ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১২ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

জাতীয়

খেজুরের রস ও গুড়েই সফল সোহরাব

শরীফ সুমন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭১৯ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৬, ২০২৩
খেজুরের রস ও গুড়েই সফল সোহরাব

রাজশাহী: গাছ থেকে পাইপ দিয়ে খেজুরের রস নামানোর এক বিশেষ পদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন কৃষক সোহরাব আলী। তার বাড়ি রাজশাহীর দুর্গাপুরের বর্ধনপুর গ্রামে।

বিষয়টি নিয়ে ইতোমধ্যে এই অঞ্চলে হৈ-চৈ পড়ে গেছে। তবে কেবল খেজুরের রস নামানোর অভিনব পদ্ধতিই আবিষ্কার করেননি সোহরাব আলী। তিনি তার পরিবারের সহযোগিতায় তৈরি করছেন কেমিক্যাল মুক্ত খেজুরের গুড়। তাই খেজুরের রস নামানোর নতুন পদ্ধতির সন্ধানে সেখানে গিয়ে দেখা যায় খেজুরের খাঁটি গুড় তৈরির কৌশলও।  

আর কীভাবে খেজুরের আসল গুড় তৈরি হয়, তাতে কী কী উপকরণ মেশাতে হয় ইত্যাদি নানান প্রশ্ন ও কৌতূহল স্বভাবতই কাজ করে কমবেশি সবার মনে। আর বাংলানিউজের পাঠকদের জন্য সেসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজেতেই আজকের এই সরেজমিন প্রতিবেদন।



দুর্গাপুর উপজেলার ৫ নম্বর ঝালুকা ইউনিয়নের বর্ধনপুর গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, তার ৮০টি খেজুর গাছ রয়েছে। আগের দিন বিকেলে রস সংগ্রহের জন্য বিশেষ পদ্ধতিতে এসব গাছ কাটা হয়। পাইপের মধ্যে দিয়ে সেই রস এসে গাছের নিচে পেতে রাখা কলসে জমা হয়। সেই রসে ভরা কলস পরদিন সকালে গিয়ে মাটিতে হেঁটে হেঁটে নামাতে হয়। এরপর সেই রস নিয়ে চলে যাওয়া হয় বাড়িতে। সেখানে বিশালাকৃতির একটি মাটির চুলার ওপরে বসিয়ে দেওয়া হয় কড়াই আকৃতির একটি বড় ট্রে। ওই ট্রের মধ্যে সংগ্রহকৃত খেজুরের রস ঢেলে দেওয়া হয়।

এরপর চুলার মাঝারি আঁচের আগুনে ধীরে ধীরে রস জাল দেওয়ার কাজ শুরু হয়। একটানা চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা সেই রস আগুনে জাল দিতে হয়। এরপর সেই কাঁচা রস সাদা বর্ণ থেকে খেজুরের গুড়ের মত লাল বর্ণ ধারণ করে। আর খেজুরের রস জাল দেওয়ার সময় বিশালাকার একটি কাঠের হাতল দিয়ে তা অনবরত নাড়তে হয়। এভাবে নাড়তে নাড়তে প্রায় চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা পর খেজুরের রস দানায় রূপ নেয় এবং খয়েরি বর্ণ ধারণ করে।



এরপর সেই রসের দানার কিছু অংশ ঠাণ্ডা পানিতে ফেলে পরীক্ষা করা হয় যে, গুড় জমছে কিনা। যখন ঠাণ্ডা পানিতে দেওয়ার পর গুড় জমে যায় তখন তারা বুঝতে পারেন যে, রস জাল দেওয়ার সময় শেষ। এখন এটি পাত্রে ঢাললেই তা জমাট গুড়ে পরিণত হবে। আর এই গুড় জাল দেওয়ার একপর্যায়ে তারা এটিকে আরও সুস্বাদু ও সুগন্ধময় করতে একটি বিশেষ মসলা ব্যবহার করেন। যেটি হাতের কাছে পাওয়া যায় এবং সবাই চেনেন। সেটি হচ্ছে গরম মসলা। এছাড়া আরও সুস্বাদু করতে কিসমিস এবং আস্ত তেজপাতা দিয়ে দেন ফুটন্ত গুড়ের ঘন মিশ্রণে। তাই এই খেজুরের গুড় আরও বেশি সুস্বাদু এবং সুগন্ধময় হয়ে ওঠে।

ট্রে থেকে প্রথম ধাপে গামলায় নামানো হয় গুড়। গরম অবস্থায় এটি অনেকটাই দেখতে তরল মনে হয়। কিন্তু ছাঁচে ঢালার পর তা জমাট বেঁধে শক্ত হয়ে যায়। আর এটিকেই পাটালি গুড় বলা হয়। আর যে গুড়টা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তরল বা নরম প্রকৃতির করেই তৈরি করা হয় তাকে এখানে লালি গুড় বলা হয়।

এরপর গুড়ের স্বাদ বাড়াতে দেওয়া হয় ভাজা বাদাম। আর বাদাম দেওয়ার পর পুরো গুড়টাকে লাঠি দিয়ে আবারো ১০ থেকে ১৫ মিনিট নাড়তে হয়। এতে গুড়ের মণ্ডটি আরও বেশি ও গাঢ় হয়। এরপর সেই গুড় ছাঁচে ফেলে ১৫ থেকে ২০ মিনিট রেখে দেওয়ার পরে তা বিভিন্ন আকৃতি ধারণ করে। মূলত এভাবেই তৈরি হয় কেমিক্যালমুক্ত খেজুরের গুড়।



খাঁটি গুড় বলতে আসলে কী বোঝায়? সত্যি বলতে এর জাদুকরী কোনো মসলা বা উপকরণ আছে? এমন প্রশ্নে কৃষক সোহরাব আলী বাংলানিউজকে বলেন, সত্যি বলতে খেজুরের গুড়ের জন্য প্রয়োজন শুধুই খাঁটি রস। আর সেই রস সরাসরি ৪/৫ ঘণ্টা জাল দিয়েই তৈরি করা গুড়ই মূলত খেজুরের খাঁটি গুড়। এর সাথে আর বিশেষ কিছুই মেশাতে হয় না। কারণ খেজুরের রস নিজেই তার বিশুদ্ধতা বহন করে। কোনো কিছু মেশালেই তা হয়ে যায় ভেজাল এবং কৃত্রিম। আর তা স্বাস্থ্যের জন্য খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। ইদানিং গুড়ের বিভিন্ন রং তৈরি করার জন্য ডালডা, হাইড্রোজ ও ফিটকারি চুনের মত ক্ষতিকর রাসায়নিকদ্রব্য ব্যবহার করা হয় বলেও উল্লেখ করেন এই কৃষক। এজন্য বাজারে সচরাচর পাওয়া যাওয়া হলদে বা সাদা রঙের গুড় না কিনে একটু খয়েরি বা কালচে ধরনের নরম গুড় কেনার পরামর্শ দেন এই কৃষক। কারণ এটিই আসল ও ভেজাল গুড়ের প্রধানতম পার্থক্য। আর ভেজাল গুড়ে কামড় দিলে তা তাল মিছরির মতো কুড়মুড়ে মনে হবে। আর আসল খেজুরের গুড়ে কামড় দিলে তা অনেকটা নরম হবে উল্লেখ করেন তিনি।

আর গরম মসলা এবং বাদাম মেশানোর বিষয়টি অনেকটা সৌখিনতা বলেই জানান। এসব প্রাকৃতিক উপাদান খাঁটি খেজুরের স্বাদ ও গন্ধকে আরও আকর্ষণীয় ও মোহনীয় করে তোলে। এই বাদাম, কিসমিস ও গরম মসলা তার খেজুরের গুড়কে যেন স্বাদে গুণে করে তুলেছে অনন্য এবং অমৃত। এতে একটি আলাদা বিশেষত্ব আসে। আর এই কারণে তার তৈরি খেজুরের খাঁটি গুড়ের চাহিদাও বেশি। তাকে গুড় বিক্রির জন্য বসে থাকতে হয় না। দোকান না থাকলেও তার বাড়ি থেকেই বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ ফোনে এই গুড় অর্ডার করেন।
 


এছাড়া এই গুড় এখন দেশের বাইরেও পাঠান বলে জানান সোহরাব আলী।  

দামের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে সোহরাব আলী বলেন, বর্তমানে রাজশাহীর হাটে খেজুরের গুড় ১৫০ থেকে ১৮০ টাকা দরে কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে তবে তার গুড়ের দাম একটু বেশি। তিনি এই গুড় ২৫০ থেকে ২৮০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করে থাকেন। তবে বেশি গুড় নিলে তিনি দাম একটু কম রাখেন বলেও উল্লেখ করেন।  

তিনি জানান, গুড়ে কোনো ধরনের ভেজাল না দেওয়ায় এরই মধ্যে তিনি এই মৌসুমি ব্যবসায় পেয়েছেন সাফল্য।

আরও পড়ুন>>

>>> গাছে না উঠেই নামানো যাচ্ছে খেজুরের রস!

বাংলাদেশ সময়: ০৭১৯ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৬, ২০২৩
এসএস/এএটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।