ঢাকা, রবিবার, ১ পৌষ ১৪৩১, ১৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

জাতীয়

অতি দরিদ্রদের কর্মসংস্থান কর্মসূচির টাকা লুটের পাঁয়তারা ইউপি সদস্যদের!

সাজিদুর রহমান রাসেল, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬১৩ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১০, ২০২৩
অতি দরিদ্রদের কর্মসংস্থান কর্মসূচির টাকা লুটের পাঁয়তারা ইউপি সদস্যদের!

মানিকগঞ্জ: সাটুরিয়া উপজেলার বরাইদ ইউনিয়নের অতি দরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান কর্মসূচির (৪০ দিন) আওতায় দুটি প্রকল্প চলমান। এ কর্মসূচিতে শ্রমিকের ভুয়া নাম দেখিয়ে মজুরির টাকা লুটের পাঁয়তারা করার অভিযোগ উঠেছে ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার দেলোয়ার হোসেনের বিরুদ্ধে।

সম্প্রতি এ অভিযোগ ওঠে। তা ছাড়া সরেজমিনে গিয়েও সংশ্লিষ্ট কিছু তথ্য পাওয়া গেছে।

জানা গেছে, বরাইদ ইউনিয়ন পরিষদে চলতি ২০২২-২০২৩ অর্থ বছরের উত্তর ছনকা আনোয়ারের বাড়ি হতে সালাম মাস্টারের বাড়ি ও গোপালপুর খেয়াঘাট হতে ধুলট ব্রিজ পর্যন্ত রাস্তা নির্মাণের কাজ হচ্ছে। প্রতিটি কাজের জন্য দুজন ইউপি সদস্যকে প্রকল্পের সভাপতি করে একটি কমিটি করে দিয়েছেন স্থানীয় চেয়ারম্যান আব্দুল হাই।

সরেজমিনে গিয়ে জানা গেছে, সাটুরিয়া উপজেলার বরাইদ ইউনিয়নে অতি দরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান কর্মসূচি আওতায় দুটি প্রকল্পে যাদের শ্রমিক হিসেবে নাম দেওয়া হয়েছে, আদতে তাদের অনেকেই নেই। অনেকে বদলি হিসেবে কাজ করছেন। এ কর্মসূচির শ্রমিকদের ৪০ দিন কাজ করতে হবে, দৈনিক তাদের দেওয়া হকে ৪০০ টাকা করে। সে হিসেবে তাদের ১৬ হাজার টাকা পাওয়া কথা, যা দেওয়া হবে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে।

প্রকল্প বাস্তবায়নে যাদের সভাপতি করা হয়েছে তারা হলেন ১, ২ ও ৩ নম্বর ওয়ার্ডের মহিলা মেম্বার মোছা. জোবাইদা খাতুন। তিনি উত্তর ছনকা আনোয়ার হোসেনের বাড়ি হতে সালাম মাস্টারের বাড়ি পর্যন্ত প্রকল্পে সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। গোপালপুর খেয়াঘাট হতে ধুলট ব্রিজ পর্যন্ত প্রকল্পের সভাপতিত্ব করছেন ৮ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার মো. হাবিবুর রহমান।

দুটি প্রকল্পের মধ্যে জোবাইদার অংশে বেশ অনিয়মের চিত্রের দেখা মেলে। তার প্রকল্পে একজনের কাজ করেন অন্য জন। প্রকল্পে সবচেয়ে বড় দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে দেলোয়ার হোসেনের বিরুদ্ধে। তিনি অতি দরিদ্রদের কর্মসংস্থান কর্মসূচিতে ভুয়া নাম দিয়ে নিজের মোবাইল নম্বর ব্যবহার করেছেন। এ ছাড়া বীথি আক্তার নামে এক শ্রমিকদের নামের জায়গায় নিজের স্ত্রী রুপালী বেগমের মোবাইল নম্বর দিয়েছেন।

এ ছাড়া নিজের অসুস্থতার দোহাই দিয়ে প্রকল্পের সুপারভাইজার শরিফুল ইসলামকে প্রভাবিত করে দেলোয়ার তৈরি করেছেন ভুয়া হাজিরা খাতা। এতে সইও করেছেন শরিফুল।

একাধিক শ্রমিকের অভিযোগ, দিনের পর দিন কাজ করে গেলেও তারা প্রকল্পের মজুরির টাকা পাননি। ২০২২ সালেও প্রকল্পের আওতায় তারা কাজ করেছেন, সে মজুরিও পাননি।

উত্তর ছনকা প্রকল্পের আওতায় কাজে নিয়োজিত নারী শ্রমিক অলেকা বেগমের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কাজের জন্য তার ছেলের বৌয়ের নাম দেওয়া ছিল। কিন্তু তার পরিবর্তে নিজেই এসেছেন অলেকা। কারণ, সংসার চালানোর কেউ নেই তার। কাজ না করলে জীবন চালাতে পারবেন না। একই কারণে পুত্রবধূর নাম দিয়ে কাজ করছেন লাইলী বেগম নামে অপর এক নারী।

নারী শ্রমিকদের অভিযোগ, তারা যারা কাজ করছেন, তাদের বেশিরভাগের নাম হাজিরা খাতায় নেই। অপর জনের নামে তারা কাজ করছেন। দেলোয়ার মেম্বার তাদের বলেছেন, কোনো সমস্যা হলে তিনি দেখবেন। চিন্তা না করতে। খোকন বেগম নামে একজনের নাম উল্লেখ করে দেলোয়ার তাদের আরও বলেছেন, কেউ এ নাম জিজ্ঞেস করলে যেন বলা হয় ‘আজ তিনি কাজে আসেননি’। তাই তারা প্রতিদিন শেখানো কথা বলে আসছেন। কাজ শুরুর পর থেকে কোনোদিন খোকন বেগম কাজে আসেননি। প্রতিদিন মিথ্যা বলতে তাদের সমস্যা হয়। এদিকে, খোকন বেগম ওই প্রকল্প দেখতেও যাননি, এমনকি এ সম্পর্কে কিছু জানেনও না।

বিষয়টি নিয়ে বরাইদ ইউনিয়নের নারী শ্রমিক খোকন বেগমের সঙ্গে কথা হলে তিনি জানান, এখন পর্যন্ত তিনি অতি দরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান কর্মসূচিতে কাজ করতে যাননি। তার নাম কীভাবে তালিকায় গেল, তিনি জানেন না।

বিষয়টি নিয়ে বরাইদ ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার মো. দেলোয়ার হোসেন বলেন, আমি প্রকল্পের সভাপতি না যে ইচ্ছা করলেই নাম পরিবর্তন করতে পারব বা অন্যকে কাজে লাগাবো। তাকে খোকন বেগমের বিষয়ে প্রশ্ন করা হয়। কিন্তু তিনি কোনো উত্তর দিতে পারেননি। পরে নারী শ্রমিক বীথি পরিবর্তে নিজের স্ত্রীর নম্বর দেওয়া বিষয়ে প্রশ্ন করা হয় দেলোয়ারকে। এতে তিনি কোনো উত্তর তো দেননি, বরং রাগ দেখিয়ে চলে যান।

অনিয়মের ব্যাপারে ১, ২ ও ৩ নম্বর ওয়ার্ডের মহিলা মেম্বার মোছা. জোবাইদা খাতুনকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, আমি বেশ কিছু দিন ধরে অসুস্থ। তাই প্রকল্পের ব্যাপারে কোনো খোঁজ নিতে পারিনি। সুপারভাইজার শরিফুল ইসলাম সব বলতে পারবে। তিনি হাজিরা খাতায় শ্রমিকদের নাম-নম্বর লেখেন। আমি শুধু সই করি।

প্রকল্পের সুপারভাইজার শরিফুল ইসলাম নিজের কৃতকর্ম স্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, প্রকল্পের সবার হাজিরা খাতায় আমি স্বাক্ষর নেই। উত্তর ছনকা প্রকল্পে একজনের পরিবর্তে অন্য জন কাজ করে। খোকন বেগম নামে এক নারী কর্মীর কাজের কথা থাকলেও তিনি করেন না। তার নামের জায়গায় প্রতিদিন আমাকে সই দিতে হয়। তা না করলে দেলোয়ার মেম্বার আমাকে গালাগাল দেন। আমাকে তিনি প্রভাবিত করেন বলেই এ কাজ করতে হয়।

অতি দরিদ্রদের কর্মসংস্থান কর্মসূচি প্রকল্পে এত দুর্নীতি হলেও কিছুই নাকি জানেন না বরাইদ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা গাজী মোহাম্মদ আব্দুল হাই। তিনি বলেন, অনিয়মের বিষয়ে আমার জানা নেই। খোঁজ খবর নিয়ে বিষয়টি দেখছি।

সাটুরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শারমিন আরা বাংলানিউজকে বলেন, বরাইদ ইউনিয়নে অতি দরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান কর্মসূচিতে কেউ কোনো অনিয়ম-দুর্নীতি করলে তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আমরা বিষয়টি দেখছি।

বাংলাদেশ সময়: ১৬১০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১০, ২০২৩
এমজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।