সিলেট: বাইরে চাকচিক্য, আর ভেতর যেনো অনিয়ম-দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে সিলেট সিটি করপোরেশনের নগর ভবন।
দুর্নীতির এ গভীরতা মাপকাঠিতে হিসেব করার নয়।
তার আধিপত্য শুধু নগরভবনেই সীমাবদ্ধ নয়। দাপট রয়েছে সিসিক প্রশাসনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। নিয়োগ বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ থেকে শুরু করে বাইরের অবৈধ কাজকারবার থেকে মাসোয়ারা আদায়ে সিদ্ধহস্ত তিনি। এ দুই খাত থেকেই কোটি কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন হানিফ। বাংলানিউজের অনুসন্ধানে এমনই চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সিসিকের অনেকেই জানিয়েছেন, শুধু রেস্টুরেন্টের ময়লা অপসারণ করেই তার মাসিক আয় ৪/৫ লাখ টাকা। এর বাইরে মেডিকেলের বর্জ্য অপসারণ থেকে সমপরিমাণ টাকা আসে তার পকেটে।
এভাবে মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীর দুই মেয়াদে কনজারভেন্সী শাখার কর্তা হয়ে মাসোয়ারা আদায় করেছেন তিনি। এসব টাকা হাতের লেখা রশিদে ও নগদে আদায় করে নেন বলে জানিয়েছেন রেস্তোরাঁ মালিকসহ সংশ্লিষ্টরা। ওই টাকা সরকারি কোষাগারে যায় কিনা, সেটা জানেন না তারা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৩ সালে আরিফুল হক চৌধুরী মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে প্রশাসনিক শাখা পুরোদস্তে নিয়ন্ত্রণ চলে যায় হানিফের হাতে। এ দুই মেয়াদে হানিফের হাত ধরে অন্তত ৪০০ অধিক লোক নিয়োগ হয়েছে সিসিকে। দফতর বুঝে রয়েছে নিয়োগের নানা রকম বাণিজ্য।
সূত্রমতে, মাস্টাররোলে নিয়োগপ্রাপ্ত ৪০০ অধিক লোকের কাছ থেকে জনপ্রতি অন্তত ৩/৪ লাখ টাকা করে হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে। তারমধ্যে প্রকৌশল শাখা, লাইসেন্স, স্বাস্থ্য শাখাসহ গুরুত্বপূর্ণ শাখায় চাকরিতে যোগদানকারীদের দিতে হয়েছে পাঁচ লাখ টাকা করে। যদিও এ টাকার ভাগ তিনি একা হজম করেননি!
আলাপ প্রসঙ্গে সিসিকের প্রকৌশল শাখার এক কর্মী জানান, এ দফতরে নিয়োগ পেতে হলে পাঁচ লাখ টাকা দিতে হয়। গত বছরেও সিলেটের একটি বেসরকারি ইউনিভার্সিটির কয়েকজনকে পূর্ত শাখায় বড় অঙ্কের বিনিময়ে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে আস্থাভাজনদের পদোন্নতিও দেওয়া হয় রাতারাতি। আর মাস্টাররোলে নিয়োগদের প্রতি মাসের বেতন থেকে অন্তত চার দিনের টাকা কেটে রাখা হয়। এ টাকারও কোনো হদিস থাকে না।
এর বাইরেও রয়েছে অবৈধ আয়ের আরও অগণিত খাত। এসব খাত থেকে এক-দুই কোটি নয়, বর্তমান মেয়রের দুই মেয়াদে কী পরিমাণ টাকা পকেটস্থ করা হয়েছে, তা নিশ্চিত করে বলতে পারেননি কেউই। তবে এ টাকার ভাগ কারা পান, তা কেবল হানিফ-ই জানেন বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
কনজারভেন্সী শাখা সূত্র জানায়, দিনমজুরদের (ডে লেবার) জনপ্রতি মজুরি ৫০০ টাকা থাকলেও পুরো টাকা দেওয়া হয় না। কখনো ২০০ টাকা করে কেটে রাখাও অভিযোগ জানিয়েছেন শ্রমিকরা। কেউ প্রতিবাদ করলেই কর্মহীন থাকতে হয়। যে কারণে চাকরি হারানোর ভয়ে হানিফের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে মুখ খুলতে নারাজ তারা।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, সিসিকের কনজারভেন্সী শাখায় কাজ করেন এমন শ্রমিক আছেন ৪০০ জন। তাদের মধ্যে অফিসে নাইটগার্ড ও রিকশা নিয়ন্ত্রণে ১২০ জন, প্রতিটি ট্রাকে ৩/৪ জন করে ১৫০ জন, বিভিন্ন অফিস আদালতে ৩০/৪০ জন, ডাম্পিংয়ে কাজ করে আরও ১৫/২০ জন। আর ময়লার গাড়িতে কাজ করেন আরও ১৫০ জন। তাদের প্রত্যেকেই কোনো না কোনো ভাবে ৫০ হাজার থেকে লাখ টাকা দিয়ে সিসিকে চাকরি নিয়েছেন।
আর ময়লার গাড়ি ১০০টির মধ্যে প্রতিদিন অন্তত ৬০/৬৫টি গাড়ি চলে। এসব গাড়ি দিয়ে শহরের আবর্জনা পরিষ্কারের পাশাপাশি নগরীর আড়াই শতাধিক রেস্তোরা, শতাধিক হাসপাতাল ও ক্লিনিকের বর্জ্য অপসারণ করতে নেওয়া হয় দুই হাজার থেকে পাঁচ হাজার টাকা করে। আর রেস্তোঁরার উচ্ছিষ্ট খাবার বিক্রি করা হয় বিভিন্ন মাছের খামারে। সেসব খামারিদের সঙ্গেও চুক্তিবদ্ধ হয়ে টাকা আদায় করেন হানিফের বিশ্বস্ত লোকজন।
এর বাইরেও নগর এলাকায় ব্যানার টানাতে, খালি বিলবোর্ডে নির্দিষ্ট সময়ের জন্যও ব্যানার সাঁটাতে কর্মীদের মাধ্যমে টাকা আদায় করার অভিযোগ রয়েছে।
ছাপাখানা থেকে পাওয়া তথ্যমতে, ব্যানার-ফেস্টুন তৈরির পর সাঁটানোর দায়িত্ব তারাই নিয়ে থাকে। কিন্তু সিসিক কর্মীদের টাকা না দিলে রাতেই ব্যানার গায়েব হয়ে যায়। সেক্ষেত্রে ছাপাখানা থেকে তাদের মাসোয়ারা দিতে হয়। এসব অর্থের কোনো অংশই সরকারি কোষাগারে যায় না। এছাড়া শহর জুড়ে সাঁটানো ব্যানার-ফেস্টুন খুলে ভাঙাড়িদের কাছে বিক্রি করা হয় বলে জানা গেছে।
যদিও হানিফুর রহমান বলেছেন, রেস্তোরাঁ ও ক্লিনিকের টাকা চালান মারফত ব্যাংকে জমা হয়। তবে রেস্তোরাঁর উচ্ছিষ্ট খাবার খামারে বিক্রি ও ব্যানার-ফেস্টুন থেকে টাকা আদায়ের বিষয়টি অস্বীকার করেন তিনি। শহরে লাগানো ব্যানার-ফেস্টুন খুলে ডাম্পিংয়ে নিয়ে পোড়ানো হয় বলেও দাবি তার।
নগরের কালীঘাট থেকে তার নিজস্ব খামারের জন্য কেনা খৈল ও ভুষির গুড়া সরকারি গাড়ি দিয়ে পাঠানো হয় মৌলভীবাজারের আদমপুর গ্রামে। এটাও অস্বীকার করে তিনি বলেন, কমলগঞ্জ থেকে পান নিয়ে যেসব গাড়ি আসে, সেগুলো দিয়ে মালামাল পাঠাই।
সার্বিক অভিযোগ ও নিয়োগ বাণিজ্যের বিষয়ে হানিফুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, অফিসে মাস্টাররোলে কতজন চাকরি করেন, সেটা আমার জানা নেই। এ যাবত কারও কাছ থেকে টাকা নিয়ে নিয়োগ দিয়েছি কেউ বলতেও পারবে না। আর রেস্তোরাঁর বর্জ্য ব্যবস্থাপনার টাকা ব্যাংকে জমা হয়।
তবে রেস্তোরাঁ থেকে কি পরিমাণ টাকা জমা হয়, তা তার জানা নেই এবং রেস্তোরাঁর উচ্ছিষ্ট খাবার খামারে বিক্রির বিষয়টিও সঠিক নয় বলে জানান তিনি।
বাংলাদেশ সময়: ১১৩০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০৫, ২০২৩
এনইউ/এসআইএ