ঢাকা: অবকাঠামোগত উন্নয়নের নসাধারণের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়ন প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সভাপতি সুলতানা কামাল।
তিনি বলেন, বাইরের দেশে মানুষ নিয়ম মানে।
বুধবার (১৭ মে) ‘উপকূলের ইলিশ ও জেলে’ শীর্ষক জাতীয় সংলাপে সভাপতির বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন।
জাতীয় প্রেস ক্লাবের তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া হলে যৌথভাবে এ সংলাপের আয়োজন করে বাপা, সুন্দরবন ও উপকূল সুরক্ষা আন্দোলন এবং ওয়াটারকিপার্স বাংলাদেশ।
সংলাপে সুলতানা কামাল বলেন, জেলেরা কঠোর পরিশ্রম করে গভীর সাগর থেকে মাছ শিকার করে আমাদের এনে দেয়। আমাদের জেলে সমাজকে বাঁচাতে হবে। তাদের নিরাপত্তাসহ সব সুযোগ-সুবিধা সরকারকে দেখতে হবে। তাদের প্রণোদনাসহ অন্যান্য সুবিধা দিতে হবে।
বাপা’র সভাপতি বলেন, বলা হয়, টন টন ইলিশ ধরা পড়ছে। কিন্তু আমরা যারা ভোক্তা, আগে প্রায় প্রতিদিনই ইলিশ খেতাম, এখন কেন সে ইলিশ পাচ্ছি না? তাহলে টনে টনে ধরা পড়া ইলিশগুলো কোথায় যাচ্ছে?
তিনি বলেন, সরকার অনেক ভালো কাজ করছে। প্রধানমন্ত্রীর সদিচ্ছা নিয়েও কারো মনে সন্দেহ নেই। দেশে অনেক উন্নয়ন হয়েছে, তাহলে সে উন্নয়নের সুফল আমরা সবাই কেন পাচ্ছি না? কারণ সামাজিকভাবে এখনো উন্নয়ন সেভাবে হয়নি। আমাদের চিন্তা করতে হবে জেলেরা কেন বারবার সমস্যার কথা বলছেন।
তিনি আরো বলেন, নিষেধাজ্ঞার সময় পাঁচ জেলের জন্য ৪০ কেজি চাল দেওয়া হয়। কিন্তু এ দিয়ে কী তাদের হয়? তাদের ভাতার যে কার্ড দেওয়া হয়, সেখানেও অনিয়ম এবং অপ্রতুলতার কারণে অধিকাংশ জেলেরাই এ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। আবার তারা নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে কারেন্ট জাল নিয়ে মাছ ধরতে গেলে বাধা দিচ্ছি৷ কোন বিবেকে আমরা তাদের বাধা দিচ্ছি? তাদের যে চাল দেয় সেটা কী যথেষ্ট?
সর্বপ্রথম জেলেদের নিরাপত্তা, আর্থিক স্বচ্ছলতা সব বিষয় ঠিক করলেই আমরা ইলিশসহ অন্যান্য মাছ পাব। আমরা নিয়ম মানতে চাই। তবে সেটা সবাইকে মানতে হবে বলে জানান বাপা’র সভাপতি।
সংলাপে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করে শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকুয়াকালচার বিভাগের চেয়ারম্যান মীর মোহাম্মদ আলী বলেন, বিশ্বে মাছ ধরায় বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয় এবং ইলিশ ধরায় প্রথম। বাংলাদেশের পাঁচ লাখ জেলে সরাসরি ইলিশের সঙ্গে সম্পৃক্ত। জিডিপিতে এ ইলিশের একক অবদান ১২ শতাংশ এবং বিশ্বের ৮০ শতাংশ ইলিশের যোগান আসে বাংলাদেশ থেকে।
তিনি বলেন, ইলিশের সংকট এবং জেলেদের জীবনযাত্রা উন্নয়নের জন্য সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে একসঙ্গে কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। ইলিশ ধরায় অবরোধের সময়কাল আঞ্চলিকভাবে একসঙ্গে নির্ধারণ করতে হবে। জেলেদের ভরণপোষণের জন্য তহবিল গঠন করতে হবে এবং অবৈধ স্থাপনা তৈরি বন্ধ করতে হবে।
খুলনা-৬ আসনের সংসদ সদস্য মো. আখতারুজ্জামান বাবু বলেন, মূলত পলির কারণে নদীর গতিপথ পরিবর্তন হচ্ছে এবং মাছ তার আবাসস্থল ও মাইগ্রেটরি রুট পরিবর্তন করে ফেলছে। বর্তমানে শহরে ও গ্রামে কোথাও পর্যাপ্ত বর্জ্য নিঃষ্কাশনের ব্যবস্থা না থাকায় এসব ময়লা জলাশয়গুলোতে পতিত হয়ে পানি দূষিত হচ্ছে। এতে মাছের স্বাদ ও গুণগত মান নষ্ট হচ্ছে।
পটুয়াখালী-৩ আসনের সংসদ সদস্য এস এম শাহাজাদা বলেন, ইলিশ যে শুধু আমাদের রসনাবিলাসেরই অন্যতম নিয়ামক তা নয়, বর্তমানে ইলিশ আমাদের জাতীয় কূটনৈতিক কার্যক্রমের ক্ষেত্রেও প্রভাবক হিসেবে কাজ করছে। ইলিশের উৎপাদন বাড়লে এর কৃতিত্ব শুধু সরকারের। কিন্তু ইলিশ উৎপাদন কমলে এর দায় সবার। কারণ ইলিশ রক্ষায় শুধু সরকার কাজ করছে।
বাপা’র সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল বলেন, এক সমীক্ষায় তথ্য এসেছে যে, ২০১০ সালে পশুর নদীর এক লিটার পানিতে ৬০০০/৭০০০ মাছের ডিম পাওয়া যেত, কিন্তু ২০১৭ সালের গবেষণায় দেখা গেছে তা লিটারে ২৬০০ তা নেমে এসেছে। সরকারি সমীক্ষায় ইলিশের উৎপাদন বাড়লে সাধারণ মানুষ কেন তা পাচ্ছে না তা অনুসন্ধান করে বের করতে হবে।
মৎস্য গবেষক অধ্যাপক ড. সৈয়দ আলী আজহার বলেন, ইলিশ সংরক্ষণের পাশাপাশি ইলিশের সঙ্গে সম্পৃক্ত জেলেদের জন্য বেতন এবং বিপৎকালীন ইন্স্যুরেন্সের ব্যবস্থা করতে হবে, দস্যুদের থেকে রক্ষায় পর্যাপ্ত নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে এবং তাদের অধিকার রক্ষায় জাতীয় পর্যায়ে মৎস্যজীবী গ্রাম সংগঠন প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান গুলশান আরা লতিফা বলেন, সরকারের উচিত ইলিশের অভয়াশ্রমগুলোকে রক্ষায় উন্নয়ন প্রকল্পের পূর্ববর্তী গবেষণার স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা এবং ইলিশ রক্ষায় প্রণীত সুরক্ষা আইনগুলোর সঠিক বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা।
মৎস্য অধিদপ্তরের ইলিশ ব্যবস্থাপনা শাখার উপপ্রধান মাসুদ আরা মমি বলেন, ২০০২-০৩ অর্থবছরে ইলিশের উৎপাদন ভয়াবহভাবে কমলেও পরবর্তীতে সরকারের তাৎক্ষণিক পদক্ষেপে ২০০৩-০৬ সালের মধ্যে হিলশা ম্যানেজমেন্ট প্লান নেওয়া হয়। সেই কার্যক্রমের সূত্র ধরে ২০১৮ সালে মৎস্য অধিদপ্তর মৎস্য সম্পদে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করে।
সুন্দরবন ও উপকূল সুরক্ষা আন্দোলনের সমন্বয়ক নিখিল চন্দ্র ভদ্র বলেন, আমরা ইলিশকে মানুষের কাছে রাখতে চাই। নদীতে ইলিশের গতিপথ ঠিক রাখতে চাই। এ বিষয়ে আমাদের কাজ করতে হবে।
মহেশখালী, কক্সবাজার, পটুয়াখালী, বরগুনা, মোংলা ও পাইকগাছা থেকে আগত সংলাপে অংশগ্রহণকারী মৎস্যজীবী এবং মৎস্য ব্যবসায়ীরা বলেন, বছরের বিভিন্ন সময়ে ইলিশ ধরার ওপরে যে অবরোধ আরোপ করা হয় তা যেন পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের অবরোধ সময়সীমার সঙ্গে সামঞ্জস্য করে দেওয়া হয়।
এছাড়াও চলমান উন্নয়ন প্রকল্পের মালবাহী জাহাজের কারণে তাদের মাছ ধরার জাল প্রতিনিয়ত কেটে যায়। জাহাজের বর্জ্য, পোড়া তেল জলাশয়ের পানিতে পতিত হয়ে এবং কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ দূষণ উৎপাদনকারী শিল্প কারখানার বর্জ্য মাছের আবাসস্থল ধ্বংস করছে। মাঝসমুদ্রে দস্যুদের আক্রমণ এবং মাছ না পাওয়ায় মহাজনের দাদনের টাকা ফেরত না দিতে পেরে বহু জেলে ঘরবাড়ি ছেড়ে অন্যত্র স্থানান্তরিত হতে বাধ্য হচ্ছে।
বাংলাদেশ সময়: ১৭২৮ ঘণ্টা, মে ১৭, ২০২৩
এসসি/এএটি