ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১২ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

জাতীয়

রোহিঙ্গা শিবিরে সক্রিয় ৪ শতাধিক আরসা সন্ত্রাসী

সুনীল বড়ুয়া, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮১১ ঘণ্টা, জুলাই ২২, ২০২৩
রোহিঙ্গা শিবিরে সক্রিয় ৪ শতাধিক আরসা সন্ত্রাসী

কক্সবাজার: কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে মিয়ানমারের বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি-আরসা’র ৪০০ থেকে ৪৫০ জন সন্ত্রাসী সক্রিয় রয়েছে। তারা ক্যাম্পের গহীন পাহাড়ে গোপন আস্তানা তৈরি করে হত্যা, অপহরণ, চাঁদাবাজি, গুমসহ নানা অপরাধ কর্মকাণ্ড সংঘটিত করে আসছে।

টেকনাফের গহীন পাহাড়ে গোপন আস্তানা থেকে র‌্যাবের হাতে আটক সংগঠনটির সামরিক কমান্ডার হাফেজ নুর মোহাম্মদসহ আরসার ছয় শীর্ষ সন্ত্রাসীর কাছ থেকে র‌্যাবের জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে এসেছে আরও অনেক চাঞ্চল্যকর তথ্য।

মিয়ানমারে থাকতে তারা কে কী করতেন, কে অস্ত্র প্রশিক্ষণ দিতেন, কে বোমা বানাতেন এবং বাংলাদেশে এসে তারা কীভাবে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছেন এবং কে কোন দায়িত্বে ছিলেন, তারা নিজেরাই র‌্যাবের কাছে এসব তথ্য জানিয়েছেন বলে বাংলানিউজকে নিশ্চিত করেন র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক খন্দকার আল মঈন।

শুক্রবার (২১ জুলাই) রাতে টেকনাফের গহীন পাহাড়ে আরসা’র একটি গোপন আস্তানা থেকে প্রথমে সংগঠনটির সামরিক কমান্ডার হাফেজ নুর মোহাম্মদকে (২৮) গ্রেপ্তার করা হয়। পরে তার স্বীকারোক্তি মতে আরসা সন্ত্রাসী ধলা মিয়ার ছেলে মোহাম্মদ হোসেন জোহার (৩০), ওবায়দুর রহমানের ছেলে মো. ফারুক হারেস (২৩), জমলুকের ছেলে মনির আহাম্মদ (৩৬), অলি আহমদের ছেলে নূর ইসলাম (২৯), হোসেনের ছেলে মো. ইয়াছিনকে (২১) গ্রেপ্তার করা হয়।



এ সময় ঘটনাস্থল থেকে ১টি ৭.৬৫ এমএম পিস্তল, ১টি বিদেশি রিভলবার, ১টি শর্টগান, ৪টি দেশীয় তৈরি এলজি, ৩টি দেশীয় রামদা, গুলিসহ নগদ ৭০ হাজার টাকা উদ্ধার করে র‌্যাব।

র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন জানান, গ্রেপ্তারের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে, গ্রেপ্তার হওয়া ৬ জনই আরসার সক্রিয় সদস্য। তারা সবাই শীর্ষ সন্ত্রাসী।

তিনি বলেন, হাফেজ নূর মোহাম্মদ উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা শিবিরের অন্যতম সামরিক কমান্ডার হিসেবে আরসার নেতৃত্ব দিয়ে আসছে। তার নেতৃত্বে আরসার ৩০-৩৫ জন সদস্য ওই ক্যাম্প ও আশপাশের এলাকায় খুন, অপহরণ, ডাকাতি, মাদক, চাঁদাবাজি, আধিপত্য বিস্তারসহ বিভিন্ন ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করত। এমনকি তাদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য তারা পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে দুর্গম সীমান্তবর্তী অঞ্চল দিয়ে অস্ত্র চোরাচালান করত।

হাফেজ নূর তার দলের সদস্যদের মাধ্যমে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর কাছ থেকে খুন, অপহরণ ও গুমের ভয় দেখিয়ে চাঁদা দাবি করত। চাঁদার অর্থ না পেলে ভিকটিমকে অপহরণ করে শারীরিক ও পাশবিক নির্যাতন এবং মুক্তিপণ দাবি করত। মুক্তিপণ না পেলে তারা ভিকটিমকে খুন করে গহীন পাহাড়ে অথবা জঙ্গলে লাশ গুম করে ফেলত, বলেন খন্দকার মঈন।

কে এই হাফেজ নূর?
র‌্যাবের গণমাধ্যম শাখার এই কর্মকর্তা আরও জানান, ২০১৬ সালে হাফেজ নূর মোহাম্মদ আরেক আরসা সদস্য আরিফ উদ্দিনের মাধ্যমে সন্ত্রাসবাদী সংগঠন আরসায় যোগ দেন।

খন্দকার মঈন বলেন, যোগদানের পর পর সে আরসার সেকশন কমান্ডারের দায়িত্ব পায়। সে কুংফুতে ব্ল্যাক বেল্ট প্রাপ্ত ও বিস্ফোরক তৈরিতে পারদর্শী। মিয়ানমারে থাকতে সে আরসার অন্যান্য সদস্যদের কুংফু প্রশিক্ষণ দিত। আরসার সামরিক শাখার প্রধান ওস্তাদ খালেদের কাছ থেকে অস্ত্র চালনার প্রশিক্ষণ ও আরসার মূল সংগঠক আরিফ উদ্দিন হাসেম ওরফে কুইল্লার কাছ থেকে বোমা তৈরির প্রশিক্ষণ নেয় নূর।

পরবর্তীতে সে ২০১৭ সালে অবৈধভাবে বাংলাদেশে এসে বালুখালীর ৮ নম্বর রোহিঙ্গা শিবিরে অবস্থান করে। প্রাথমিকভাবে সে ক্যাম্প-৮-এ আরসার হেড জিম্মাদার হিসেবে দায়িত্ব পায়। তার নেতৃত্বেই কুতুপালং শরণার্থী ক্যাম্পের আরসার সদস্যরা খুন, টার্গেট কিলিং, অপহরণ, ডাকাতি, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধ কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে আসছে, যোগ করেন খন্দকার মঈন।

এই র‌্যাব কর্মকর্তা আরও বলেন, হেড মাঝি শফি উল্লাহ হত্যাকাণ্ড, সালাম হত্যাকাণ্ড, সলিম হত্যাকাণ্ড, মালেক হত্যাকাণ্ড, হাবুইয়া হত্যাকাণ্ড, ইমান হত্যাকাণ্ড, আবুল মুনসুর হত্যাকাণ্ড, সালেহ হত্যাকাণ্ড, জোরপূর্বক এক নারীর ঘরে প্রবেশে বাধা দিলে ওই নারীকে গুলি করে হত্যার ঘটনা এবং সম্প্রতি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আলোচিত ৬ জনের হত্যাকাণ্ডসহ বিভিন্ন হত্যাকাণ্ডে সরাসরি জড়িত ছিল হাফেজ নূর।

সন্ত্রাসী সংগঠন আরসার জন্য চাঁদা সংগ্রহ এবং আরসার শীর্ষ নেতাদের কাছ থেকে প্রাপ্ত অর্থ ক্যাম্পের জিম্মাদারদের মাঝে বণ্টন করতো হাফেজ নূর। এছাড়াও ২০২২ সালের নভেম্বরে গোয়েন্দা সংস্থা ও র‌্যাবের মাদকবিরোধী যৌথ অভিযানের সময় সন্ত্রাসীদের হামলায় গোয়েন্দা সংস্থার একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নিহত এবং একজন র‌্যাব সদস্য গুরুত্বর আহত হন। এ ঘটনার সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিল হাফেজ নূর। সে অপহরণ ও টার্গেট কিলিং শেষে কক্সবাজারের গহীন পার্বত্য এলাকা ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় আত্মগোপনে থাকত বলে জানা যায়। তার বিরুদ্ধে উখিয়া, নাইক্ষ্যংছড়িসহ বিভিন্ন থানায় হত্যা, অপহরণ, অস্ত্রসহ বিভিন্ন অপরাধে ১৫টির বেশি মামলা রয়েছে বলে জানায় র‌্যাব।

জোহারের নেতৃত্বে টার্গেট কিলিং
২০১৬ সালে আরিফ উদ্দিন  হাসেমের মাধ্যমে সন্ত্রাসবাদী সংগঠন আরসায় যোগ দেয় মো. হোসেন ওরফে জোহার (৩০)। আরসায় যোগদানের পর সে অস্ত্র চালনা, কুংফু ও রণকৌশল সম্পর্কে প্রশিক্ষণ নেয়। সে ২০১৭ সালে অবৈধভাবে বাংলাদেশে ঢুকে শরণার্থী ক্যাম্প-১৫-তে অবস্থান করে। পরে ক্যাম্পে আরসার হেড জিম্মাদার হিসেবে দায়িত্ব পায়। হাফেজ নূর মোহাম্মদ ও মাস্টার সলিমের নির্দেশনায় টার্গেট কিলিং, অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় এবং মুক্তিপণ না পেলে হত্যাসহ নানা অপরাধে নেতৃত্ব দিত জোহার। শরণার্থী শিবিরে হেডমাঝি আবু তালেব ও সাবমাঝি সৈয়দ হোছেন ও শফিকুর রহমানকে গুলি করে হত্যার প্রধান সহযোগী ছিল জোহার।

টর্চার সেলের তত্ত্বাবধায়ক হারেস
ফারুক হারেস ২০১৭ সালে বাংলাদেশে এসে ক্যাম্প-১৫-কে অবস্থান করে। ২০১৮ সালে মাস্টার সলিমের সেকেন্ড ইন কমান্ড নিজের আপন বড় ভাই শাহ আলমের মাধ্যমে আরসায় যোগ দেয়। ক্যাম্প-১৫ এর আরসার প্রহরী দলের প্রধান সমন্বয়কারী এবং টর্চার সেলের তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করতো হারেস।

তার ৭-৮ জনের একটি গ্রুপ রয়েছে, যারা নিয়মিত ক্যাম্পে প্রহরীর দায়িত্ব পালন করতো এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অবস্থান পর্যবেক্ষণ করে শীর্ষ  নেতাদের কাছে রিপোর্ট দিত। হারেস নিয়মিত স্থানীয় দোকানপাট থেকে মাসিক চাঁদা আদায়সহ বিভিন্ন অপরাধে সম্পৃক্ত।

গহীন পাহাড়ে আরসা ঘাঁটির প্রহরী মনির, নূর ও ইয়াছিন
গ্রেপ্তার হওয়া অপর তিন সন্ত্রাসী মনির আহাম্মদ (৩৬), নূর ইসলাম (২৯) এবং ইয়াছিন (২১) ২০১৬ সালে আরসার সন্ত্রাসী গ্রুপে যোগ দেয়। এরপর তারা মিয়ানমারের অভ্যন্তরে অস্ত্র পরিচালনার প্রশিক্ষণ নেয়। পরে তারা ২০১৭ সালে  বাংলাদেশে এসে ১৬ নম্বর ক্যাম্পে আশ্রয় নেয়। বিভিন্ন সময়ে তারা স্থানীয় দোকানপাট থেকে মাসিক চাঁদা উত্তোলন, অপহরণপূর্বক মুক্তিপণ আদায়, মুক্তিপণ না পেলে লাশ গুমসহ অন্যান্য অপরাধের সাথে সম্পৃক্ত ছিল জিজ্ঞাসাবোদে জানা গেছে।  

এছাড়াও তারা পাহাড়ে অবস্থিত গোপন আরসা ঘাঁটির নিরাপত্তা প্রহরীর দায়িত্ব পালন করতো বলে জানান র‌্যাব কর্মকর্তা খন্দকার আল মঈন।

আরও পড়ুন:
টেকনাফের গহীন পাহাড়ে ‘আরসা’র টর্চার সেল!

বাংলাদেশ সময়: ১৮০৪ ঘণ্টা, জুলাই ২২, ২০২৩
এসবি/এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।