ঢাকা, শনিবার, ২৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

জাতীয়

হালখাতা জৌলুস হারানোয় ব্যবসায়ীদের শঙ্কা

গৌতম ঘোষ, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭০৮ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৪, ২০২৩
হালখাতা জৌলুস হারানোয় ব্যবসায়ীদের শঙ্কা

ঢাকা: বাঙালি সংস্কৃতির সবচেয়ে বড় উৎসব পয়লা বৈশাখ বা বাংলা নববর্ষ। আর বর্ষবরণের অন্যতম উৎসব হলো ঐতিহ্যবাহী হালখাতা।

এদিন ব্যবসায়ীরা লাল মলাটের নতুন খাতায় নতুন বছরের হিসেব শুরু করেন। বিশেষ করে তারা এ দিনটির জন্য অপেক্ষা করে থাকেন। কারণ, বছরের প্রথম দিনটিতে ব্যবসায়ী-ক্রেতাদের মধ্যে দেনা-পাওনার হিসেব হয়। দুপক্ষের মধ্যে বিশ্বাস, আস্থা ও গভীর সম্পর্কের মূল ভিত্তি এই হালখাতা।

শুধু এসবেই নয়, হালখাতা সৌজন্য প্রকাশের একটি মাধ্যম। পয়লা বৈশাখে ছোট ব্যবসায়ীরা মহাজনদের পাওনা পরিশোধ করেন। বাঙালির চির চেনা মিলনমেলার উৎসব হালখাতা উদযাপনের দৃশ্য কার্যত দেখা যায় না। প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি ও পারস্পরিক আস্থার সংকটে ঐতিহ্যবাহী এ সৌহার্দ্য অনেকটাই রং হারিয়েছে।

জৌলুস না থাকলেও পুরান ঢাকার ব্যবসায়ীরা ঐতিহ্য হিসেবে হালখাতা পালন করেন। মূলত ব্যবসায়ীরা অতীতের মতো এখন বকেয়া পরিশোধ না করায় এ আয়োজনও পিছিয়ে পড়েছে। এছাড়া বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা ও রোজা থাকায় গ্রাহকরা হালখাতা অনুষ্ঠানে তেমন অংশ নেবেন না। যে কারণে হিসেবের খাতা ফাঁকা থাকার আশঙ্কা করছেন ব্যবসায়ীরা।

জানা গেছে, বাংলা সন চালুর পর থেকে নববর্ষ উদযাপনে নানা আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। পয়লা বৈশাখের দ্বিতীয় বৃহৎ অনুষ্ঠান ছিল হালখাতা। অনুষ্ঠানটি করতেন ব্যবসায়ীরা। কৃষিভিত্তিক সমাজ ফসল বিক্রি করে হাতে নগদ পয়সা পেত। পাট ছিল নগদ পয়সার উৎস। ফসলের মৌসুমে ফলন বিক্রির টাকা হাতে না এলে কৃষকসহ প্রায় কেউই নগদ টাকার মুখ খুব একটা দেখতেন না। ফলে সারা বছর বাকিতে জিনিসপত্র না কিনে তাদের কোনো উপায় ছিল না। পয়লা বৈশাখের হালখাতা অনুষ্ঠানে তারা দোকানিদের বাকির টাকা মিটিয়ে দিতেন। অনেকে আংশিক পরিশোধ করেও নতুন বছরের খাতা খুলতেন। তারা পণ্য বাকিতে বিক্রি করতেন। সবাই সবার পরিচিত ছিলন বলে বাকি দেওয়ার বিষয়ে দ্বিধা থাকত না। টাকা কেউ মেরে দেবে না বলেই বিশ্বাস করতেন তারা। এর আগে পয়লা বৈশাখে নবাব ও জমিদারেরা পুণ্যাহ উৎসব পালন করতেন।

কিন্তু এখন দোকানগুলোয় আগের মতো এমন চিত্র দেখা যায় না। আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার হাতে লেখা খাতা থেকে অনেককে নিষ্কৃতি দিয়েছে। ১০/১৫ বছর আগেও আড়ৎ ও দোকানগুলোতে হালখাতার যে জাঁকজমক অনুষ্ঠান দেখা যেত, তা এখন আর নেই। আগে ব্যবসায়ীরা মুখের কথায় বিশ্বাস করে লাখ লাখ টাকা বাকি দিতেন। তার বেশিরভাগই উসুল হতো হালখাতার দিনে। এখন লেনদেনটা অনেকে ব্যাংকের মাধ্যমে চুকিয়ে নেন। প্রযুক্তির ছোঁয়ায় পাল্টে গেছে আয়োজনের ধরণ। সেই দিন আর নেই। নেই সেই হালখাতা উৎসবও। অথচ সার্বজনীন উৎসব হিসেবে ‘হালখাতা’ ছিল বাংলা নববর্ষের প্রাণ। বাঙালির হাজার বছরের ঐতিহ্যর এই প্রাণের হালখাতা উৎসব যেন আজ আধুনিক যুগের অনলাইন ব্যাংকিং, মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে তথ্যপ্রযুক্তির পৃথিবীর কাছে ধোপে টিকতে পারছে না।

বৃহস্পতিবার (১৩ এপ্রিল) পুরান ঢাকার শাঁখারিবাজার, তাঁতিবাজার ও শ্যামবাজারের বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সরেজমিন ঘুরে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য জানা গেছে। সরেজমিনে দেখা গেছে, রোজা ও ঈদ চলে আসায় এ বছর পয়লা বৈশাখ নিয়ে আলাদা কোনো আয়োজন করেনি পুরান ঢাকার ব্যবসায়ীরা। অথচ এ সময় ব্যবসায়ীরা দোকান-পাট পরিষ্কার, রং করাসহ বিভিন্ন সাজসজ্জা নিয়ে ব্যস্ত থাকতো। এ বছর সেরকম কিছু দেখা না গেলেও দুয়েকটি দোকানে রঙিন হাঁড়ি, সোলার ফুল, রঙিন কুলা, ঘটের দেখা মিলেছে। ব্যবসায়ীদের মনে নেই কোনো উৎসবের আমেজ। টালি খাতা, পাটি ব্যবসায়ীদের হাঁক ডাকও চোখে পড়েনি। হালখাতা উপলক্ষে ব্যবসায়ীদের আমন্ত্রণ পত্র ছাপানো, মিষ্টির অর্ডারও কমে গেছে। মোট কথা হালখাতা নিয়ে কোনো উৎসবের আমেজ নেই এ বাজারগুলোয়। মূলত ঐতিহ্য রক্ষায় নামেমাত্র হালখাতা করবেন ব্যবসায়ীরা।

কোতোয়ালি রোডের বাংলাদেশ পোদ্দারের ব্যবসায়ী সাগর ঘোষ বাংলানিউজকে বলেন, এ বছর পয়লা বৈশাখ বা হালখাতা উদযাপন নিয়ে তেমন কোনো আয়োজন নেই। রোজা ও ঈদ হওয়ায় লোকজন পরিবারের চাহিদা টেটাতেই অর্থ ব্যয় করবে। বকেয়া নিয়ে কম ভাববে তাই আয়োজন নেই বললেই চলে। তবে ঐতিহ্য হিসেবে পহেলা বৈশাখের দিন দোকানে গণেশ পূজাসহ নতুন খাতা খোলা হবে। নতুন খাতা খোলা হলেও খাতা ফাঁকাই থেকে যাবে। গত তিন বছরের বকেয়া উঠছে না। এভাবে চললে পুঁজি হারিয়ে দেউলিয়া হয়ে যাবে ব্যবসায়ীরা।

তাঁতিবাজারের স্বর্ণ ব্যবসায়ী আশুতোষ বাংলানিউজকে বলেন, এ মাসটির জন্য আগ্রহ ভরে অপেক্ষা করি। পয়লা বৈশাখে আমরা হালখাতা অনুষ্ঠান করি; নতুন খাতায় নতুন বছরের হিসাব তুলি। হালখাতার দিন সকালে গণেশ পূজার মধ্য দিয়ে দিন শুরু হয়। সারাদিন গ্রাহদের মিষ্টি মুখ করিয়ে সন্ধ্যার পর অনুষ্ঠান শেষ হয়। তবে বৈশাখ মাসব্যাপী আমাদের গ্রাহকরা আসেন তাদের পুরনো লেনদেনের হিসাব শেষ করতে। সারা বছর যারা বাকি স্বর্ণালঙ্কার কেনেন তারা বৈশাখের প্রথম দিন প্রায় সব বকেয়া পরিশোধ করেন।

কিন্তু এবার রোজা হওয়ায় গ্রাহকের সাড়া কম। সেজন্য হালখাতার আয়োজনও ছোট করে করেছি। মানুষের কাছে টাকা নেই। গত চার বছর ধরে বকেয়া তুলতে পারছি না। এ বছরও বকেয়ার খাতা ফাঁকা থেকে যাবে।

ইসলামপুরের পাইকারি কাপড়ের ব্যবসায়ী ও সমাজসেবক মো. নাসির উদ্দিন মোল্লা বাংলানিউজকে বলেন, পহেলা বৈশাখ আমাদের প্রাণের অনুষ্ঠান। এ দিনই আমরা ব্যবসায়ীরা নতুন খাতা খুলে থাকি। এদিন বছরের সব দেনা-পাওনার হিসাব নিষ্পত্তি করে পুরনো জঞ্জাল সরিয়ে নতুনভাবে বছর শুরু করি। রোজার জন্য সন্ধ্যায় মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছে। তারপর আমন্ত্রিত অতিথিদের নিয়ে ইফতার করা হবে। এরপর মিষ্টি জাতীয় খাবার দিয়ে আপ্যায়ন করা হবে।

এ বছর অবশ্য সে জৌলুস থাকবে না রোজা থাকায়। ব্যবসায়ীরাও বকেয়া পরিশোধ করবে না। তাই আয়োজন করা হয়েছে ছোট পরিসরে। ঐতিহ্য ধরে রাখতেই যা করা।

শ্যামবাজারের ব্যবসায়ী মো: ইসলাম খান বাংলানিউজকে বলেন, এবার তেমন কোনো আয়োজন বা সাজসজ্জা করা হয়নি। যাদের নিয়ে অনুষ্ঠান করবো তারা আগেই বলে দিয়েছে বকেয়া পরিশোধ করতে পারবে না। তাই অযথা টাকা নষ্ট করে কোনো লাভ নেই। আর দিন যতো যাচ্ছে হালখাতা অনুষ্ঠান ঐতিহ্য হারাচ্ছে। আধুনিক যুগে মানুষ সব ডিজিটাল হয়ে গেছে। কেউ এখন কষ্ট করে দোকানে একটা মিষ্টি খেতে আসে না। সেই আন্তরিকতা এখন আর নেই। তাই আমরাও আর আগের মতো আন্তরিকতা নিয়ে অনুষ্ঠানটি পালন করি না।

দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন বাংলানিউজকে বলেন, দেশের বর্তমান পরিস্থিতি, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি এসব কিছু মিলে সাধারণ মানুষ অনেক কষ্টে আছে। জনগণ এখন খেয়ে পরে বাঁচার চিন্তা করছে। কোনো উৎসব নিয়ে যে বিলাসিতা করবে সে সুযোগ নেই। এ বছর রোজা, ঈদ, পয়লা বৈশাখ ও হালখাতা সব অনুষ্ঠান মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে। এজন্য ঈদকে ঘিরেই ব্যবসায়ীরা সব আয়োজন করেছে।

দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্র্যান্ড আড়ংয়ের প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা আশরাফুল আলম বলেন, এ বছর রোজার শেষের দিকে পয়লা বৈশাখ পড়ায় বৈশাখ নিয়ে তেমন কোনো আয়োজন ছিল না। আমাদের সম্পূর্ণ মনোযোগ ঈদকে ঘিরে।  

বাংলাদেশ দোকান মালিক সূত্রে জানা গেছে, বৈশাখের বাজারে দেশিয় বাঁশ, বেত, কাঠের তৈরি জিনিস, মাটির তৈজসপত্র, খেলনা, প্লাস্টিকের খেলনা, বিভিন্ন ধরনের মুড়ি-মুড়কি, নাড়ু বাজারেই বিকিকিনি হয় প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার। এর বাইরে আরও প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকার অন্য পোশাক বিক্রি হয় বৈশাখী বাজারে। তাছাড়া ইলিশের বিকিকিনি হয় প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকার। একইভাবে মিষ্টির দোকানগুলোয় বিক্রি হয় ৪ থেকে ৫ হাজার কোটি টাকার মিষ্টি। সবমিলিয়ে বৈশাখে কেবল পোশাক বিক্রিই হয় প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকার।

বৈশাখী উৎসব ঘিরে আর্থিক লেনদেন স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি হয়। বাজারে বাড়ে টাকার প্রবাহ। চাঙা হয়ে ওঠে অর্থনীতি। এ সময় বাণিজ্যিক ব্যাংকের মাধ্যমে বাজারে অর্থের সরবরাহ বাড়ায় বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকগুলো তাদের এটিএম, ক্রেডিট কার্ড ও ইন্টারনেটভিত্তিক ব্যবস্থায় অর্থের পর্যাপ্ত জোগান রাখে। প্রবাসীরা তাদের পরিবার-পরিজনের কাছে বেশি রেমিট্যান্স পাঠায়। মোবাইল ব্যাংকিং ও পোস্ট অফিসের মাধ্যমেও লেনদেন বাড়ে।

উল্লেখ্য, সর্বজনীন উৎসব হিসেবে হালখাতা বাংলা নববর্ষের প্রাণ। ইতিহাস অনুযায়ী, ১৫৮৪ সালে সম্রাট আকবরের বাংলা সন প্রবর্তনের পর থেকেই এর প্রচলন হয়। পুরনো বছরের হিসাব বন্ধ করে নতুন হিসাব খোলা হয় যে খাতায় সেটিই হালখাতা। অতীতে জমিদারকে খাজনা দেওয়ার অনুষ্ঠান হিসেবে পুণ্যাহ প্রচলিত ছিল। বছরের প্রথম দিন প্রজারা সাধ্যমতো ভালো পোশাক পরে জমিদার বাড়িতে গিয়ে খাজনা পরিশোধ করতেন। তাদের মিষ্টি দিয়ে আপ্যায়ন করা হতো। জমিদারি প্রথা উঠে যাওয়ায় পুণ্যাহ বিলুপ্ত হয়েছে।

বাংলাদেশ সময়: ০৬৫৯ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৪, ২০২৩
জিসিজি/এমজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।