দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান হতে যাচ্ছে, রাত ১০টা, ২৭ জনের একটা দল, যখন প্রান্তিক গেইট থেকে শ্যামলী বাসে করে স্বপ্নযাত্রা শুরু হবে। সকাল থেকেই তাইবুল স্যার ও কনভেনার ইমন আমাকে বলছেন, ফোন করে সবার উৎকণ্ঠা ভুলিয়ে উৎসাহটাকে ধরে রাখো।
আসলে ট্যুরের আগে সবাইকেই অনেক বাধা অতিক্রম করতে হয়েছে, তাই শেষ মুহূর্তে এসে যেন কোনো উৎকন্ঠা কাজ না করে, সেরকম একটা চেষ্টা করছিলাম। রাত সাড়ে ১০টায় সবাই উপস্থিত। আমাদের বিদায় জানাতে আসেন আতিক স্যার, জসিম স্যার, লিটু স্যার ও সুলতানা ম্যাডাম।
বাসে পরদিন দুপুর তিনটায় কলকাতার পুষ্পক হোটেলে পৌঁছলাম। সবাই দ্রুত ফ্রেশ হয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে রাত নয়টায় স্লিপিং ট্রেনে করে ২২ ঘণ্টার দীর্ঘ ভ্রমণের জন্য প্রস্তুত হলাম। শিয়ালদহ স্টেশন থেকে যাত্রা শুরু করলাম আগ্রার উদ্দেশ্যে।
ট্রেনে ভারতীয়দের সঙ্গে শিল্প, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে তাদের সহযোগিতা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে গল্প করতে করতে দুপুর পার হয়ে গেলো। রাত আটটায় আগ্রার রশ্মি হোটেলে পৌঁছলাম। যাত্রাপথে কলকাতা, বিহার, ঝাড়খণ্ড হয়ে উত্তর প্রদেশের এই পশ্চিম প্রান্তে এসেছি। লক্ষ্য করলাম, আমাদের দেশের মতো নদীনালা এ দেশে নেই, ধূসর প্রান্তর, ফাঁকা মাঠ, অনাবাদী জমি আর পুরো ঝাড়খণ্ড জুড়ে টিলা ও পাহাড়।
তাজমহল! সিনেমা, নাটক, বইয়ের পাতা আর প্রেমিক-প্রেমিকার অন্তরে যার ছবি লালিত হয়, তার মাত্র তিনশ’ মিটার দূরে রশ্মি হোটেলে আমরা। নিজ চোখে শাহজাহানের ভালবাসার নিদর্শন তাজমহলকে দেখার জন্য আমাদের তাড়াতাড়ি ঘুমাতে হলো। কারণ পরদিন প্রথম প্রহরে তাজমহল দেখবো। যদিও রাতের আঁধারে হোটেলের ছাদ থেকে অনেকেই তাজমহলকে দেখেছে, তবুও পুরো টিমে একটা উত্তেজনা কাজ করছিল।
ভোর হতেই আমাদের মতো বহু দর্শনার্থী ছুটে চলছে তাজমহলের দিকে। টিকিট কেটে বিশাল অর্ধগম্বুজ গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকতেই দূর থেকে নিজ চোখে প্রথমবারের মতো তাজমহল দেখতে পেলাম। লাফ-ঝাঁপ করে, কোথাও দাঁড়িয়ে, কোথাও বসে ছবি তুললাম সেখানে। ভেতরে মমতাজের সমাধি দেখার পর সব উৎসাহের অবসান হলো, বারবার মনে হতে লাগলো এটা কেবল একটা সমাধি সৌধ, আর শাহজাহানের স্বপ্ন বাস্তবে রূপ দেওয়ার জন্য মমতাজের অকাল মৃত্যু জরুরি ছিল। কারণ তাজমহলে শাহজাহানের শোক প্রকাশ পায় নি, বরং তার আনন্দ রূপ ধারণ করেছে।
তাজমহল দেখা শেষে আমরা আকবরের আগ্রা ফোর্টে গেলাম, যেখানে বন্দী থাকার সময় শাহজাহান প্রিয় মানুষটির কথা স্মরণ করে তাজমহলের দিকে চেয়ে থেকে চোখের জল ফেলতেন। এরপর ফতেহপুর সিক্রিতে এসে দেখলাম দিল্লির সঙ্গে যোগাযোগের জন্য তৈরি সুড়ঙ্গ, আকবরের ঘুমানোর স্থান, আকবরের স্ত্রী যোধাবাঈয়ের শীত ও গ্রীষ্মকালীন পৃথক থাকার ভবন ইত্যাদি। সারাদিনের গরম বাতাস ও তাপদাহের ক্লান্তিকর অবস্থা থেকে নিমিষে প্রাণ ফিরে পেলাম, যখন আকবরের তৈরি শীতল বাতাস তৈরির দেয়ালের কাছে গিয়ে বসলাম।
বিকেল পাঁচটায় ট্যুরিস্ট বাসে করে রওনা হলাম রাজস্থানের উদ্দেশ্যে। রাত নয়টায় বিশাল পাহাড়ের মধ্য দিয়ে প্রায় এক কিলোমিটার একটা টানেল পার হয়ে জয়পুর শহরে প্রবেশ করলাম। প্রবেশ করতেই দেখি হলি উৎসব আর গানের আওয়াজে কাঁপছে পুরো শহর। ছেলে-বুড়ো সবাই একে অপরের গায়ে রংয়ের গুঁড়া ছিটিয়ে সে কি আনন্দ!
পদ্মিনী হোটেলে পৌঁছে সবাই চরম ক্লান্ত, তাই খাওয়া-দাওয়া শেষ করেই ঘুম। পরদিন সকালে রওনা হলাম আজমীর শরীফের উদ্দেশ্যে। সেখানে পৌঁছে একটু অবাক হলাম। আজমীর শরীফ যেন এক ভিন্ন ধর্মীয় জগত, দূরদুরান্ত হতে প্রায় সব ধর্মের লোকজন আসছে এখানে একটু কৃপা লাভের আশায়। আজমীর শরীফ জিয়ারত শেষ করে চলে এলাম জয়পুর, উঁচু পাথরের পাহাড়ে রাজা মানসিংয়ের আমের ফোর্ট দেখলাম। তারপর দেখলাম রাস্তার ধারে বিশাল লেকের মধ্যে জলমহল, লেকের পাশে উঁচু পাহাড়। রাতে দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম সিনেমা হল রাজমন্দিরে সদ্য মুক্তি পাওয়া ছবি ‘রংরাজ’ উপভোগ করলাম।
পরদিন দুপুর বারোটায় রওনা হবো শিমলার উদ্দেশ্যে। প্রথমে ট্যুরিস্ট বাসে করে দিল্লিতে পৌঁছলাম সন্ধ্যা সাতটায়। কালকা মেইলে করে রাতে রওনা হলাম হরিয়ানা রাজ্যের কালকার উদ্দেশ্যে। সকালে কালকা পৌঁছে সেখান থেকে শিমলার উদ্দেশ্যে টয় ট্রেনে উঠলাম। টয় ট্রেনটি পাহাড়ের ভেতর ১০৩টি টানেলের মধ্য দিয়ে ৯৫ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে, বেশ কয়েকটি বিরতি দিয়ে শিমলায় পৌঁছালো বিকেলে। এরই মধ্যে পাহাড়ের সঙ্গে মেঘের মিলন আর ক্ষণে ক্ষণে রোদ-বৃষ্টি, কখনও বজ্রপাত দেখার মধ্য দিয়ে অপূর্ব হিমাচল প্রদেশ উপভোগ করলাম।
শিমলার হোটেল হরি প্যালেসে পৌঁছে ফ্রেশ হয়ে বের হলাম, প্রচন্ড ঠাণ্ডা, হালকা বাতাস আর সন্ধ্যায় শিমলা শহরের অদ্ভূত এক অনুভূতি পাচ্ছিলাম। পাহাড়ের মাঝে এমন এক বিচিত্র শহর যার নিচে, উপরে, ডানে, বাঁয়ে যতো দূর চোখ যায় বাড়িঘরের তারার মতো জ্বলজ্বলে আলো। আর যখন মেঘ কেটে রাতের আকাশে তারা দেখা গেল, তখন মনে হলো যেন তারার সমুদ্রে হাবুডুবু খাচ্ছি।
একটু মন খারাপ সকালেই ছেড়ে যেতে হচ্ছে শিমলাকে, নতুন গন্তব্য শিমলা থেকে ২৭৪ কিলোমিটার উত্তরে বরফের দেশ মানালি। টাটা সুমোতে করে আবার সেই মেঘ, পাহাড় আর বরফের মধ্য দিয়ে ভ্রমণ, পাহাড় কেটে তৈরি রাস্তা আর রাস্তার অন্যপাশে অনেক নিচে বরফ গলা নদী। বিলাশপুর জুস গার্ডেনে দুপুরের খাবার খেলাম।
সন্ধ্যায় মানালির হোটেল হিনায় পৌঁছলাম। পরদিন সকালে সবাই টাটা সুমোতে করে চললাম সোলাং ভ্যালিতে, বরফের পোশাক পরে ছুটলাম বরফের পাহাড়ে, পাহাড় চূড়ায় উঠে সবার সমস্বরে চিৎকার।
সকালে যাত্রা শুরু হলো দিল্লির উদ্দেশ্যে, সন্ধ্যায় কালকায় পৌঁছলাম, কালকা থেকে রাতের ট্রেনে করে সকালে পৌঁছলাম দিল্লির হোটেল ডি গোল্ডে। পুরো দিন পার হলো শুধু বিশ্রামে, সন্ধ্যায় কয়েকজন মিলে মেট্রো রেলে করে রাতের দিল্লি দেখলাম।
পরদিন সকালে রাজঘাটে গান্ধীর সমাধি দিয়ে শুরু হয় দিল্লি দর্শন, এরপর একে একে ইন্ডিয়া গেট, ইন্দিরা গান্ধী মেমোরিয়াল, কুতুব মিনার, নিজাম উদ্দিন আউলিয়ার মাজার, করিম হোটেলে দুপুরের খাবার খাওয়া, লোটাস টেম্পল, হুমায়ুন টুম্ব দেখতে দেখতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। এরপর দিল্লি ছাড়ার পালা।
রাত আটটার দিকে দুরন্ত এক্সপ্রেসে সাড়ে ১৪শ’ কিলোমিটার দূরে কলকাতার শিয়ালদহের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু হল। পরদিন দুপুর দু’টায় কলকাতার পুষ্পক হোটেলে এসে পৌঁছলাম, বিকালে কলকাতার ভিক্টোরিয়া ও সাইনস্ সিটি আর রাতে শেষবারের মতো কেনাকাটা করে হোটেলে ফিরলাম। পরদিন সকালে দেশে ফেরার পালা, সকাল সাড়ে আটটায় কলকাতা থেকে শ্যামলী বাসে করে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম।
দিন শেষে রাত দশটায় প্রান্তিক গেইটে এসে পৌঁছালো ২৭ জনের সার্ক ট্যুর টিম। শেষ হলো একটি সফল, সুন্দর ও চমৎকার ভ্রমণ।
সম্পাদনা: হাসান শাহরিয়ার হৃদয়, নিউজরুম এডিটর