ঢাকা: শাহেদ ওরফে সাঈদ ওরফে বদ্দা (৫২) এক সময় বসবাস করতেন চট্টগ্রামে। ১৯৯৬ সালে চট্টগ্রামে ব্যবসার উদ্দেশ্যে তিনি ২টি ট্রাক কিনেছিলেন।
কাভার্ডভ্যান চালক-হেলপারদের প্রলোভন দেখিয়ে শুরু করেন বিভিন্ন গার্মেন্টস পণ্য চুরির কার্যক্রম। কিছুদিনেই গড়ে তোলেন গার্মেন্টস পণ্য চুরির একটি সংঘবদ্ধ চক্র। ২০১৮ সাল পর্যন্ত তিনি নিজেই উপস্থিত থেকে চুরির কার্যক্রম চালিয়ে আসছিলেন। এরপর আড়ালে থেকে গার্মেন্টস পণ্য চুরি নিয়ন্ত্রণ শুরু করেন। এসময় থেকে সবাই তাকে বদ্দা বলে সম্বোধন করতে থাকে।
গত দেড় যুগের বেশি সময় ধরে গার্মেন্টস পণ্য চুরি জগতে মাস্টারমাইন্ড হিসেবে কাজ করছেন শাহেদ ওরফে সাঈদ ওরফে বদ্দা।
সম্প্রতি সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে ব্রাজিলে রফতানিকৃত গার্মেন্টস পণ্য চুরির ঘটনায় চক্রের মাস্টারমাইন্ড শাহেদ ওরফে সাঈদ ওরফে বদ্দা-সহ তার আরও তিন সহযোগীকে মৌলভীবাজার, গোপালগঞ্জ ও ঢাকার আশপাশের এলাকা থেকে আটক করেছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটারিয়ন (র্যাব)।
আটক বাকি আসামিরা হলেন- মো. ইমারত হোসেন সজল (৩৭), শাহজাহান ওরফে রাসেল ওরফে আরিফ (৩০), মো. হৃদয় (২৮)। অভিযানে তাদের কাছ থেকে ব্রাজিলে রফতানিকৃত চুরি যাওয়া পণ্যের পরিবহনে ব্যবহৃত ১টি কাভার্ডভ্যান জব্দ করা হয়।
শনিবার (০৪ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
তিনি বলেন, আটক আসামি শাহেদ ওরফে সাঈদ ওরফে বদ্দা এই চক্রের মাস্টারমাইন্ড। তিনি গত দেড় যুগ ধরেই গার্মেন্টস পণ্য চুরি করে আসছেন। এ পর্যন্ত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রফতানির সময় প্রায় দুই হাজারের বেশি কাভার্ডভ্যান থেকে শত শত কোটি টাকার রফতানিযোগ্য গার্মেন্টস পণ্য চুরির সঙ্গে জড়িত। আর এই চুরির ঘটনায় অর্জিত অর্থ দিয়ে শাহেদ ওরফে সাঈদ ওরফে বদ্দা মৌলভীবাজার শহরে প্রায় ১৫-২০ কোটি টাকা মূল্যের একটি বাড়ি তৈরি করেছেন। মৌলভীবাজারের দূর্লভপুর প্রায় ২০ একর জমির উপরে মাছের খামারসহ বিশাল দুটি হাঁস মুরগির খামারও রয়েছে তার। বর্তমানে তার নিজস্ব ৪টি কাভার্ড ভ্যানসহ তার সহযোগীর আরও ১৫টি কাভার্ড ভ্যান রয়েছে।
তথ্য পাওয়া গেছে, শাহেদ ওরফে সাঈদ ওরফে বদ্দার বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় ১৭-১৮টি গার্মেন্টস পণ্য চুরির মামলা রয়েছে। অধিকাংশ মামলায় তিনি কারাভোগ করেছেন। বর্তমানে তার বিরুদ্ধে আদালতে ৬টি মামলার বিচারকার্য চলমান।
কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, সম্প্রতি গাজীপুরের কোনাবাড়ির একটি তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান ২০২২ সালের ২৯ অক্টোবর গাজীপুরের কারখানা থেকে কাভার্ড ভ্যানযোগে পোশাকের একটি চালান ব্রাজিলে রফতানির উদ্দেশ্যে চট্টগ্রাম বন্দরে পাঠায়। পরের দিন ৮৯৮ কার্টুন ভর্তি সোয়েটার চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছায়। ক্রেতা-মনোনীত শিপিং প্রতিষ্ঠান ১ লাখ ২৫ হাজার ডলারেরও বেশি মূল্যের চালানটি গ্রহণ করে ব্রাজিলে পাঠায় এবং সেই মোতাবেক বন্দর থেকে চালানবহনকারী জাহাজটি রওনা দেওয়ার পরপরই ক্রেতা পুরো অর্থ পরিশোধ করে। তবে, ২০২৩ সালের ৬ জানুয়ারি ব্রাজিলের ক্রেতার কাছ থেকে পাওয়া ভিডিও দেখে হতবাক হয়ে যান গার্মেন্টস মালিকপক্ষ। সেখানে দেখা যায় যে, কিছু কার্টুন সম্পূর্ণ খালি এবং অনেকগুলো কার্টুন থেকে প্রচুর পরিমাণ পণ্য খোয়া গেছে। পরে চুরি হওয়া গার্মেন্টস পণ্যের সমপরিমাণ অর্থ জরিমানা হিসেবে পরিশোধ করতে হয় মালিকপক্ষকে। এ প্রেক্ষিতে প্রতিষ্ঠানের মালিকপক্ষ গত ২ ফেব্রুয়ারি গাজীপুরের গাছা থানায় উক্ত চুরির ঘটনায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করে। যার প্রেক্ষিতে এই চোর চক্রের সদস্যদের গ্রেফতারসহ ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটনে গোয়েন্দা নজরদারী বাড়ায় র্যাব।
তিনি বলেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, আটক মাস্টারমাইন্ড শাহেদ ওরফে সাঈদ বদ্দার নির্দেশে ও ছত্রছায়ায় বাংলাদেশের প্রায় অধিকাংশ গার্মেন্টস পণ্য চুরির ঘটনা সংঘটিত হয়ে থাকে। ৪০-৫০ জনের এই চক্রে রয়েছে অসাধু ড্রাইভার, হেলপার, গোডাউন মালিক, গোডাউন এলাকার আশ্রয়দাতা, অত্যন্ত দক্ষ কুলি সর্দারসহ একদল লেবার। প্রাথমিক পর্যায়ে তারা ট্রান্সপোর্টে গার্মেন্টেসের মালামাল বহন শুরু করে। একপর্যায়ে তারা গার্মেন্টস পণ্য পরিবহনের সঙ্গে সম্পৃক্ত কাভার্ডভ্যানের ড্রাইভার ও হেলপারদের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলে এবং অল্প সময়ে বেশি অর্থ লাভের প্রলোভন দেখিয়ে গার্মেন্টস পণ্য চুরির কাজে উৎসাহিত করে।
প্রত্যেকটি চুরির ঘটনা সংঘটনের আগে চালকদের মাধ্যমে বিদেশে রাফতানিকৃত গার্মেন্টস পণ্যের স্যাম্পল নিয়ে চোরাইকৃত পণ্যের সম্ভাব্য বিক্রয়মূল্য নির্ধারণ করতো। চুরির জন্য নির্ধারিত গার্মেন্টস পণ্যের আনুমানিক মূল্য যদি ১২-১৫ লাখ টাকা হতো তাহলেই শুধু তারা চুরির কার্যক্রম চালাতো। এই টাকা থেকে কাভার্ড ভ্যানের ড্রাইভার ৩০ হাজার, হেলপার ২০ হাজার, গোডাউনের মালিক ৫০ হাজার, গোডাউন এলাকার শেলটার পার্টি ৬০ হাজার, কার্টুন প্যাকেজিং এক্সপার্ট ১০ হাজার, অন্যান্য লেবার প্রত্যেকে ২/৩ হাজার টাকা পেত। বাকি টাকা তাদের গ্রুপের মধ্যে অবস্থান অনুযায়ী বন্টন করে নিতো।
চালক এবং হেলপার পণ্যবাহী কাভার্ড ভ্যানটি নির্দিষ্ট গোডাউনে নিয়ে আসলে চক্রের অন্যান্য সদস্যরা কার্টুন কেটে গার্মেন্টস পণ্যগুলো আলাদা করে রাখত। প্রথমত তারা ১০ পিসের কার্টুন থেকে ০৪ পিস এবং ২০ পিসের কার্টুন থেকে ৬-৮ পিস গার্মেন্টস পণ্য সরিয়ে রেখে পুনরায় কার্টুনগুলো প্যাকেজিং করে দ্রুত কাভার্ডভ্যানে লোড করে বন্দরের উদ্দেশ্যে রওনা দিত। পরে চক্রের অন্য সদস্যরা চোরাই পণ্যগুলো তাদের নিজস্ব পিকআপ বা কাভার্ড ভ্যানযোগে অন্য একটি গোডাউনে এক থেকে দেড় মাস পর্যন্ত সংরক্ষণ করতো। ট্রান্সপোর্টের মালামাল যখন বিভিন্ন দেশে রফতানির উদ্দেশে বন্দর থেকে দেশের বাইরে চলে যেত তখন তারা চোরাই পণ্যগুলো রাজধানীর উত্তরাসহ বিভিন্ন অসাধু বায়িং হাউজের কাছে বিক্রি করে দিত।
আটক আসামিরা আরও জানায়, ব্রাজিলে রফতানিকৃত পণ্য চুরির ঘটনাও শাহেদের নির্দেশে সংঘটিত হয়। ২০২২ সালের ২৯ অক্টোবর গাজীপুর থেকে গার্মেন্টস পণ্য কাভার্ডভ্যানে লোড করে সন্ধ্যার সময় চট্টগ্রাম বন্দরের উদ্দেশে যাত্রা করে। কাভার্ডভ্যানে পণ্য লোডের পর গার্মেন্টস কর্তৃপক্ষ ড্রাইভার শাহজাহানের কাছে স্যম্পল হিসেবে কিছু সোয়েটার দেয়। ড্রাইভার শাহজাহান স্যাম্পল পাওয়ার পরপরই ছবি তুলে মোবাইলের মাধ্যমে মূলহোতা শাহেদের কাছে পাঠায়। শাহেদ স্যাম্পল পেয়ে এই চুরির ঘটনা বাস্তবায়নকারী আসামি তাওহীদুল ওরফে কাওছার ওরফে বড় কাওছারের কাছে পাঠায়। পণ্যের গুনগত মান ও বাজারমূল্য বিবেচনা করে এই চালানটিতে চুরির নির্দেশ দেয়।
মাস্টারমাইন্ডের নির্দেশ অনুযায়ী কাওছার চালকের সঙ্গে যোগাযোগ করে চুরির মূল প্লট বাস্তবায়ন করে। পরিকল্পনা অনুযায়ী কাওছারের নির্দেশে চালক ও হেলপার ২৯ অক্টোবর মধ্যরাতে ডেমরা থানাধীন মিরপাড়াস্থ আয়েশা প্যাকেজিং ভবনের গোডাউনে কাভার্ডভ্যানটি পার্ক করিয়ে উক্ত চুরির ঘটনাটি ঘটায়। পূর্বে থেকে আয়েশা প্যাকেজিং ভবনের গোডাউনে অপেক্ষারত কুলি সর্দার নাজিম, স্থানীয়ভাবে সেল্টারদাতা মাসুম-মাসুদসহ অজ্ঞাতনামা ৫/৭ জন লেবার নিয়ে মূলহোতা কাওছার প্রত্যেকটি কার্টুন থেকে ৩০-৩৫% পণ্য সরিয়ে পুনরায় প্যাকেজিং করে কাভার্ডভ্যানটি বন্দরের উদ্দেশে পাঠিয়ে দেয়। এ ঘটনায় কার্টুন প্যাকেজিংয়ে অত্যন্ত দক্ষ কুলি সর্দার নাজিম অন্যান্য লেবারদের নিয়ে কাভার্ডভ্যান থেকে কার্টুন আনলোড থেকে শুরু করে কার্টুন থেকে পণ্য সরিয়ে পুনরায় প্যাকেজিং এবং কাভার্ডভ্যানে কার্টুন লোডের কাজটি করেছে। উল্লেখ্য, এই চুরির ঘটনার সঙ্গে জড়িত কাওছার, নাজিম ও মাসুম ওরফে মাসুদকে রাজধানীর ডেমরা থেকে গত ২০২২ সালের ২৪ ডিসেম্বর র্যাব-৪ কর্তৃক অপর একটি গার্মেন্টস পণ্য চুরির ঘটনায় হাতেনাতে গ্রেফতার করা হয় এবং বর্তমানে আসামিরা জেলহাজতে রয়েছে।
তিনি বলেন, আটক আসামি ইমারত হোসেন সজল গত ২০১২ সাল থেকে ঢাকার উত্তরায় গার্মেন্টস পণ্যের স্টকলটের ব্যবসা শুরু করেন। ব্যবসার সুবাদে গার্মেন্টস পণ্য চুরি জগতের গডফাদার শাহেদ, কাউছারসহ অন্যান্য সদস্যদের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। শাহেদের মাধ্যমে কমদামে চোরাইকৃত গার্মেন্টস পণ্য কিনে স্টক করে সুবিধাজনক সময়ে বেশি দামে স্থানীয় মার্কেটসহ বিভিন্নভাবে বিক্রয় করতেন। গত ২ বছরে সে শাহেদের মাধ্যমে ১৫০-২০০টি চুরির ঘটনায় চোরাইকৃত গার্মেন্টস পণ্য ক্রয় ও বিক্রয় করেছে। তার এই চোরাইকৃত কিছু কিছু গার্মেন্টস পণ্য বিভিন্ন মাধ্যমে হাত বদল হয়ে বিদেশেও রফতানি হয়েছে বলে জানা যায়। তিনি অবৈধ পথে কোটি টাকার অধিক স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের মালিক হয়েছে যার মধ্যে গ্রামে ৩০ লাখের বেশি টাকার একটি বাড়ি ও বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে ৩০-৩৫ লাখ টাকার বিনিয়োগ রয়েছে।
আটক শাহজাহান ওরফে রাসেল ওরফে আরিফ প্রথমে কাভার্ড ভ্যানের হেলপার হিসেবে কাজ শুরু করেন। তিনি ৭ বছর আগেই এই চোর চক্রের মাস্টারমাইন্ড শাহেদের নিজস্ব কাভার্ডভ্যানের চালক হিসেবে কাজ শুরু করেন। সেই সুবাদে চালক শাহজাহান এ চক্রের অন্যতম সদস্য। তিনি ব্রাজিলে রফতানিকৃত চুরি হওয়া গার্মেন্টস পণ্য বহনকারী কাভার্ডভ্যানের চালক হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন। বিগত ৬-৭ বছরে তিনি প্রায় শতাধিক চুরির সঙ্গে জড়িত থাকার বিষয়ে তথ্য প্রদান করে। তার বিরুদ্ধে গার্মেন্টস পণ্য চুরির ২টি মামলা রয়েছে বলে জানা যায়।
আটক হৃদয় এই চক্রের মাস্টারমাইন্ড শাহেদের নিজস্ব কাভার্ডভ্যানের হেলপার হিসেবে কাজ করতেন। তিনি ০৬-০৭ বছর ধরে এই চুরি চক্রের সঙ্গে জড়িত। তিনি গার্মেন্টস পণ্য চুরির বহনকারী কাভার্ডভ্যানের হেলপারের দায়িত্ব পালন করতেন। তিনি বিগত ৬-৭ বছরে প্রায় শতাধিক চুরির সঙ্গে জড়িত থাকার বিষয়ে তথ্য প্রদান করেন। তার বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে ১টি মামলা রয়েছে বলে জানা যায়।
বাংলাদেশ সময়: ১৬১৮ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০৪, ২০২৩
এসজেএ/এসএ