ঢাকা, বুধবার, ১০ পৌষ ১৪৩১, ২৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

জাতীয়

লিটনের সেলুনে বিবেকানন্দ-লালন সাঁইদের বই

এইচ এম নাঈম, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮২৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩০, ২০২২
লিটনের সেলুনে বিবেকানন্দ-লালন সাঁইদের বই

ঝালকাঠি: শহর থেকে বিচ্ছিন্ন ঝালকাঠি সদর উপজেলার ৭ নম্বর পোনাবালিয়া ইউনিয়ন। সুগন্ধা নদী পার হয়ে যেতে হয় এ ইউনিয়নে।

চারদিক নদী ঘেরা ইউনিয়নটিতে গ্রাম রয়েছে নয়টি।  

ইউনিয়নের পোনাবালিয়া বাজারে নরসুন্দরের কাজ করেন লিটন চন্দ্র শীল। ব্যান্ড সঙ্গীতের জীবন্ত কিংবদন্তী জেমসের ভক্ত হওয়ায় তাকে সবাই চেনে নগর বাউল লিটন নামে। ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের নামও রেখেছেন ‘নগর বাউল হেয়ার কাটিং’। তার সেলুনে আছে অসংখ্য বই। দৈহিক সৌন্দর্যের পাশাপাশি জ্ঞানের বিকাশ ও বর্ধনে তার এমন উদ্যোগ।  

লিটনের সেলুনকে সবাই মিনি গ্রন্থাগার হিসেবেও চেনেন। বিভিন্ন খ্যাতনামা লেখকদের বই আছে তার সংগ্রহে। চুল-দাড়ি কাটতে গিয়ে লোকজন এসব বই পড়েন। এমনিতেও গ্রামের লোকজন এসে তার সেলুনে বই পড়েন।  

লিটনের সেলুনে রয়েছে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, শরৎচন্দ্রের কালজয়ী সব গল্প, উপন্যাসের বই। আছে বিদেশি লেখকদের বইও। সেলুনের দেয়ালে দেয়ালে লিখে রেখেছেন বিভিন্ন বিখ্যাত মানুষের বাণী। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু, ক্যাথলিক সন্ন্যাসি মাদার তেরেসা, দার্শনিক-লেখক-সংগীতজ্ঞ স্বামী বিবেকানন্দ, আধ্যাত্মিক ফকির সাধক লালন সাঁই, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম, বামপন্থী বিপ্লবী নেতা মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার কর্নেল আবু তাহেরসহ অনেকের ছবি।  

নিজের সেলুনে সমৃদ্ধ পাঠাগার গড়ে তুলতে লিটন ব্যয় করেছেন নিজের কষ্টার্জিত অর্থ। সেলুনে নরসুন্দরের কাজ করাতে আসা লোকজনকে অনেক সময় অপেক্ষা করতে হয়। অপেক্ষা যেন ক্লান্তি নিয়ে না আসে, তাই লিটন চান মানুষ যাতে বই পড়ে। গল্প-উপন্যাস পড়ে। সে জন্যই এ আয়োজন করেছেন তিনি।

আব্দুল ওহাব হিরু নামে এক স্থানীয় লিটনের সেলুন ও লাইব্রেরি সম্পর্কে বলেন, আমি শহর থেকে গ্রামে আসি চুল কাটাতে। সেলুনের পাশাপাশি মিনি লাইব্রেরি হওয়ায় নগর বাউল হেয়ার কাটিং এসে স্বস্তি পাই। দীর্ঘক্ষণ থাকলেও ধৈর্য হারাতে হয় না। বাচ্চাদের খেলার সামগ্রীও আছে সেলুনে।  

লিটনের সেলুন কাম লাইব্রেরির নিয়মিত পাঠক মো. সালাউদ্দিন মল্লিক। তিনি জানালেন, পড়াশোনা বেশি দূর না করলেও লিটন বেশ সৃজনশীল। তার জ্ঞানী লোকের মতো মেধা রয়েছে। সেলুনে লাইব্রেরি গড়ে এলাকায় তিনি জ্ঞানের আলো ছড়াচ্ছেন। সনাতন ধর্মের হলেও তার সংগ্রহে ইসলামি বইও আছে। এলাকার লোকজন তাদের সন্তানকে লিটনের কাছে পাঠান চুল কাটাতে। উদ্দেশ্যটা অন্য, সেখানকার বই পড়ে যাতে তাদের মেধার বিকাশ ঘটে।

মেহেদী হাসান নামে একজন বলেন, লিটনের শিক্ষার চেতনা অনেক বেশি। অন্যের জ্ঞানের পরিধি বৃদ্ধিতে তার ভূমিকা এলাকায় প্রশংসনীয়। আমি ছুটিতে বাড়ি এলে এখান থেকে বই বাড়িতে নিয়ে পড়ি। তবে এখানে আরও বই প্রয়োজন। অনেকের ঘরের সেলফে বই পড়ে আছে, কিন্তু পড়া হয় না। তারা যদি কিছু বই এখানে দিয়ে যায় তাহলে বইগুলো কেউ না কেউ পড়তো। পাশাপাশি সরকারি সংস্থা থেকেও কিছু বই এখানে দিলে এলাকাবাসী উপকৃত হতো।

নিজের এমন অভাবনীয় উদ্যোগ নিয়ে নরসুন্দর লিটন চন্দ্র শীল বলেন, ভার্চুয়াল দুনিয়ায় বইয়ের পাঠক কমে গেছে। তাই মানুষের বই পড়ার অভ্যাসটাকে বাড়িয়ে দিতে আমার এই উদ্যোগ। বৃদ্ধ বাবা-মা, স্ত্রী ও একটি কন্যা শিশু নিয়ে আমার সংসার। সেলুনের উপার্জন দিয়ে খেয়ে পরে বাকিটা দিয়ে পাঠকদের জন্য বই সংগ্রহ করি।  

ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে লাইব্রেরি গড়ার উদ্যোগ মাথায় এলো কীভাবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা আমার আত্মতৃপ্তি। বইয়ের মাধ্যমে আমার ইউনিয়ন এবং দেশের কৃষ্টি কালচার ঐতিহ্য সবাই জানবে। কবি-লেখক ও মনীষীদের চিনবে, স্বাধীনতার ইতিহাস জানবে। বর্তমান প্রজন্মকে বই পড়ার আগ্রহ কিছুটা হলেও বাড়বে।

বাংলাদেশ সময়: ১৮২০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩০, ২০২২
এসএম/এমজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।