশের কৃতী সন্তান।
মূলত তিনি সঙ্গীতপ্রেমিক। এছাড়া খেলাধুলা ও সিনেমা দেখার ঝোঁক শৈশব থেকেই। আধুনিক বাংলা গান, ভারতীয় বাংলা গান ছাড়াও বিশেষভাবে ভক্ত ছিলেন ইংরেজি পপসঙ্গীতের। পপসঙ্গীতের প্রতি ভক্তি এবং আপন চর্চা তার মধ্যে গড়ে তোলে এক বিস্ফোরক প্রতিভা। নিজস্ব আড্ডামহলে তার বিনোদনের মূল বিষয় হয়ে উঠেছিল পপসঙ্গীত । তারুণ্যের উদ্দীপনায় সৃষ্টি হতে থাকে ‘আলাল ও দুলাল’, ‘ওরে সালেকা ওরে মলেকা’, ‘হাইকোর্টের মাজারে’, ‘এত সুন্দর দুনিয়া’-র মতো একের পর এক বাংলা পপসঙ্গীত। এমনকি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেবার পর অবসর মূহূর্তেও মানসিক স্পৃহা জোগাতে যুদ্ধক্যাম্পে বসে গান ধরতেন তিনি। তার সাথে সুর মিলিয়ে ঘটি-বাটিতে চামচ বাজিয়ে গান ধরতেন ক্যাম্পের অন্য মুক্তিযোদ্ধারাও। উচ্চরবে গাইতেন সবাই ‘হে মহামানব একবার এসো ফিরে এ গ্রামবাংলার ভীড়ে’, ‘মানবো না মানবো না বন্ধনে মানবো না মানবো না শৃঙ্খলে’, ‘ধনেধান্য পুষ্পে ভরা আমাদের এ বসুন্ধরা’সহ প্রভৃতি গান।
মানুষের ভালোলাগা, সমর্থন আর তার নিজস্ব সাধনার ফলেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে আজকের বাংলা পপসঙ্গীত। তার জনপ্রিয়তা আন্তর্জাতিক পর্যায়ের, কারণ তিনি একজন দুর্দান্ত ও পারদর্শী গায়ক। এজন্যই বিপুল ভক্তের ভক্তিতে তিনি ‘গুরু’ নামে আখ্যায়িত। আর ব্যক্তিগতভাবে তিনি আমার জীবনেরও সকল বিষয়ের মূল শিাগুরু।
বাবা দিনের সব কাজই নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সম্পন্ন করতে ভালোবাসেন। কারো সাথে দ্বন্দ্ব-বিবাদে যাবার অবকাশ নেই তার। নির্ভেজাল, ছিমছাম, নিরিবিলি, স্বাধীন জীবনযাপনে বিশ্বাসী তিনি। কায়িক পরিশ্রম, সততা আর নিষ্ঠার জীবনে সর্বদাই ভেবেছেন মানবকল্যাণের কথা। আত্মিক দিক থেকে অত্যন্ত শক্তিশালী, সরল মনের, অল্পভাষী, সঙ্গীতমনা আমার বাবা মানবধর্মে বিশ্বাসী। তার দৃষ্টিতে নারী-পুরুষ সব েেত্র সমান সুযোগ-সুবিধা আর অধিকার পাওয়ার যোগ্য। আমি তার কন্যা হয়ে কখনো অনুভব করতে পারিনি যে তিনি আমাকে আমার ছোট ভাইয়ের তুলনায় কখনো কোনও দিক থেকে কম অধিকার বা সুযোগ-সুবিধা দিয়েছেন। আর এজন্যও আমি তাকে শ্রদ্ধা জানাই।
পপসম্রাট আজম খানকে মিডিয়ার মাধ্যমে জনগণ দেখেছেন একজন মুক্তিযোদ্ধা, একজন শিল্পী, একজন অভিনেতা, একজন মডেল, এমনকি উপস্থাপক হিসেবে। কিন্তু ব্যক্তিগত আজম খানকে দেখেছেন তার পরিবারের মানুষরা। তার পরিবারের একজন সদস্য এবং তার বড় সন্তান হিসেবে আমি তাকে আখ্যায়িত করি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বাবা হিসেবে। ব্রোকেন ফ্যমিলির বাবা হয়ে সংসার এবং সন্তানদের সব দায়দায়িত্ব তিনি নিজে সামাল দেবার পরও সংসারের আয়-রোজগার করার বিষয়েও সক্রিয় থেকেছেন ভীষণভাবে, যদিও তার নিজস্ব কোনও চাকরি বা ব্যবসা নেই। মূলত তিনি জনদরদী আর তাই দুস্থ মানুষকে যথাসাধ্য সহযোগিতা করেছেন আন্তরিকভাবে। এলাকার অনেক দরিদ্র পরিবারের সন্তানকে লেখাপড়ার খরচ দিয়েছেন মেট্রিক-ইন্টার পর্যন্ত। সহযোগিতা করেছেন বিয়েশাদির মতো নানা প্রয়োজনের মুহূর্তে। বিভিন্ন মসজিদ-মাজারেও অনেককিছু দান করেন মাঝেমধ্যেই। শুক্রবার মসজিদে জুমার নামাজ পড়তে যান। আর মাঝে মাঝে নিয়ে আসেন মিলাদের মিষ্টি বা মাজারের তবারক, যা আমাদের কাছে ছোটবেলা থেকেই একটা আকর্ষণীয় বিষয়। বাবা আমাদের খেলার সাথী, পড়ার সাথী, গানের সাথী, জীবনযুদ্ধের সাথী। সেই বাবাকে আমরা হারাতে চাই না।
আমার বাবার বিষয়ে অল্প বলে শেষ করা সম্ভব নয়। আমার এ লেখার উদ্দেশ্য এই নয় যে, আমি আমার বাবাকে অতি উঁচুতে তোলার চেষ্টা করছি, বরং আমি মনে করি আমার বাবার সম্পর্কে জেনে পাঠকের মনে কিছু ভাবনার সৃষ্টি হবে, অনেকে ব্যতিক্রমী কিছু করতে উৎসাহ পাবেন, যাতে উপকৃত হতে পারেন অনেকেই। আর আমার বাবা জানবেন তার সন্তানরা তাকে কতটা ভালোবাসেন।
বাবার স্বাস্থ্যের মঙ্গল কামনা করি। দেশ-বিদেশের সব মানুষের কাছে বাবার জন্য দোয়া প্রার্থনা করি। আল্লাহ সবার সহায় হোক।
বাংলাদেশ স্থানীয় সময় ১৪৪০, জুলাই ১২, ২০১০
লাইফস্টাইল
আমার স্বপ্নবান বাবা আজম খান: ইমা খান
| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।