লালমনিরহাট: সগৌরবে ৭৫ বছরে পা রাখছে খ্রিষ্টান মিশনারী পরিচালিত লালমনিরহাট শহরের ঐতিহ্যবাহী চার্চ অভ্ গড উচ্চ বিদ্যালয়। প্রতিষ্ঠার ৭৫ বছর পূর্তিতে ব্যাপক আয়োজন করেছেন বর্তমান ও প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা।
বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা জানান, লালমনিরহাট শহরের প্রাণ কেন্দ্রে খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীদের উপাসনালয় (চার্চ) অবস্থিত। যার কারণে শহরের প্রাণ কেন্দ্রটি মিশন মোড় নামেই পরিচিত। রাজনৈতিক, সামাজিক যে কোনো কর্মসূচিই পালিত হয় এই মিশন মোড়কে ঘিরে।
ভারত বিভাজনের পর শিক্ষা-দীক্ষায় পিছিয়ে ছিলো লালমনিরহাট। দরিদ্রতা আর সুযোগের অভাবে শিক্ষা বঞ্চিত ছিলো এলাকার শিশুরা। অবহেলিত এ অঞ্চলে শিক্ষার আলো পৌঁছে দিতে, সেই চার্চের পাশেই ১৯৪৬ সালে এলাকার দারিদ্র-পীড়িত পরিবারের অনাথ শিশুদের শিক্ষার ব্যবস্থা করতে মিশন স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন খ্রিষ্টান মিশনারীরা।
যেখানে অনাথ ও দারিদ্র শিশুদের জন্য পড়ালেখার খরচসহ দুপুরের খাবারের ব্যবস্থাও করেন তারা। প্রতিষ্ঠাকালীন প্রধান শিক্ষক ছিলেন সুখময় সমাদর। শুরুর দিকে প্রথম শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠদান হতো সম্পূর্ণ মিশনারীদের খরচেই।
এ বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় প্রধান শিক্ষক বীরেন্দ্র কুমার বাঢ়ৈ ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পক্ষে কথা বলা এবং সমাজকে আলোকিত করার কারণে পাকিস্তানি সেনাদের হাতে নির্মমভাবে শহীদ হন। সেদিক থেকে মহান মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক এই মিশন স্কুলের ইতিহাসও গৌরবের।
শিক্ষার উন্নতিকল্পে ১৯৭৫ সালে মিশন স্কুলটি প্রাথমিক পর্যায় থেকে জুনিয়র বিদ্যালয় হিসেবে উন্নীত হয়। শিক্ষার মান ও পরিবেশের কারণে সবার নজর কাড়ে বিদ্যালয়টি। পরবর্তীতে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের প্রয়োজন অনুধাবন করে ১৯৮৫ সালে উচ্চ বিদ্যালয়ের দুয়ার খুলে যায়। নামকরণ করা হয় চার্চ অভ্ গড উচ্চ বিদ্যালয় হিসেবে।
কাগজে-কলমে এই নাম থাকলেও স্থানীয়দের কাছে এটি মিশন স্কুল নামেই বেশি পরিচিত। ১৯৮২ সালে স্কুলটি এমপিওভুক্ত হলে পরিচালনা ব্যয় কিছুটা কমিয়ে দেয় মিশনারীরা। ১৯৮৭ সালে প্রথম এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেয় এ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। পরে ২০২১ সালে উচ্চ বিদ্যালয় হিসেবে এমপিও ভুক্ত হয়।
সগৌরবে সেই মিশন স্কুল ৭৫ বছরে পদার্পণ করতে চলছে। দীর্ঘ এ পথ পরিক্রমায় এ প্রতিষ্ঠানের অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী আজ দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে মিশন স্কুলের সুনাম বাড়িয়ে দিচ্ছেন।
বর্তমান সরকারের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম এমপি এ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী ছিলেন। এছাড়াও অসংখ্য অধ্যাপক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী ও শিক্ষকসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদ অলংকৃত করেছেন এ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা।
প্রতিষ্ঠানটিতে বর্তমানে প্রথম থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত ৪২৯ জন শিক্ষার্থীর পাঠদানে শিক্ষক রয়েছেন মাত্র ১৭ জন। যার মধ্যে এমপিও ভুক্ত হয়েছেন ১০ জন। বাকীরা মিশনারী ও টিউশন ফি’র অর্থ থেকে পাচ্ছেন সম্মানী ভাতা। তবে প্রাথমিক বিভাগেও অতিরিক্ত শ্রম দিতে হয় বিদ্যালয়টির সব শিক্ষককে।
মিশনারীদের দান করা ১.৩১ একর জমিতে বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত। এ বিদ্যালয়ে ৫টি একাডেমিক ভবন গড়ে উঠেছে। রয়েছে একটি বিজ্ঞানাগার। তথ্য প্রযুক্তির উন্নয়নে নিজস্ব অর্থায়নে ল্যাব করা হলেও সেখানে নেই প্রজেক্টর ছাড়া কিছুই। কম্পিউটার ল্যাবের চাহিদা পাঠানো হলেও তা আলোর মুখ দেখেনি আজও। নৈতিক শিক্ষাকে গুরুত্ব দিয়েই পাঠদান চলে এ বিদ্যালয়ে। এবারের এসএসসি পরীক্ষায় পাসের হার ৮০ শতাংশ।
এদিকে, প্রতিষ্ঠার ৭৫ বছর পূর্তি উৎযাপনে ১৭ ও ১৮ ডিসেম্বর দুই দিনব্যাপী ব্যাপক কর্মসূচি নিয়েছে বিদ্যালয়টির প্রাক্তন ও বর্তমান শিক্ষার্থীরা। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন বিদ্যালয়টির প্রাক্তন শিক্ষার্থী পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম এমপি।
৭৫ বছর পূর্তির অনুষ্ঠান সফল করতে বর্ণিল সাজে সাজানো হচ্ছে বিদ্যালয়টির তোরণ, মাঠসহ পুরো এলাকা। বর্তমান ও প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের লেখা নিয়েও প্রকাশিত হতে যাচ্ছে স্মরণিকা। পুরো আয়োজন সফল করতে বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সঙ্গে নিয়ে প্রাক্তন ও বর্তমান শিক্ষার্থীদের দিয়ে করা হয়েছে বেশকয়েকটি কমিটি ও উপ-কমিটি।
এ বিষয়ে চার্চ অভ্ গড উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সহিদার রহমান বলেন, ঐতিহাসিক এ বিদ্যালয়টি ৭৫ বছরে পদার্পণ করতে যাচ্ছে। আমরা পাঠ্যপুস্তকের পাশাপাশি নৈতিক শিক্ষাকেও গুরুত্ব দিয়ে আসছি। শিক্ষক সংকট থাকলেও অতিরিক্ত শ্রমে পাঠদান স্বাভাবিক রেখেছি। ৫টি শূন্যপদ পূরণে কর্তৃপক্ষকে অবগত করা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, ৭৫ বছর পূর্তি অনুষ্ঠানে আমরা শিক্ষক-কর্মচারীরা সহায়তা করছি। তবে মূল আয়োজনে রয়েছে প্রাক্তন ও বর্তমান শিক্ষার্থীরাই। অনুষ্ঠানের সকল প্রস্তুতিও প্রায় সম্পন্ন হয়েছে।
বাংলাদেশ সময়: ২০২১ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৬, ২০২২
এনএস