ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১২ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

জাতীয়

মেহেদী পাতার মতোই রক্তক্ষরণ হয় জুলিদের জীবনে

শরীফ সুমন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৪২ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ৪, ২০২৩
মেহেদী পাতার মতোই রক্তক্ষরণ হয় জুলিদের জীবনে জুলি

রাজশাহী: জুলিকে বাইরে থেকে কোনোভাবেই বোঝার উপায় নেই যে, তিনি একজন হিজড়া জনগোষ্ঠীর সদস্য।  সুন্দর মুখশ্রী, গঠন ও বেসভুসায় তিনি যেন একজন পরিপূর্ণ নারী।

কিন্তু প্রকৃত সত্য হচ্ছে, সৃষ্টিগতভাবে তিনি পুরুষ দেহ নিয়ে জন্মালেও তার ভেতরের মনটা নারীর মতোই। তার সব ভাবনা, অনুভব-অনুভূতি ও আচরণ আর দশটা স্বাভাবিক নারীর মতোই। বয়ঃসন্ধিতে এই বিষয়টি বুঝতে পারার পরই আকাশ ভেঙে পড়ে জুলির পরিবারের মাথার ওপর। আর জুলির বিভীষিকাময় জীবনের শুরু এখানেই।

পারিবারিক ও সামাজিক চাপে শেষ পর্যন্ত শেকড় ছিড়ে জুলিকে পরিবার ছাড়তে হয় সেই কৈশরেই। যেখানে জন্মে ছিলেন, যেই পরিবারের সাথে তার রক্তের বাঁধন; সেই পরিবারই চির জীবনের জন্য পর করে দিয়েছিলেন জুলিকে। একটি বারও ভাবেনি পথে নামিয়ে দেওয়া এই জুলি কোথায় যাবে, কী খাবে; কে-ই বা দেবে তাকে আশ্রয়! 

পরিবারে অটিস্টিক ও প্রতিবন্ধী সন্তানের জায়গা হলেও জায়গা হয়নি জুলির। কারণ তিনি হিজড়া। সেই থেকে আজ পর্যন্ত তুষের আগুনেই জ্বলছেন জুলি। তার এই হাসিমাখা সুন্দর রূপ দেখে হয়তো মনে হতেই পারে যে তিনি খুবই সুখী একজন মানুষ। কিন্তু বাস্তবতাটা পুরোই ভিন্ন। তার এই সুন্দর রূপের অন্তরালে লুকিয়ে আছে চাপা কান্না ও পাহাড়সম কষ্ট। যা বাইরে থেকে কখনোই বোঝা যায় না। যায় না দেখাও।

মানুষের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য এবং নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিনিয়তই পোড়ায় এই জুলিদের। তার মতো এমন অসংখ্য জুলি ঘুরে বেড়াচ্ছেন সমাজের চারপাশেই। তাদের সবার কথা জানা যায় না; কেউ জানতেও চায় না। অবহেলা, বঞ্চনা, নির্যাতন ও নিপীড়নে তাই জুলিরা ধীরে ধীরে হয়ে উঠেছেন আগ্রাসী। অথচ অন্য সন্তানের মতো পরিবারে স্থান পেলে এই হিজড়া জনগোষ্ঠীর সদস্যরা আর সমাজের বিষফোড়া হয়ে উঠতেন না।  

বেঁচে থাকার জন্য কাউকে জিম্মিও করতেন না আর তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করে সমাজের মূল ধারায় ফিরিয়ে আনতে জীবনময় সংগ্রামও করতে হতো না। অন্তত এমনটায় মনে করেন সুন্দরী হিজড়াখ্যাত রাজশাহীর তৃতীয় লিঙ্গের সদস্য জুলি।

তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীর দুঃখ-কষ্ট ও বঞ্চনার করুণ কাহিনী জানতে দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে জুলি বাংলানিউজের কাছে এভাবেই তুলে ধরেন তার জীবনগাথা।  

জীবন থেকে শেখা চরম সত্য কথাগুলো তুলে ধরেন প্রতিবেদকের সামনে। জানান, মেহেদী পাতার মতোই রক্তক্ষরণ হয় তার মতো জুলিদের জীবনে।

রাষ্ট্রীয়ভাবে ২০১৩ সালে তাদেরকে তৃতীয় লিঙ্গের স্বীকৃতি দিলেও তা প্রতিষ্ঠা পায়নি আজও। তাদের মানবাধিকার নিয়ে সবাই সোচ্চার। আন্দোলনও করছেন। কিন্তু ১০ বছর হয়ে গেছে এখনও নিশ্চিত হয়নি তাদের বেঁচে থাকার মৌলিক অধিকারই। তাই মৌলিক অধিকার না পেলে মানবাধিকার কীভাবে প্রতিষ্ঠা পাবে? সেই প্রশ্ন রাখেন রাজশাহীর তৃতীয় লিঙ্গের সদস্য জুলি।

তিনি জানান, তার বয়স যখন ১৪ বছর তখনই তিনি বুঝতে পারেন যে, তার মন ও শরীর আর ১০টা শিশুর মতো নয়। ছেলে শিশু হয়ে জন্মালেও হরমোনজনিত সমস্যার কারণে তার মনে সব সময় নারী স্বত্বা কাজ করে। নারীদের মতোই তার সাজতে ভালো লাগে। ভালো লাগে পুতুল খেলতেও। ছেলেদের কোনো খেলাধুলা তাকে আর টানে না। ছেলে হয়েও এই মেয়েলি আচরণের কারণে তাকে ধাপে ধাপে পরিবারের সবার কথা শুনতে হয়। একপর্যায়ে সবাই যখন নিশ্চিত হলেন যে, তিনি হিজড়া, তখনই তার জীবনে নেমে এলো বিভীষিকা। সামাজিক চাপে পরিবার থেকে বের করে দেওয়ার পরে তিনি হঠাৎ করেই আশ্রয়হীন হয়ে পড়েন। কিশোর বয়সে কোথায় যাবেন, কী করবেন কিছুই বুঝে উঠতে পারেন না।

এমন অবস্থায় দেখা হয়, তার মতোই একজন তৃতীয় লিঙ্গের সদস্যের সঙ্গে। তিনি সব কথা শুনে জুলিকে নিয়ে যান রাজশাহীর হিজড়া গুরু মায়া খানের কাছে। তিনিই শেষ পর্যন্ত আশ্রয় দেন জুলিকে। ধীরে ধীরে জুলিও হিজড়াদের গুরু প্রথার অনুসারী হয়ে যান এবং শুরু করেন হিজড়াগিরি।  

কোনো বাড়িতে নবজাতক জন্ম নিলেই দলবেঁধে সেই বাড়িতে গিয়ে নেচে-গেয়ে টাকা তোলা, বাজারে গিয়ে বাজার তোলা, দোকানে দোকানে গিয়ে টাকা চাওয়াই হয়ে ওঠে জুলির মূল পেশা। সারা দিন রোজগারের প্রায় পুরো অংশটি তুলে দিতে হয় গুরু মায়ের কাছে। এর বিনিময়ে মিলে থাকা-খাওয়া ও পোশাক-আশাক। তার প্রথম গুরু মায়া খান এখন আর বেঁচে নেই। জুলি এখন হীরা খান নামের আরেক হিজড়াগুরুর অধীনে থাকেন। তবে মায়া খান যখন বেঁচেছিলেন, তখনই এইচআইভি প্রিভেনশন একটি ট্রেনিং কোর্স পেয়েছিলেন জুলি। এরপর বেসরকারি একটি সংস্থায় চাকরিও শুরু করেন। পরে বিভিন্ন এনজিও থেকে আরও বেশ কিছু ট্রেনিং পান জুলি। এরপর যুক্ত হন দেশের তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীদের নিয়ে কাজ করার অন্যতম বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বন্ধু ওয়েলফেয়ার সোসাইটির সঙ্গে। সেখান থেকে ধারাবাহিক প্রশিক্ষণ পাওয়ার পর জুলি এখন নিজেই প্রতিষ্ঠিত হয়ে উঠেছেন। পুরোনো পেশা হিজড়াগিরির সঙ্গে যুক্ত থাকলেও নিজেকে তৈরি করে ফেলেছেন এরই মধ্যে। তিনি এখন তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীর অধিকার ও দাবি আদায়ে নেতৃত্ব দিচ্ছেন, রয়েছেন রাজশাহীতে থাকা দিনের আলো হিজড়া সংঘের কোষাধক্ষ পদেও।

জুলি আরও জানান, তারা দুই ভাই। ছোটবেলায় তার বাবার মৃত্যু হয়। এরপর নানির বাড়িতে থেকেই বড় হন তারা। তাই ছোটবেলা থেকেই অভাব-অনাটনের মধ্যে তাদের বেড়ে ওঠা। এর ওপর বৈচিত্র্যময় জনগোষ্ঠীর সদস্য হওয়ায় তার জীবনে রয়েছে আলাদা দুঃখ-কষ্ট। এক সময় পরিবার থেকে তাকে বের করে দেওয়া হলেও এখন তিনিই পরিবারের একমাত্র অবলম্বন। নানার দেওয়ার জায়গার ওপরে মা ও ছোট ভাইকে বাড়ি করে দিয়েছেন। তবে তিনি হিজড়া হওয়ায় সেই বাড়িতে যেতে পারেন না। পারেন না থাকতেও।  মাঝেমধ্যে রাতের আঁধারে শার্ট-প্যান্ট পরে লুকিয়ে লুকিয়ে যান ভাই ও মায়ের সাথে দেখা করতে। এছাড়া বাড়ির বাইরে থেকেই তার ভাইয়ের লেখাপড়া, মায়ের ভরণপোষণ এবং চিকিৎসার সব ব্যয়ভার বহন করেন। তার মা ভাই এবং আত্মীয় স্বজনরা তার আর্থিক সুবিধা নিলেও সামাজিক চাপের কারণে এখনও তাকে পরিবারে ঠাঁই দিতে পারেন না। তাকে বাসায় যেতে নিষেধ করেন। গেলে তাদের মানসম্মান চলে যাবে এবং তারা সমাজের চোখে হেয়-প্রতিপন্ন হবে বলে যাবেন। তাই রোজা আসে, ঈদ আসে কিন্তু তার জীবনে খুশি আসে না। কোনো উপলক্ষ এলেই চাপা কান্নায় তার বুক ভাসে। এখন গুরু মায়ের অধীনেই রাজশাহী মহানগরের শিরোইল কলোনি এলাকার একটি নিম্নমানের বাড়িতে থাকেন।

এক প্রশ্নের জবাবে জুলি জানান, তৃতীয় লিঙ্গের সদস্য হওয়ায় কেউ তাদেরকে বাড়ি ভাড়া দিতে চান না। বাধ্য হয়ে কলোনিতে টিনশেড বাড়ি ভাড়া নিয়ে তাদেরকে থাকতে হয়। সাধারণত ওই রকম বাড়ির একটি কক্ষের ভাড়া সর্বোচ্চ এক হাজার টাকার বেশি হওয়ার কথা না। কিন্তু তাদের কাছে তিন থেকে চার হাজার টাকা পর্যন্ত ভাড়া নেওয়া হয়। ওই ছোট একটা ঘরের মধ্যেই অনেকজন সদস্য একসঙ্গে গাদাগাদি করে থাকেন। সমাজের সবাই তাদেরকে দূর দূর করে। এরপরও এই জনগোষ্ঠীকে সমাজের মূল স্রোতধারায় ফিরিয়ে আনতে অন্য নেত্রীদের সঙ্গে তিনিও লড়াই করে যাচ্ছেন।

জুলি মনে করেন, যতদিন তার মতো জুলিরা পরিবারের স্থান না পাবে ততদিন এই হিজড়াগিরি প্রথা বন্ধ হবে না। বন্ধ হবে না গুরু প্রথারও। আর এভাবেই তাদের ওপরে জুলুম-নির্যাতন ও নিপীড়ন চলতেই থাকবে। বেঁচে থাকার অধিকার আদায়ের জন্য তাদের যুগের পর যুগ লড়তে হবে এভাবেই।

এ সময় জুলি তার জীবনের নানান দুঃখ-কষ্টের কথা তুলে ধরে বলেন, তার মতো প্রতিটি সদস্যের জীবনেই এমন করুণ কাহিনী রয়েছে। তার মতে, যাদেরকে এরই মধ্যে পরিবার থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে তাদের মৌলিক অধিকার ও কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে হবে। আর যারা এখনও পরিবারে রয়েছেন তাদের পরিবারেই রাখতে হবে। তাহলে সমাজে চলমান বিশৃঙ্খলা থেকে তৃতীয় লিঙ্গের এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে বের করে আনা সম্ভব হবে।

বাংলাদেশ সময়: ১৪৪০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০৪, ২০২৩
এসএস/এএটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।