পাবনা: দেশের অন্যতম গ্রন্থের সমাহার সমৃদ্ধ লাইব্রেরির মধ্যে জেলা শহর পাবনার অন্নদা গোবিন্দ পাবলিক লাইব্রেরির নাম সবারই জানা। শতবের্ষর এই গ্রন্থাগারে রয়েছে প্রায় তিনশ বছরের পুরাতন তালপাতার পুঁথি আর তুলোট কাগজে হাতে লেখা বই।
পাঠক সমাগম তেমন না থাকলেও নতুন প্রজন্মের কাছে ইতিহাস ঐতিহ্য তুলে ধরার এক ব্যতিক্রমী উদ্যোগ। বই পড়ার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টির লক্ষ্যে প্রতিবছর এই আয়োজন করে আসছেন কর্তৃপক্ষ। তবে লাইব্রেরি ভবনের সমনে বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম বকুল স্বাধীনতা চত্বরে চলছে মাসব্যাপী একুশে বইমেলা। মেলা প্রাঙ্গণে ক্রেতা সমাগম থাকলেও লাইব্রেরি প্রাঙ্গণে তেমন দর্শক সমাগম হচ্ছে না।
জেলা শহর পাবনার প্রাণ কেন্দ্রে গোপালপুর মৌজায় দেশের অন্যতম গ্রন্থ সমৃদ্ধ অন্নদা গোবিন্দ পাববিল লাইব্রেরির অবস্থান। প্রায় ১৩২ বছরের এই গ্রন্থাগার এই জেলা শহরের জ্ঞান পিপাসু মানুষের মাঝে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে এখনো।
১৮৯০ খ্রিস্টাব্দে বৃহত্তর পাবনা জেলার তাঁতীবন্দের বিদ্যানুরাগী জমিদার অন্নদা গোবিন্দ চৌধুরী এটি প্রতিষ্ঠা করেন। ১৩ শতাংশ জমির ওপরে নির্মিত দুই কক্ষের সেই পুরাতন ভবন এখন আধুনিকতার ছোঁয়ায় ৪তলা হয়েছে। বর্তমানে এই লাইব্রেরিতে প্রায় ৩০ হাজার গ্রন্থের সমাহার রয়েছে। আর এর মধ্যে প্রায় দুই থেকে তিনশ বছরের পুরাতন তালপাতার পুঁথি ও তুলোট কাগজে হাতে লেখা গ্রন্থ সংগৃহীত আছে। গ্রন্থাগারে সংগৃহীত বেশিরভাগ বই পড়া বা দেখার সুযোগ থাকলেও শতবর্ষের সংগৃহীত ঐতিহাসিক পুঁথি উন্মুক্ত করা হয় এই ভাষার মাসে। এ সময় এক সঙ্গে ১০ হাজারেরও বেশি দুস্প্রাপ্য গ্রন্থের প্রদর্শন করা হয়।
শুধু এই মাসে প্রদর্শনী চলাকালীন লাইব্রেরির কার্যক্রম বন্ধ রেখে সব শ্রেণীপেশার মানুষের দেখার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয় গ্রন্থাগার প্রাঙ্গণ। বিগত দুই বছর করোনা কালীন প্রদর্শন কার্যক্রম বন্ধ ছিল। এই বছরে নতুন আঙ্গিকে প্রর্দশনী স্থানে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সমৃদ্ধ বই দিয়ে মুজিব কর্নার স্থাপন করা হয়েছে।
দীর্ঘ ৪০ বছর ধরে এই পাবলিক লাইব্রেরির সঙ্গে সম্পৃক্ত একজন দর্শনার্থী ও বইপ্রেমী জানান, এক সময় আমি এই লাইব্রেরির সদস্য ছিলাম। সময়ের সঙ্গে এখন সদস্য না থাকলেও নিয়মিত দৈনিক পত্রিকা ও বই পড়তে আসি। বেশ কয়েক বছর ধরে এখানে পুস্তক প্রর্দশনী হচ্ছে। এটা একটা দারুন উদ্যোগ। আমি এক সঙ্গে অনেক বইয়ের ছবি দেখতে পারছি। নোট করে রাখছি বই ও লেখকের নাম। এবার দেখলাম পাবনার অনেক লেখকের বই রয়েছে এখানে। তবে প্রচার প্রচারনা কম থাকায় এই উদ্যোগ সফল হচ্ছে না। তাই কর্তৃপক্ষের আরও সুন্দরভাবে দর্শক আকৃষ্ট করা যায় সেই রকম প্রচার প্রচারনা করা দরকার। তবেই মনে হয় নতুন প্রজন্মের ছেলে মেয়েরা দেখতে আসবে উপকৃত হবে।
পুস্তক প্রর্দশনী দেখতে আসা স্থানীয় এক স্কুল শিক্ষার্থী বলেন, বইমেলাতে এসেছিলাম স্যারের সঙ্গে। স্যার আমাদের বেশ কয়েকজনকে এখানে নিয়ে আসলেন। খুব ভালো লাগছে। এক সঙ্গে অনেক বই দেখে বেশ মনে হচ্ছে সব বই নিয়ে নিতে। পাঠ্য বইয়ের পাশাপাশি আমাদের বাইরের জ্ঞান অর্জনের জন্য এই বই অনেক সহায়ক মনে হয়েছে। এখন থেকে সময় নিয়ে নিয়মিত লাইব্রেরিতে আসবো।
পুস্তক প্রর্দশনী দেখতে আসা স্থানীয় এক মাদরাসার বাংলা বিভাগের শিক্ষক বলেন, চাকরির সুবাদে পাবনাতে আসা। বইমেলাতে এসে হঠাৎ করে চোখে পরলো সামনে পাবলিক লাইব্রেরি। সেখানে একটি বিলবোর্ড দেওয়া আছে পুস্তক প্রর্দশনীর। এখানে এসে বইয়ের সংগ্রহ দেখে আমি অবাক হয়ে গেছি। পাঠ্যবইয়ে পড়েছি তালপাতা শিলা পাথর অথবা তুলট কাগজের ইতিসাস। এখানে এসে সেটি বাস্তবে দেখতে পেলাম। আমি অভিভূত আয়োজকদের অসংখ্য ধন্যবাদ।
পাবলিক লাইব্রেরির বর্তমান লাইব্রেরিয়ান আহসানুল আলম বকুল বলেন, দীর্ঘ ২০ বছর চাকরি করছি এই প্রতিষ্ঠানে। পরিচালনা পর্ষদ দীর্ঘ বেশ কয়েক বছর ধরে এই ব্যতিক্রম আয়োজন করে আসছেন। এর ফলে বইগুলো উন্মুক্ত ভাবে দেখার সুযোগ যেমন পাচ্ছেন সবাই অন্যদিকে সেটি পরিচ্ছন্ন করা যায়। করোনাকালীন দুই বছর এই আয়োজন বন্ধ ছিল। নতুন প্রজন্মসহ জ্ঞানপিপাসু মানুষের জন্য আমাদের এই আয়োজন। এবারে আমাদের নতুন সংযোজন মুজিব কর্নার। বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের সব বই নিয়ে এবারের নতুন সংযোজন করা হয়েছে।
পাবনা অন্নদা গোবিন্দ পাবলিক লাইব্রেরির মহাসচিব প্রবীণ সাংবাদিক আব্দুল মতিন খান বলেন, ১৩২ বছরের এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ৪২ বছরের সম্পর্ক আমার। এই গ্রন্থাগারটি এতটাই সমৃদ্ধ যে এখানে শুধু জ্ঞান আহরণের জন্যই মানুষ বা পাঠক আসে না এখানে সংগৃহীত বই এর সহযোগিতা নিয়ে গবেষণা করে থাকেন অনেকেই। মুক্তিযুদ্ধের বইসহ বাংলা সাহিত্য, জীবনী, আইন পেশার বই যা রয়েছে সেটি দেশের খুব কম গ্রন্থাগারে পাওয়া যাবে।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন অনেক বই অযত্নে অবহেলায় খোয়া গেছে। তবে এখনো যে সংগ্রহ রয়েছে সেটি বাংলা একাডেমির পরে আমাদের এখানে রয়েছে। কয়েকশ বছরের পুরাতন তালপাতা ও তুলট কাগজের ওপরে লেখা বই আমাদের লাইব্রেরিতে রয়েছে। সমৃদ্ধ একটি জ্ঞানের ভাণ্ডার বলা যায়। প্রচার প্রচারনা বিষয়ে কিছুটা নতুনত্ব আনতে হবে এটা ঠিক। তবে আগে যে পাঠকের সমাগম হত এখন সেটি অনেকাংশে কমে গেছে। তাই চেষ্টা করছি পাঠক বৃদ্ধির জন্য। আগামীতে নতুনভাবে নতুন আঙ্গিকে এটি উপস্থাপন করার ব্যবস্থা করা হবে।
প্রায় ৩২ হাজার গ্রন্থের সমাহার নিয়ে কালের সাক্ষী হয়ে এখনো জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে অন্নদা গোবিন্দ পাবলিক লাইব্রেরি। শতবর্ষের এই গ্রন্থাগারে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সমৃদ্ধ প্রায় ১০ হাজার বইসহ উপন্যাস ও সাহিত্য রয়েছে আরও প্রায় ১০ হাজার। দেশ ও বিদেশের বিভিন্ন লেখকের জীবনী রয়েছে প্রায় ৪ হাজার। ইতিহাস ঐতিহ্যের ওপরে বই রয়েছে ৩ হাজার। বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত ম্যাগাজিন রয়েছে প্রায় ১৫ হাজার। আইন সহায়ক বই রয়েছে প্রায় ৪ হাজার। প্রতিদিন সকাল ১০ থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত খোলা থাকছে লাইব্রেরি প্রাঙ্গণ।
এই পুস্তক প্রদর্শনী শুরু হয়েছে ২১ ফেব্রুয়ারি (মঙ্গলবার) শেষ হবে ২৮ ফেব্রুয়ারি (মঙ্গলবার)।
বাংলাদেশ সময়: ২১০৩ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৬, ২০২৩
আরএ