ঢাকা: মেসেঞ্জার, ইমোসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ প্ল্যাটফর্মে নারী কণ্ঠে কথা বলে ফাঁদে ফেলে প্রবাসীদের অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগে গ্রেফতার হয়েছেন একটি প্রতারকচক্র।
গত ২৭ ফেব্রুয়ারি নাটোরের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে ওই চক্রের ৪ সদস্যকে গ্রেফতার করে ডিএমপির গোয়েন্দা সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম (দক্ষিণ) বিভাগ।
গ্রেফতাররা হলেন- চক্রের হোতা মো. সোহাগ আহমেদ (২০), মো. রিপন ইসলাম (৩৩), মো. সোহেল রানা (৩১) ও মো. লিটন আলী (৩০)। অভিযানে তাদের কাছ থেকে প্রতারণার কাজে কয়েকটি মোবাইল ফোন জব্দ করা হয়।
ঢাকা ডিএমপির গোয়েন্দা (ডিবি) সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম (দক্ষিণ) বিভাগের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) মো. সাইফুর রহমান আজাদ এসব তথ্য নিশ্চিত করেন।
মো. সোহাগ আহমেদ চক্রটির প্রধান এবং তিনিই নারী কণ্ঠে প্রতারণার জাল ফেলতেন বলে জানান এডিসি মো. সাইফুর রহমান আজাদ। এবং এভাবে প্রবাসীদের সঙ্গে প্রতারণা করে জমি-বাড়ি কিনে কোটিপতি হয়েছেন সোহাগ।
বাংলানিউজকে এডিসি মো. সাইফুর রহমান আজাদ বলেন, গ্রেফতার প্রতারকচক্রের সদস্যরা মূলত মধ্যপাচ্যে অবস্থানরত প্রবাসীদের টার্গেট করতেন। ফেসবুকে সুন্দরী নারীদের ছবি ব্যবহার করে ভুয়া আইডি খুলে প্রবাসীদের ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠাতেন তারা। এরপর বন্ধুত্ব করে ইমো নাম্বার নিয়ে কৌশলে তা হ্যাক করতেন। এরপর ভুক্তভোগীদের পরিবারের কাছ থেকে টাকা আত্মসাৎ করতেন তারা।
তিনি বলেন, এই প্রতারকরা ইমোতে মেয়ে সেজে কথা বলতো। পরে ভিডিও কলের মাধ্যমে প্রবাসীদের অন্তরঙ্গ মুহূর্তের স্ক্রিনশট নিয়ে ব্ল্যাকমেইলের মাধ্যমে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিত।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতাররা এ অপরাধের কথা স্বীকার করেছেন বলে জানান ডিবির এই কর্মকর্তা।
প্রতারকদের এমন প্রতারণার শিকার ইরাক প্রবাসী মো. সামছুল হক (৩৪) ও তার পরিবারের সদস্যারা।
গত বছরে সামছুলের ব্যবহৃত ইমু নাম্বারটি হ্যাক হয়ে যায়।
এরপর, গত বছরের ২৬ আগস্ট তার বোন সুরাইয়া আক্তারের ইমোতে একটি ভয়ের মেসেজ আসে। মেসেজের কণ্ঠ ঠিক তার ভাইয়ের মতই।
ওই মেসেজে বলা হয়- “আমি অসুস্থ, আমি বর্তমানে হাসপাতালে ভর্তি আছি, চিকিৎসার জন্য টাকা দরকার। ” সেই সঙ্গে বিকাশ ও নগদ নাম্বার দেওয়া হয়। এতে পরিবারের সবাই চিন্তিত হয়ে পড়েন।
এমন খবরে দুদিনের মধ্যেই ভাইয়ের চিকিৎসায় বিভিন্ন সময়ে বিকাশ ও নগদ নম্বরে বিভিন্ন দোকান থেকে সর্বমোট ৫ লাখ ৮৬ হাজার টাকা দেন সুমাইয়া ও তার পরিবার।
এদিকে, ঘটনার ৪দিন পর পরিবারের খোঁজ নিতে সুদূর ইরাক থেকে ফোন করেন সামছুল। তখন তার অসুস্থতার খবর জানতে চায় পরিবারের সদস্যরা। সব শুনে আকাশ থেকে পড়েন সামছুল। সবাই বুঝতে পারেন যে তারা প্রতারিত হয়েছেন।
এ বিষয়ে ভুক্তভোগীর সুমাইয়া আক্তার বাংলানিউজকে বলেন, যখন ভাইয়ের সঙ্গে কথা হয়, তখন আমরা বুঝতে পারি যে আমরা প্রতারণার শিকার হয়েছি। পরে হাজারীবাগ থানায় গিয়ে প্রথমে একটি জিডি করি। পরে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে একটি মামলা (নং-৪২) দায়ের করা হয়। পরে অভিযান চালিয়ে আসামিদের গ্রেফতার করে ডিবি।
শুধু ইরাক প্রবাসী সামছুল হক ও তার পরিবারের সদস্যরাই নয়, এমন অনেক প্রবাসী ও তাদের পরিবার প্রতারিত হয়ে হারিয়েছেন লাখ লাখ টাকা।
যেভাবে প্রতারক হয়ে উঠে সোহাগ
তদন্ত সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা জানান, প্রতারক চক্রের মাস্টার মাইন্ড গ্রেফতার আসামি মো. সোহাগ আহমেদ (২০) । উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করে তিনি মোবাইল হার্ডওয়্যার অ্যান্ড সফটওয়্যার ফিক্সিংয়ের কাজ শেখেন। তিনি নারী কণ্ঠে কথা বলতেও পারদর্শী। এসব দক্ষতা ব্যবহার করে প্রতারণার ফাঁদ পেতে রাতারাতি বড়লোক হওয়ার লোভে পড়েন তিনি। টার্গেট হিসেবে বেছে নেন ফেসবুক, মেসেঞ্জার, ইমো ব্যবহারকারী মধ্যপ্রাচ্য প্রবাসীদের। প্রতারণার কাজে তার সহযোগী হিসেবে নিজের বড়ভাই রিপন ইসলামকে সঙ্গে নেন তিনি। এই প্রতারক চক্রে রয়েছে আরও দুই সহযোগী সোহেল রানা ও লিটন আলী।
গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, প্রতারক সোহাগের বড় ভাই রিপন প্রতারণার মাধ্যমে আত্মসাৎ করা অর্থ ক্যাশ-আউটের কাজ করতেন। প্রতারণায় অর্জিত লাখ লাখ টাকা দিয়ে চক্রের মাস্টার মাইন্ড সোহাগ আহমেদ ও তার বড় ভাই রিপন ইসলাম নাটরের বিভিন্ন স্থানে জমি কিনেছে। বিলাসবহুল বাড়িও তৈরি করেছেন তারা।
প্রতারণার কৌশল
তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, গ্রেফতার আসামিরা ফেসবুকে সুন্দরী মেয়েদের ছবি দিয়ে ফেক অ্যাকাউন্ট খুলতেন। সেসব অ্যাকাউন্ট থেকে প্রবাসীদের ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠাতেন। প্রবাসীরা রিকোয়েস্ট অ্যাকসেপ্ট করলে মেসেঞ্জারে তাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তুলতেন। এক পর্যায়ে মেয়েদের কণ্ঠে কথাও বলা শুরু করতেন। এভাবেই সখ্যতা বাড়ালে এক সময় ভিডিও কলের প্রলোভন দেখিয়ে ইমো নাম্বার নেওয়া হতো প্রবাসীদের।
তারা অনলাইনে কিছু ভার্চুয়্যাল মোবাইল নাম্বার দেয়। টার্গেট করা ভুক্তভোগীরা সেই নাম্বারে কল করতে পারে না। এই সময়ের মধ্যে প্রতারকরা টার্গেট ভুক্তভোগীদের নাম্বার দিয়ে নিজেদের ডিভাইসে ইমু অ্যাকাউন্ট খোলার চেষ্টা করে।
এতে ভুক্তভোগীর কাছে যাওয়া ওটিপি (OTP) কোর্ড নাম্বার কৌশলে নিয়ে নেয় প্রতারকরা। এরপর ভুক্তভোগী প্রবাসীদের ইমো অ্যাকাউন্টটি নিজেদের আয়ত্বে নিয়ে পাসওয়ার্ড পরিবর্তন করে ফেলে তারা।
পরে প্রতারকরা ইমো বেটা (imo beta) ভার্সন ব্যবহার করে ভুক্তভোগীদের ইমু অ্যাকাউন্টের নাম্বার পরিবর্তন করে নেয়। এরপর প্রতারকরা তাদের ইমো অ্যাকাউন্টের প্রিভিয়াস হিস্টোরি (Previous History) থেকে পরিবার এবং আত্মীয়-স্বজনের নাম্বার সংগ্রহ করে তাদের কাছ থেকে প্রতারণার মাধ্যমে টাকা আদায় শুরু করে।
তদন্ত সংশ্লিষ্টরা আরও জানায়, এছাড়াও প্রতারকরা বিভিন্ন ফেক ফেসবুক ও মেসেঞ্জার অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে বিভিন্ন মেয়েদের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তোলে। পরে প্রতারকরা ভুক্তভোগীকে প্রলুব্ধ করে ভিডিওকলে অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি তুলে এবং ভুক্তভোগীকে বিভিন্ন পর্ণ সাইটের ছবি/ভিডিও পাঠায়। সেগুলোর স্ক্রিনশট নিয়ে ব্ল্যাকমেইলের মাধ্যমে লাখ লাখ টাকা আত্মসাৎ করে প্রতারকচক্রের সদস্যরা।
বাংলাদেশ সময়: ১৩০০ ঘণ্টা, মার্চ ২, ২০২৩
এসজেএ/এসএএইচ