ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

লন্ডন

যুক্তরাজ্যে ভোটের বড় লড়াইয়ে সামিল টিউলিপ

নিউজ ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬১৪ ঘণ্টা, এপ্রিল ৭, ২০১৫
যুক্তরাজ্যে ভোটের বড় লড়াইয়ে সামিল টিউলিপ

ঢাকা: আসছে ৭ মে যুক্তরাজ্যের সংসদ নির্বাচনে অন্যসব প্রার্থীর মতো ভাগ্য নির্ধারিত হবে টিউলিপ সিদ্দিকেরও। যুক্তরাজ্যে তার নিজস্ব রাজনৈতিক পরিচয় ও যোগ্যতা দিয়েই এগুচ্ছেন।



তবে এর পাশাপাশি তার সবচেয়ে বড় পরিচয়, তিনি বাংলাদেশের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাতনী।

৪০ বছর আগে, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনকের ধানমন্ডি-৩২ এর বাড়িটাতে ঘাতকরা যখন হামলা চালায়, তখন জার্মানিতে সফরে থাকায় ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান তার দুই মেয়ে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। বাংলাদেশ থেকে বঙ্গবন্ধুকে সমূলে উৎপাটনে খুনীরা সেদিন শিশু রাসেলকেও ছাড় দেয়নি। এই দুই জনও সেদিন সেবাড়িতে থাকলে ঘাতকের নির্মম শিকারেই পরিণত হতেন। কিন্তু প্রতিবন্ধকতা পার করে এই পরিবারের সদস্যরা ক্রমেই তাদের পথ চলা আরও সুদৃঢ় করছেন।

১৫ আগস্ট কালো রাতের ঘটনার পর বঙ্গবন্ধুর দুই মেয়ে দুই পথ বেছে নেন। শেখ হাসিনা জাতির জনকের আদর্শকে সমুন্নত করতে ও বাবার অসমাপ্ত কাজ সম্পূর্ণ করতে দেশে ফিরে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী। অন্যদিকে, বঙ্গবন্ধুর অপর মেয়ে শেখ রেহানা লন্ডনে নীরব জীবনযাপনের পথ বেছে নেন। সেখানে তিনি বিয়ে করে স্থায়ী হন। তারই মেয়ে এই টিউলিপ সিদ্দিক। টিউলিপের বাবাও একজন বাংলাদেশি। স্ট্রোকে কর্মক্ষমতা হারানোর আগে শিক্ষকতা ছিলো তার পেশা। ১৯৮২ সালে শেখ রেহানার কোল জুড়ে আসেন টিউলিপ। এই টিউলিপই এখন যুক্তরাজ্যের হ্যাম্পস্টিড ও কিলবার্নের ভবিষ্যৎ লেবার পার্টি প্রার্থী। তিন ভাইবোনের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়। বর্তমানে টিউলিপ তার স্বামী ক্রিস্টিয়ান পার্সির সঙ্গে পশ্চিম হ্যাম্পস্টিডে বাস করছেন।

সম্প্রতি হ্যাম্পস্টিড ও কিলবার্নে অংশ নেওয়া সকল নির্বাচনী প্রার্থীকে একটি অনুষ্ঠানে এক মঞ্চে তোলা হয়। সেখানে নির্বাচনী ও জাতীয় বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে আলোচনাও হয়। ওই অনুষ্ঠানে প্রতিটি প্রার্থী নিজের পরিচয় তুলে ধরতে তিন মিনিট করে সময় পান। নিজের পরিচয় তুলে ধরার সময় টিউলিপ জানান, লন্ডনে জন্ম নেওয়ার পর পাঁচ বছর বয়সে তিনি ব্রুনেই চলে যান। সেখানে তার বাবা একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতেন। তারপর তিনি বড় ধরণের একটি স্ট্রোকে কর্মক্ষমতা হারানোর পাশাপাশি বাকশক্তিও হারান। তাকে এখন হুইল চেয়ারে চলাফেরা করতে হয়। এরপর টিউলিপের পরিবার সিঙ্গাপুর চলে যায় বাবার চিকিৎসার জন্য। সেখান থেকে লন্ডনে ফেরার পর পারিবারিক রাজনৈতিক ইতিহাস থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ১৬ বছর বয়সে তিনি লেবার পার্টিতে যোগ দেন। এরপর তিনি ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডন থেকে ইংরেজিতে স্নাতক ও কিংস কলেজ লন্ডন থেকে রাজনীতিতে স্নাতোকত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর তিনি অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালে ও রোলস রয়েসের একটি প্রতিষ্ঠানে সামাজিক প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেন।

তবে ওয়েস্টমিনস্টারের দৌড়ে ৩২ বছর বয়সী টিউলিপ সিদ্দিকের লড়তে হবে কঠোর লড়াই। ২০১০ সালের নির্বাচনে হ্যাম্পস্টিড ও কিলবার্নের আসনে ১৭ হাজার তিনশ’ ৩২ ভোট পেয়ে বিজয়ী হয়েছিলেন বর্তমান লেবার পার্টির সাংসদ গ্লেনডা জ্যাকসন। প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ যুক্তরাজ্যের ওই নির্বাচনে গ্লেনডার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বি কনজারভেটিভ পার্টির প্রার্থী মাত্র ৪২ ভোট কম পেয়েছিলেন। অন্যদিকে, লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী আটশ’ ৪১ ভোট কম পেয়ে তৃতীয় অবস্থানে ছিলেন। এবার অবসরে যাচ্ছেন গ্লেনডা। তার জায়গায় লেবার পার্টির প্রার্থী হয়েছেন টিউলিপ সিদ্দিক।

এদিকে, টিউলিপের শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বি হিসেবে এরই মধ্যে নিজেকে চিনিয়ে ফেলেছেন সাবেক কনজারভেটিভ কাউন্সিলর ও রাগবি ক্যাপ্টেন সিমন মার্কস। অন্যদিকে, লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির পক্ষ থেকে আছেন মাজিদ নেওয়াজ। ইসলামিক এই বিপ্লবী সন্ত্রাস-বিরোধী অবস্থানের জন্য বেশ জনপ্রিয়। কাজেই নির্বাচনে জয় পেতে টিউলিপকে বেশ ঘাম ঝরাতে হবে বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা। এছাড়া রয়েছেন আরো কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ প্রতিদ্বন্দ্বি।

তবে নির্বাচন পূর্ববর্তী ভবিষ্যদ্বাণীগুলো টিউলিপ সিদ্দিকের পক্ষেই কথা বলছে। তাই বলে হাত গুটিয়ে বসে নেই তিনি। জয় নিশ্চিত করতে তিনি কোনো সুযোগই হাতছাড়া করছেন না, যা বৃহত্তর রাজনৈতিক গতিশীলতার প্রতিচ্ছবি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

নির্বাচনের বিষয়ে যুক্তরাজ্যভিত্তিক ইন্ডিপেন্ডেন্টকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে টিউলিপ বলেন, লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির ভোটগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে আমার কাছে চলে আসবে বলে মনে করছেন অনেকে। কিন্তু আমি এতটা আত্মতুষ্টিতে ভুগছি না।

পারিবারিক সংগ্রামের কথা তুলে ধরতে খালা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কথাও ওই সাক্ষাৎকারে বলেন টিউলিপ সিদ্দিক। তিনি বলেন ১৯টি হত্যা চেষ্টা থেকে বেঁচে গেছেন তার খালা। মা রেহানার কথা বলতে গিয়ে বলেন, তিনি সবসময়ই আমাদের নিয়ে শঙ্কিত থাকেন। ৪০ বছর আগে পরিবার হারানোর ভয় এখনো তাকে তাড়া করে। প্রতিটা মুহূর্তে আমি কোথায় ও কি অবস্থায় রয়েছি, তাকে পরিষ্কারভাবে জানাতে হয়। তিনি মোটেই আমার রাজনীতিতে আসার বিষয়টা পছন্দ করেননি। কারণ রাজনীতিই তার জীবনের বড় একটা অংশ ধ্বংস করে দিয়েছে। যুক্তরাজ্যের রাজনীতি দেশের মতো না, এটা তাকে বোঝাতে আমার অনেক সময় লেগেছে। এখানে কেউ এসে তোমাকে হত্যা করছে, তা অত্যন্ত বিরল ঘটনা।

এর আগে ২০১০ সালের নির্বাচনের পর টিউলিপ ক্যামডেন কাউন্সিলের ক্যাবিনেট সদস্যের দায়িত্ব পালন করেন। সেসময় তিনি তার রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি প্রকাশ করেননি বলেই জানান। কিন্তু ২০১৩ সালে সংসদ সদস্য নির্বাচনের প্রার্থীতা ঘোষণার পরই তাকে নিয়ে আলোচনা শুরু হয় জানিয়ে টিউলিপ বলেন, এরপর থেকেই মানুষ আমার পটভূমি নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি শুরু করলো।

১৯৭৫ সালে জাতির জনক সপরিবারে খুন হওয়ার ছয় বছর পর টিউলিপের খালা বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশে ফিরে প্রধান দুই দলের অন্যতম আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব নিজ হাতে তুলে নেন। এর আগে ১৯৭৭ সালে জেনারেলে জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে দ্বিতীয় রাজতৈনিক দল ‘বাংলাদেশ জাতিয়তাবাদী দল (বিএনপি)’ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৮১ সালে জেনারেল জিয়াউর রহমান খুন হওয়ার পর তার স্ত্রী খালেদা জিয়া দলটির নেতৃত্বে আসেন। এরপর ১৯৯১ সাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া বিভিন্ন সময় সরকারের ক্ষমতায় থেকে রাষ্ট্র পরিচালনা করে আসছেন।
টিউলিপ বলেন, আমি যখন এ-লেভেলে পড়ি, তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন আমাদের পুরো পরিবারকে হোয়াইট হাউজে আমন্ত্রণ জানালেন। তবে আমার জীবনে সবচেয়ে স্মরণীয় ঘটনা নেলসেন মেন্ডেলার বাংলাদেশ ভ্রমণ। আমার বয়স তখন ১২ বছর। আমরা তার সঙ্গে রাতের খাবার খেয়েছি। আমার কাছে মনে হচ্ছিল, কোনো সুপারহিরোর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে। ওই সাক্ষাৎ অত্যন্ত প্রেরণাদায়ক ছিল আমার জন্য।

তবে লন্ডনেও বাংলাদেশের রাজনৈতিক মেরুকরণের শিকার টিউলিপ। সেখানে অবস্থানরত বিএনপি-জামায়াতের অনুগতরা বিভিন্নভাবে তার নির্বাচনী দৌড়কে কঠিন করে তোলার চেষ্টা করছেন অভিযোগ করে টিউলিপ সংবাদপত্রটিকে জানান, তাকে বিতর্কিত করতে ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে রাশিয়ান প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও বাংলাদেশ প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তোলা একটা ছবি ছড়িয়ে পড়েছে তার নির্বাচনী এলাকায়। রাশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের শত কোটি ডলারের অস্ত্রচুক্তির সময় তোলা হয় ছবিটি। এতে দুই নেতার মধ্যে দাঁড়িয়ে ছিলেন টিউলিপ।

টিউলিপ বলেন, খালার সঙ্গে আমার খুব একটা দেখা হয় না। রাশিয়া অবস্থানকালে তিনি আমাকে আর আমার বোনকে সেখানে যেতে বলেছিলেন শুধুমাত্র দেখা করতে। আমরা দাপ্তরিক লোকজন থেকে সম্পূর্ণ আলাদা ছিলাম। খালা আমাদেরকে পারিবারিকভাবে আমন্ত্রণ করেছিলেন। এমনকি আমি জানতামও না, পুতিন সেখানে যাবেন। তবে সেখানে হাজির হওয়ার পর পুতিনই ছবিটি তোলার আগ্রহ প্রকাশ করেন। শুধুমাত্র দুই সেকেন্ডের জন্য আমরা পাশাপাশি দাঁড়িয়েছিলাম। কিন্তু বিষয় সংশ্লিষ্ট না হওয়া সত্ত্বেও কেন মানুষ এটা নিয়ে এতো ঘাঁটাঘাঁটি করছে, বুঝতে পারছি না।

তবে বাংলাদেশের রাজনীতি তার পথচলায় কোনো প্রভাব ফেলতে পারবে না, এমনকি নিজ পরিবারের ছায়া থেকে বেরিয়ে তিনি ওয়েস্টমিনস্টারে দলের প্রতিনিধিত্ব করবেন বলে বদ্ধপরিকর টিউলিপ সিদ্দিক।

২০১০ এর নির্বাচন প্রসঙ্গে ইন্ডিপেন্ডেন্টকে টিউলিপ বলেন, সবাই বলেছে, ডেভিড জয় পেতে চলেছে। সেই সঙ্গে তার প্রতি প্রতিশ্রুতিশীল যুবসমাজের আকৃষ্ট হওয়াও স্বাভাবিক।

তবে টিউলিপ ২০০৪ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে ইরাক যুদ্ধের বিরুদ্ধে পদযাত্রার আয়াজন করেন। সেই সঙ্গে সেসময় তিনি ইরাক ইস্যুতে যুক্তরাজ্যের অবস্থানে ছিলেন বিরক্ত। সব মিলিয়ে তিনি এড মিলিব্যান্ডের নেতৃত্বেই সামনে অগ্রসর হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন বলে এসময় তিনি জানান।

টিউলিপ বলেন, এই সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে জীবনের লক্ষ্যের চেয়ে মূল্যবোধটাই বেশি ভূমিকা রেখেছিল।

সিদ্দিকের হয়ে নির্বাচনী প্রচারণায় এরই মধ্যে দু’বার হ্যাম্পস্টিড ও কিলবার্ন সফল করেছেন এড মিলিব্যান্ড। এদিকে, সিদ্দিকের সমর্থনে আরো কাজ করছেন এমা থম্পসন, মেলভিন ব্র্যাগ, জেডি স্মিথ ও রবার্ট ওয়েবের মতো স্থানীয় জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব। সেই সঙ্গে গত সপ্তাহে অভিনেতা রিচার্ড উইলসন টিউলিপের প্রচারণায় অংশ নিয়েছেন। তিনি তার সঙ্গে ছবিও তুলেছেন, যার ব্যানারে লেখা রয়েছে, হ্যাম্পস্টিড সমাজতান্ত্রিক হয়ে আমি গর্বিত।

টিউলিপ বলেন, আমি রাজনীতির চেহারা বদলে দিতে লেবার পার্টিতে যোগ দেইনি। আমি যোগ দিয়েছি, কারণ দলটি আমার মূল্যবোধের কথা বলে।

বাংলাদেশ সময়: ১৫০০ ঘণ্টা, এপ্রিল ০৭, ২০১৫
আরএইচ/এমএমকে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

লন্ডন এর সর্বশেষ