ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১২ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

জাতীয়

গ্রামবাসীর উদ্যোগে একে একে তিনটি কাঠের ব্রিজ

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬০১ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৭, ২০২৩
গ্রামবাসীর উদ্যোগে একে একে তিনটি কাঠের ব্রিজ

বরিশাল: বিচ্ছিন্ন এলাকা, হয়নি তেমন কোনো উন্নয়ন। এখনও মাটির রাস্তায় চলাচল করতে হয় গ্রামের মানুষকে।

সেই সাথে খেয়া পারাপার জীবনযাত্রার মানোন্নয়নকে আরও কঠিন করে তুলেছে। তবে ইচ্ছে থাকলে যে উপায় হয়, তার উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন গ্রামের কিছু মানুষ।

বরিশাল সদর উপজেলা পরিষদ থেকে ২৭-২৮ কিলোমিটর দূরে অবস্থিত টুঙ্গিবাড়িয়া ইউনিয়নের বদিউল্লাহ গ্রাম। যার একপাশে রয়েছে একই ইউনিয়নের চরকেউটিয়া গ্রাম, আর অপর পাশে চরমোনাই ইউনিয়নের মীরাবাড়ি বাজারসহ গ্রামের একটি অংশ। আর এই গ্রামগুলোর মানুষকে দীর্ঘদিন ধরে ফুলতলা (বুখাইনগর) নদীর ওপর খেয়া পাড় হয়ে ইউনিয়ন ও উপজেলা সদরের সাথে যোগাযোগ করতে হতো।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, একে তো এই তিন গ্রামজুড়ে মাটির রাস্তার আধিক্য বেশি। তার ওপর ইউনিয়ন ও উপজেলা সদরের সাথে যোগাযোগ করতে হলে পাড়ি দিতে হয় নদী। ফলে বর্ষা মৌসুমে এ অঞ্চলের মানুষের দুর্ভোগ দ্বিগুণ হয়ে যায়। সেইসাথে রাত ৯টার পর খেয়া চলাচল না করায়, তখন এ অঞ্চলের মানুষ বরিশালের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। ওই সময়ে কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে নিয়ে হাসপাতালে যেতে ভোগান্তির যেমন শেষ থাকে না, তেমনি মুমূর্ষু অনেকেরই পথেই মৃত্যু হয়ে যায়। এক কথায় এই দুই গ্রামের মানুষের ভোগান্তির কোনো শেষ নেই।

তবে স্থানীয় কিছু মানুষের তৎপরতা সম্প্রতি গ্রামের মানুষের ভোগান্তি লাঘবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে শুরু করেছে। আর এমন উদ্যোগ বরিশালজুড়ে আলোচনারও সৃষ্টি করেছে।

গ্রামবাসী জানিয়েছেন, চরমোনাই ইউনিয়নের রাজারচর গ্রামের সাথে টুঙ্গিবাড়িয়া ইউনিয়নের চরকেউটিয়া এবং বদিউল্লাহ গ্রামের বিভক্তি ঘটিয়েছে সরু হয়ে (মৃত প্রায়) যাওয়া বুখাইনগর নদী। যে নদী শুধু চরকেউটিয়া কিংবা বদিউল্লাহ গ্রামকে নয়, পার্শবর্তী চরমোনাই ইউনিয়নের একটি ওয়ার্ডের মীরাবাড়ি বাজারসহ গ্রামকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে বছরের পর বছর ধরে। তবে উন্নয়ন অবহেলিত এসব অঞ্চলের সংগ্রামী মানুষদের সরু ওই নদী পার হতে হয় এখনও খেয়া নৌকা দিয়ে।  

সম্প্রতি টুঙ্গিবাড়িয়া ইউনিয়নের চরকেউটিয়া গ্রামের বাসিন্দা ও অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক শামসুল আলম মাস্টার উদ্যোগ নিয়ে বুখাইনগর নদীর ওপর একটি কাঠের ব্রিজ নির্মাণ করেন। ওই ব্রিজ ব্যবহার করে এখন আশপাশের বেশকিছু গ্রামের মানুষ যাতায়াত করছেন আশপাশের ইউনিয়নসহ বরিশাল শহরে। পাশের বদিউল্লাহ গ্রাম ও মীরাবাড়ি বাজার সংলগ্ন এলাকায় আরও দুটি কাঠের ব্রিজ নির্মাণ করেছেন স্থানীয়রা। এই তিন ব্রিজ চালু হয়ে গেলে বরিশাল সদরের চরমোনাই, টুঙ্গিবাড়িয়া ইউনিয়নসহ পার্শবর্তী মেহেন্দিগঞ্জের জাঙ্গালিয়া, চরগোপালপুর ইউনিয়নের বেশ কয়েকটি গ্রামের প্রায় ২০ হাজার মানুষেরও ভোগান্তি লাঘব হবে।

৩৩ বছর শিক্ষকতা শেষে সিংহেরকাঠী মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে অবসর নেওয়া শিক্ষক শামসুল আলম বাংলানিউজকে বলেন, টুঙ্গিবাড়িয়া ইউনিয়নের চরকেউটিয়া গ্রামের মানুষ দীর্ঘদিন ধরে উন্নয়ন পঞ্চিত। অর্থাৎ আমরা পিছিয়ে পড়া জনপদের মানুষ। শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা সব সময় ডাক্তার দেখানোসহ যেকোন কাজে আমাদের শহরে যেতে হয় বুখানইনগর নদী পাড় হয়ে। তাও আবার ছোট ডিঙ্গি নৌকার খেয়া পাড় হয়ে। এতে মানুষের ভোগান্তির শেষ থাকে না। তাই একবার ২০০৩ সালে নিজ উদ্যোগে একটি বাঁশের সাঁকো বানিয়েছিলাম। কিন্তু আক্কাস মিয়ার লঞ্চ সেটিকে ভেঙে ফেলে দেয়। এরপর অবসরে এসে ২০২২ সালে নভেম্বরে আবারও উদ্যোগ নেই কিছু একটা করার। তবে এবার সাঁকো নয়, কাঠের ব্রিজ করবো এমন চিন্তা নিয়ে নামি। এরপর নিজের ও পরিবারের অন্য স্বজনদের সহায়তায় ৪ লাখ ২৭ হাজার টাকা ব্যয়ে চরকেউটিয়া ও রাজারচর গ্রামের মাঝে সংযোগ ঘটিয়ে কাঠের ব্রিজ নির্মাণ করি। এখানে এলাকাবাসীও ১৭-১৮ হাজার টাকা সহয়তা করেছে। আর এভাবে কাজ শেষে চলতি বছরের ৩ ফেব্রুয়ারি ২০০ ফুট লম্বা ব্রিজটি উদ্বোধন করা হয় এবং চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। ফলে এখন অনায়াসে আমাদের গ্রামের মানুষ চরমোনাই হয়ে সড়কপথে বরিশাল যেতে পারছে।

৫৩ বছর দেশ স্বাধীন হলেও চরকেউটিয়া গ্রামে কাঁচা রাস্তা ছাড়া কিছু নাই জানিয়ে তিনি বলেন, বিনা পয়সায় কাঠের এ ব্রিজ দিয়ে এখন মানুষের পাশাপাশি, বাই সাইকেল, মোটরসাইকেল, ভ্যানও চলাচল করে। এতে আমাদের গ্রামের পাশাপাশি মেহেন্দিগঞ্জের জাঙ্গালিয়া, চরগোপালপুর ইউনিয়নের বেশ কয়েকটি গ্রামের কয়েক হাজার মানুষ নির্বিঘ্নে যাতায়াত করতে পেরে খুশি। স্থানীয়রা এরইমধ্যে খুশি হয়ে হয়ে এ ব্রিজের নাম রেখেছে মাস্টার ব্রিজ।

এদিকে একই ইউনিয়ের বদিউল্লাহ গ্রামের সাথেও চরমোনাই ইউনিয়নের রাজারচরের সাথে সংযোগ ঘটাতে কাঠের ব্রিজ নির্মাণ করা হয়েছে। ব্রিজ নির্মাণ কাজের উদ্যোক্তা বীর মুক্তিযোদ্ধা আলমগীর হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, সাধারণ মানুষের জন্য যদি কিছু করা যায়, এমন চিন্তা থেকেই ভরাট হয়ে যাওয়া বুখাইনগর নদীর ওপর কাঠের ব্রিজ নির্মাণের সিদ্ধান্তের কথা গত ফেব্রুয়ারি মাসে মসজিদে বসে গ্রামবাসীকে বলি। তখন তারা সবাই বিষয়টিতে আগ্রহ প্রকাশ করেন এবং যে যার মতো গাছ ও আর্থিক সহায়তার কথা জানান।  বিভিন্ন মাধ্যমে সহযোগিতা পেয়ে ৪ থেকে সাড়ে ৪ লাখ টাকা ব্যয়ে ২ শত ফুটের বেশি ব্রিজটির নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে। ঈদের আগে মানুষের চলাচলের জন্য উম্মুক্ত করে দেওয়া হবে। তবে এর আগে খেয়া পার হয়ে, নানান দুর্ভোগের মধ্য দিয়ে জেলা সদরে যেতে হতো। কিন্তু এখন ব্রিজ পার হয়ে রাজারচর দিয়ে সড়কপথে সরাসরি বরিশাল শহরে যেতে পারবো।

স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার তরিকুল ইসলাম সোহাগ মল্লিক বলেন, এমপি, মন্ত্রী কেউ খোঁজ নেননি আমাদের। তাই গ্রামবাসী মিলে যে উদ্যোগ হাতে নিয়েছে, তার সাথে একত্মতা প্রকাশ করে আমিও ব্যক্তিগতভাবে ব্রিজ নির্মাণকাজে অংশ নিয়েছি। তাতে যদি মানুষের ভোগান্তি কিছুটা কমে।

অপরদিকে চরকেউটিয়া ও বদিউল্লাহ গ্রামের দেখাদেখি পার্শবর্তী চরমোনাই ইউনিয়নের মীরাবাড়ি বাজার ও ডিঙ্গামানিক গ্রামের সাথে সংযোগ ঘটাতেও দেড়শত ফুটের মতো লম্বা একটি কাঠের ব্রিজের নির্মাণকাজ শুরু করেছে এলাকাবাসী।

বিষয়টি নিশ্চিত করে ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার কামাল হোসন হাওলাদার বলেন, মরে যাওয়া ফুলতলা নদীকে এখন খালই বলা যায়। মাছ ধরার নৌকা, ট্রলার ছাড়া এখন কিছুই চলে না এখানে। এখন গ্রামবাসী নৌযান চলাচলের ব্যবস্থা রেখে ওই নদীর ওপর কাঠের ব্রিজ নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে। নির্মাণকাজও শেষের দিকে। এখন আমার কাছেও তারা কিছু সহযোগিতা চেয়েছেন, যা করার চিন্তাভাবনাও রয়েছে আমার। এতে চরকেউটিয়া ও বদিউল্লাহ গ্রামের মতো মীরাবাড়ি বাজারের ব্যবসায়ী ও গ্রামের মানুষের ভোগান্তি লাঘব হবে।

বাংলাদেশ সময়: ১৬০০ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৬, ২০২৩
এমএস/এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।