ঢাকা, শনিবার, ১৫ আষাঢ় ১৪৩১, ২৯ জুন ২০২৪, ২১ জিলহজ ১৪৪৫

জাতীয়

রাজধানীজুড়ে ছিনতাই-টানাপার্টির দৌরাত্ম্য

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫৩২ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৮, ২০২৩
রাজধানীজুড়ে ছিনতাই-টানাপার্টির দৌরাত্ম্য

ঢাকা: বিমানবন্দর থেকে উত্তরা এলাকা দিয়ে বাসে করে যাচ্ছিলেন সৈয়দ মাহমুদুল হাসান। বাসে জানালার পাশের সিটে বসে মোবাইল ফোনে কথা বলছিলেন তিনি।

বাসটি উত্তরা হাউজবিল্ডিং এলাকায় পৌঁছালে বাইরে থেকে জানালায় হাত গলিয়ে মাহমুদুলের মোবাইল ফোনটি ছিনিয়ে নেয় এক ছিনতাইকারী। এতে হতভম্ব হয়ে পড়েন মাহমুদুল হাসান।

এরপর চেচিঁয়ে ছিনতাইকারী বললেও বাস থেকে নামার সুযোগ পাননি এই ভুক্তভোগী। ততক্ষণে মোবাইল ফোনটি নিয়ে পালিয়ে যায় ছিনতাই চক্রের সদস্যরা। ঘটনাটি ঘটেছে গত ২৯ জানুয়ারি (রোববার)। এরপর বাস থেকে নেমেই তিনি উত্তরা পশ্চিম থানায় গিয়ে একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। কিন্তু এতদিনেও তার ছিনতাই হওয়া মোবাইল ফোনটি উদ্ধার করতে পারেনি পুলিশ।

সৈয়দ মাহমুদুল হাসান বাংলানিউজকে বলেন, তিনি একজন শিক্ষার্থী। গাজীপুরের বোর্ডবাজারের উত্তর খাইলকুর এলাকায় পরিবারের সঙ্গে থাকেন। তিনি বলেন, বিমানবন্দর থেকে বাসে করে বাসায় ফিরছিলাম। আমাদের বাসটি যখন উত্তরা হাউজবিল্ডিং আসে তখন বাসটি জ্যামে পরে। বাসটি জখন চলতে শুরু করে ঠিক তখন বাইরে থেকে একটি হাত এসে ছোঁ মেরে আমার মোবাইল ফোনটি ছিনিয়ে নিয়ে যায়। আমি বাস থেকে নামতে পারিনি। কিন্তু জানালা দিয়ে দেখলাম ওই ছিনতাইকারী মোবাইলটি তার অপর সহযোগীর কাছে দিয়ে সে অন্যদিকে দৌড়ে পালিয়ে যায়। আর মোবাইল নিয়ে অপরজন অন্যদিকে দৌড়ে মূল সড়ক থেকে গলিপথ ধরে চলে যায়।

তিনি বলেন, থানায় গিয়ে ছিনতাইয়ের ঘটনাটি বললে পুলিশ আমাকে হারানো মূলে একটি জিডি করতে বলেন। আর ছিনতাইয়ের বিষয়টি জিডিতে উল্লেখ করতে দেয়নি। এরপরও আমি হারানো ওই মোবাইল ফোনটি এখনও পাইনি।

রাজধানীর বিমানবন্দর থেকে উত্তরা আজমপুর, হাউজবিল্ডিং হয়ে আব্দুল্লাহপুর ও টঙ্গী পর্যন্ত সড়কে এমন ছিনতাইয়ের ঘটনা প্রায়শই ঘটছে। মোবাইল ফোন ছাড়াও যাত্রীদের অনেক মূল্যবান জিনিসও ছিনিয়ে নিয়ে যাচ্ছে ছিনতাইকারী ও টানা পার্টির সদস্যরা।  

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন অভিযানের পর ছিনতাইকারী ও টানাপার্টি চক্রের সদস্যদের উৎপাত কিছুটা কমলেও তা একেবারে নির্মূল হচ্ছে না। কিছুদিন পর আবারও শুরু হয়ে যায় ছিনতাই চক্রের সদস্যদের দৌরাত্ম্য।

এদিকে মোহম্মদপুরের তাজমহল রোড, রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুলের পশ্চিম পাশের এলাকা, ঈদগাহ মাঠ সংলগ্ন এলাকা, আদাবর, শ্যামলী থেকে রিং রোডের বিভিন্ন অলিগিলি, জাকির হোসেন রোড, বাঁশবাড়ির, চাঁদ উদ্যান, ঢাকা উধ্যানসহ বেশ কয়েকটি এলাকায় প্রায় ছিনতাইয়ের শিকার হচ্ছেন সেখানকার বাসিন্দারা। মোহম্মদপুরের বাসিন্দারা অভিযোগ করেন, এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের পাঁচটি গ্রুপ রয়েছে। এসব গ্রুপের সদস্যরাই ছিনতাই কাজে জড়িত রয়েছে।

তাপস আহমেদ নামে মোহম্মপুরের এক বাসিন্দা বলেন, মোহম্মদপুরের ঈদগাহ ময়দানের পূর্ব পার্শ্বে গলিতে দিনে-দুপুরে ছিনতাই হচ্ছে। স্কুল -কলেজ ফেরত শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে মোবাইল, টাকা-পয়সা, বাইসাইকেল, হাতঘড়ি ছিনিয়ে নিয়ে যায়। এসব ওই কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা ঘটিয়ে থাকে।

মোবাইল ভিত্তিক অ্যাপের মাধ্যমে মোটরবাইকে রাইড শেয়ার করেন আবুল হোসেন। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, বেশ কয়েকদিন আগে ধানমন্ডি থেকে রাইড নিয়ে মোহাম্মদপুরের চাঁদ উদ্যানে শেষ করি। ফেরার পথে চাদ উদ্যানে একদল ছিনতাইকারীর আঘাতের শিকার হতে হয়েছে। তারা চলন্ত মোটরবাইকের চাকায় বড় ইট-পাথরের টুকরো ছুঁড়ছিলো। চাকায় এসে ইট লাগলেও অল্পের জন্য পড়ে যাইনি। দ্রুত সেখান থেকে মোটরসাইকেল চালিয়ে বের হয়ে আসি।

এদিকে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা বলছেন, চিহ্নিত এলাকাগুলোতে টহল বৃদ্ধি করা হয়েছে। এছাড়াও বিশেষ অভিযান পরিচালনা করে ছিনতাইকারী চক্রের সদস্যদের গ্রেফতারের মাধ্যমে আইনের আওতায় নেওয়া হচ্ছে।

গত ২৬ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যা থেকে ২৭ ফেব্রুয়ারি রাত পর্যন্ত রাজধানীর কোতোয়ালী, মতিঝিল, খিলগাঁও, রামপুরা, হাতিরঝিল, সবুজবাগ, শাহজাহানপুর ও ওয়ারী এলাকায় অভিযান চালিয়ে ছিনতাইকারী চক্রের মূলহোতাসহ ৩২ সদস্যকে গ্রেফতার করেছে ল্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব-৩)। অভিযানে তাদের কাছ থেকে সুইচ গিয়ার, চাকু, ক্ষুর, এন্টিকাটার, কাঁচি, ব্লেড, ছিনতাইকৃত মোবাইল ফোন এবং নগদ টাকাসহ বিপুল পরিমাণ দেশীয় অস্ত্র জব্দ করা হয়।

সাধারণত এসব এলাকায় ছিনতাইকারী এই চক্রটির সদস্যরা ঘোরাফেরা করতে থাকে। এছাড়াও সংঘবদ্ধ ছিনতাইকারী চক্রের অন্যান্য সদস্যরা বিভিন্ন অলি গলিতে ওৎপেতে থাকে। সুযোগ পাওয়া মাত্রই তারা পথচারী, রিকশা আরোহী, যানজটে থাকা সিএনজি, অটোরিকশার যাত্রীদের ধারালো অস্ত্র দেখিয়ে সর্বস্ব লুটে নেয়। আবার চলন্ত বাস, সিএনজি অটো রিকশা থেকে হাত গলিয়ে ছোঁ মেরে মোবাইল, মানিব্যাগসহ মূল্যবান জিনিসপত্র ছিনিয়ে নিয়ে যায়।

র‌্যাব জানায়, রাজধানীর কোতোয়ালী, মতিঝিল, খিলগাঁও, রামপুরা, হাতিরঝিল, সবুজবাগ, শাহজাহানপুর ও ওয়ারী এলাকার বিভিন্ন নির্জন জায়গাতে সন্ধ্যা থেকে ভোর রাত পর্যন্ত ছিনতাইকারীদের তৎপরতা বেড়ে যায়। টার্গেট করে আগে থেকে ব্যক্তিদের অনুসরণ চালায় ছিনতাই চক্রের সদস্যরা। তারা টার্গেটেট ব্যক্তির সঙ্গে গিয়ে নিজে থেকেই বিভিন্ন ধরনের কথা বলে শুরু করেন। একপর্যায়ে কথা বলতে বলতে টার্গেটেট ব্যক্তিকে সুবিধামতো কোনো জায়গায় নিয়ে যায়। এরপর চক্রের অপর সদস্যরা সেখানে এসেই তর্ক-বিতর্ক শুরু করে। এরপর মারধর চালায় ভুক্তভোগীর ওপর। ততক্ষণে ছিনতাইয়ের কাজটি তাদের চক্রের কেউ একজন সেরে ফেলে। তাদের ছিনতাইকাজে বাধা দিলে তারা নিরীহ পথচারীদের মারধর ও ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে।

র‌্যাব-৩ এর অধিনায়ক (সিও) লেফট্যানেন্ট কার্নেল আরিফ মহিউদ্দিন আহমেদ বাংলানিউজকে বলেন, বিগত ৬ মাসে রাজধানীতে ছিনতাইকারীদের বিরুদ্ধে ৭৯টি অভিযান পরিচালনা করা হয়। এসব অভিযানে ২৬৮ জন ছিনতাইকারীকে গ্রেফতার করে র‌্যাব-৩।

তিনি বলেন, যখনই রাজধানীতে ছিনতাইকারী চক্রের দৌরাত্ম বেড়ে যায় তখনই আমরা বিশেষ অভিযান পরিচালনা করি। ছিনতাইকারীদের বিরুদ্ধে র‌্যাবের সাড়াঁশি অভিযান চলমান রাখা এবং এসব ছিনতাইকারীদের আইনের আওতায় আনতে আমরা চেষ্টা করছি।  

তেজগাঁও থানা সূত্রে জানা গেছে, ২০২২ সালের নভেম্বর থেকে ২০২৩ সালের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত রাজধানীর তেজগাঁও বিভাগের তেজগাঁও থানা পুলিশ দস্যুতা, দস্যুতার চেষ্টা ও ডাকাতি প্রস্তুতি ও ছিনতাইয়ের মতো অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকা অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ৪৩টি মামলা দায়ের করা হয়। এসব মামলা ৭৩ জন অভিযুক্তকে গ্রেফতার করা হয়।

বাংলাদেশ সময়: ১৫৩০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৮, ২০২৩
এসজেএ/এসএ
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।