ঢাকা, রবিবার, ১ পৌষ ১৪৩১, ১৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

জাতীয়

‘পমপম’ গ্রুপের শিকার অসংখ্য তরুণী, সাকারবার্গসহ গ্রেপ্তার ৯ 

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫৩৪ ঘণ্টা, মে ২২, ২০২৩
‘পমপম’ গ্রুপের শিকার অসংখ্য তরুণী, সাকারবার্গসহ গ্রেপ্তার ৯ 

ঢাকা: ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রাম আইডি হ্যাক করে অসংখ্য তরুণীর গোপন ছবি-ভিডিও হাতিয়ে নিয়ে ব্ল্যাকমেইলিংয়ের মাধ্যমে অর্থ দাবি করা ‘পমপম টেলিগ্রাম গ্রুপের’ মূলহোতা মার্ক সাকারবার্গ ওরফে আবু সায়েম গ্রেপ্তার হয়েছেন। তার আরও ৮ সহযোগীকেও গ্রেপ্তার করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।

অর্থ দিতে না পারলে ভিডিও কলে এসে আপত্তিকর কর্মকাণ্ড করতে বাধ্য করতো সাকারবার্গের পমপম  গ্রুপ চক্রের সদস্যরা। আর প্রস্তাবে সাড়া না দিলে ভুক্তভোগী তরুণীদের নাম-পরিচয়সহ ব্যক্তিগত তথ্য ওই গ্রুপের লাখ লাখ সাবস্ক্রাইবারের কাছে ভাইরাল করে দিত তারা।

ভুক্তভোগীদের অভিযোগের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে রাজধানীর বেইলি রোডের এক রেস্তোরাঁয় ফাঁদে ফেলে এ অপরাধীদের গ্রেপ্তার করে পুলিশ।  

মূলহোতা মার্ক-সাকারবাগ ওরফে আবু সায়েমসহ গ্রেপ্তাররা হলেন - শাহরিয়ার আফসান অভ্র, বোগদাদী শাকিল, ডিটিআর শুভ ওরফে মশিউর রহমান, মো. জসীম, ক্যাকটাস ওরফে কেতন চাকমা, এল ডোরাডো ওরফে শাহেদ, তুর্য ওরফে মারুফ এবং মিঞা ভাই ওরফে নাজমুল সম্রাট।

সোমবার (২২ মে) দুপুরে রাজধানীর মালিবাগে সিআইডি হেডকোয়ার্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে সিআইডি প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি মোহাম্মদ আলী মিয়া এসব তথ্য জানিয়েছেন।  

তিনি বলেন, আমরা দেখতে পাই, গ্রুপটি আপত্তিকর ভিডিও ভাইরাল করে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে যে কেবল টাকা আয় করছে তা নয়, চক্রটি ওইসব ভিডিও দেশে-বিদেশে বিক্রি করেও কোটি টাকা আয় করছে। মাসে ১ থেকে দুই হাজার টাকা সাবস্ক্রিপশন ফি দিয়ে মধ্যপ্রাচ্য, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, পর্তুগাল, কানাডা, আমেরিকা এবং ইংল্যান্ডের মতো দেশের অসংখ্য ক্রেতা গ্রুপটির সদস্য হয়েছেন। তারা অল্পবয়সী মেয়েদের আপত্তিকর ওইসব কন্টেন্ট কিনে সংরক্ষণ করেন।

তিনি আরও বলেন, চক্রটির নেতৃত্ব দেয় মার্ক-সাকারবার্গ নামের এক যুবক। শুরুতে খুবই চতুর এই মার্ককে চিহ্নিত করা সহজ ছিল না। মার্কের আসল নাম আবু সায়েম। বেকার সায়েম থাকে চট্টগ্রামে। এনআইডি অনুযায়ী তার বয়স ২০ বছর। তিনি চট্টগ্রামের শ্যামলী পলিটেনিক ইনস্টিটিউট থেকে ইলেকট্রিক্যালে ডিপ্লোমা করেছেন। তার বিভিন্ন অ্যাকাউন্টে কোটি কোটি টাকা লেনদেনের তথ্য পাওয়া যায়।

এরই মধ্যে এক ভুক্তভোগী এবং তার প্রেমিকার অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি পমপম গ্রুপে ছড়িয়ে দেওয়ায় ডিএমপির তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায় মার্ক-সাকারবার্গ ও তার দলের বিরুদ্ধে পর্নোগ্রাফি এবং ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট -এ মামলা করেন।

সিআইডি প্রধান জানান, তথ্য প্রযুক্তির সহায়তায় চট্টগ্রামের লালখান বাজার এলাকায় অভিযান চালিয়ে মার্ক ওরফে সায়েমকে গ্রেপ্তার করা হয়। মার্কের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, তার ঘনিষ্ঠ দুই বন্ধু শাহরিয়ার আফসান অভ্রকে চট্টগ্রামের হাউজিং এলাকা থেকে এবং বোগদাদী শাকিলকে উখিয়া থেকে গ্রেপ্তার করা হয়।

তিনি বলেন, মার্ক ওরফে সায়েমের মোবাইল ফোন তল্লাশি করে তার আইডিটি লগইন করা অবস্থায় পাওয়া যায় এবং নিশ্চিত হওয়া যায় যে আবু সায়েমই মার্ক সাকারবার্গ। তাকে জিজ্ঞাসাবাদে পমপম গ্রুপের যতগুলো চ্যানেল এবং গ্রুপ আছে তার এডমিনদের আসল নাম-পরিচয় পাওয়া যায়। এডমিনদের কাজ ছিল মার্কের হয়ে নতুন নতুন কন্টেন্ট জোগাড় করা। নতুন কন্টেন্ট পেতে তারা ফেক এনআইডি বানিয়ে টার্গেটের ফেসবুক বা ইনস্টাগ্রাম আইডি হ্যাক করতো এক সময়।

অতিরিক্ত আইজিপি মোহাম্মদ আলী মিয়া বলেন, ভুক্তভোগী তরুণীদের সাবেক প্রেমিকেরাই নতুন নতুন কন্টেন্ট দিচ্ছে। অর্থাৎ সুসময়ে প্রেমিকার যেসব অন্তরঙ্গ মুহূর্ত তারা ক্যামেরাবন্দি করেছে, সেগুলোই প্রতিশোধের নেশায় তুলে দেয় মার্ক-সাকারবার্গদের গ্রুপে। মার্ক তার এডমিনদের দিয়ে সেগুলোতে মিউজিক বসিয়ে, ফেসবুক আইডি থেকে ছবি নিয়ে ৩০-৪০ সেকেন্ডের প্রমো বানিয়ে আপলোড করে তার গ্রুপগুলোতে। প্রমো দেখে যারা ফুল ভার্সন দেখতে চায়, তাদের ১ থেকে ২ হাজার টাকার প্রিমিয়াম সার্ভস কিনতে হয়।

তিনি বলেন, মার্ক ওরফে সায়েম, অভ্র এবং শাকিলকে জিজ্ঞাসাবাদ এবং তাদের ডিভাইস তল্লাশি করে মার্ক-সাকারবার্গের বিভিন্ন পেজের এডমিনদের আসল পরিচয় উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। দেখা যায়, তার সবচেয়ে বিশ্বস্ত এবং গুরুত্বপূর্ণ সহযোগী ডিটিআর শুভ ওরফে মশিউর রহমান। মশিউরের দায়িত্ব ছিল গ্রুপ থেকে কৌশলে কন্টেন্ট সেভ করে রাখা এবং নানা প্রলোভনে তরুণীদের অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ভিডিও হাতিয়ে নেওয়া। মশিউরের চট্টগ্রামের একটি ফিশিং কোম্পানিতে চাকরি করে। অবস্থান নিশ্চিত হয়ে তাকে কর্ণফুলি এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। সঙ্গে তার সহযোগী জসীমকেও গ্রেপ্তার করা হয়।  

সিআইডি প্রধান বলেন, সায়েম এবং মশিউরকে জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায় এই অ্যাডাল্ট গ্রুপগুলোর এডমিনদের অনেকেই ঢাকায় অবস্থান করছেন। তাদের বেইলি রোড এলাকার একটি রেস্তোরাঁঢ গেটটুগেদারের ফাঁদ পাতা হয়। ফাঁদে পা দিয়ে একে একে গ্রেপ্তার হয় গুরুত্বপূর্ণ এডমিন ক্যাকটাস ওরফে কেতন চাকমা, এল ডোরাডো ওরফে শাহেদ, তুর্য ওরফে মারুফ এবং মিঞা ভাই ওরফে নাজমুল সম্রাট। এ ঘটনায় এখনও পর্যন্ত সর্বমোট ১৯ জনকে গ্রেপ্তার করেছে সিআইডি।

তিনি বলেন, মার্ক-সারারবার্গ এবং তার সহযোগীদের গ্রুপ ও চ্যানেলগুলোয় সাবস্ক্রাইবের সংখ্যা প্রায় সোয়া চার লাখ। আর সেগুলোতে ২০ হাজার আপত্তিকর ভিডিও এবং প্রায় ৩০ হাজার কন্টেন্ট রয়েছে। অন্যদিকে মাসে ১ থেকে ২ হাজার টাকা ফি দিয়ে তাদের প্রিমিয়াম গ্রুপের সদস্য হয়েছেন দেশ-বিদেশের প্রায় সাড়ে ৭০০ জন। আমরা তাদের বিস্তারিত পেয়েছি। তাদের নিয়েও কাজ করছি। তরুণীদের অ্যাডাল্ট কন্টেন্ট কেনা-বেচার সঙ্গে জড়িত কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না।  

এ ঘটনায় মানি লন্ডারিং তদন্ত করারও পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানান সিআইডি প্রধান। তাহলে কেবল টেলিগ্রাম চক্রের হোতারাই নয়, তাদের দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে থাকা সহযোগীদেরও আইনের আওতায় আনা যাবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।

সবাইকে সচেতন করে তিনি বলেন, এ ঘটনায় ভুক্তভোগী তরুণীদের সঙ্গে কথা বলে আমাদের মনে হয়েছে, একান্ত মুহূর্ত ক্যামেরাবন্দি এবং তা আদান-প্রদান করে তারা যেমন ভুল করেছেন, তেমনিভাবে সেই ভুল করে বিপদে পড়া কঠিন সময়ে তারা নির্ভরযোগ্য কাউকে পাশে পায়নি, না পরিবার, না অন্যান্য স্বজন। ফলে অপ্রাপ্তবয়স্ক হওয়ায় তারা কোনো আইনের আশ্রয় নিতে পারেনি।

বাংলাদেশ সময়: ১৫২৩ ঘণ্টা, মে ২২, ২০২৩
এসজেএ/এসএএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।