বাগেরহাট: বাগেরহাটের মোংলা উপজেলার চিলা গ্রামে জেলে হিলটন নাথ হিসেবে কবর দেওয়া মরদেহটি নিখোঁজ ব্যবসায়ী মাহে আলমের। ফরেনসিক ডিএনএ ল্যাবরেটরি অফ বাংলাদেশ পুলিশের রিপোর্টের মাধ্যমে বিষয়টি জানা যায়।
১ আগস্ট ফরেনসিক ডিএনএ ল্যাবরেটরির ডিএনএ পরীক্ষক মোহাম্মাদ নাজমুল আলম টুটুল স্বাক্ষরিত রিপোর্টের মাধ্যমে বিষয়টি সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আমলি আদালত “গ” অঞ্চল খুলনাকে অবহিত করা হয়। তবে শনিবার (১২ আগস্ট) সকালে ডিএনএ টেস্টের রিপোর্টটি গণমাধ্যমকর্মীদের হাতে এলে বিষয়টি নিয়ে হইচই শুরু হয়। কবর থেকে মরদেহ তুলে ইসলাম ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী মরদেহ দাফনের জন্য আদালতে আবেদন করবে মাহে আলমের পরিবার। অন্যদিকে হিলটনকে খুঁজে বের করার দাবি জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
রিপোর্টে বলা হয়, অজ্ঞাত মরদেহের দাঁত থেকে একজন পুরুষের পূর্ণাঙ্গ ডিএনএ প্রোফাইল পাওয়া যায়। পরীক্ষায় সূদৃঢ়ভাবে প্রমাণিত হয় যে, অজ্ঞাত মরদেহটি বিথীকা নাথের জৈবিক সন্তানের নয়। অজ্ঞাত মরদেহটি সুমন রানার জৈবিক পিতার। এর মাধ্যমেই প্রমাণিত হয় চিলা গ্রামে হিলটন নাথ হিসেবে কবর দেওয়া মরদেহটি নিখোঁজ ব্যবসায়ী মাহে আলমের।
ব্যবসায়ী মাহে আলম (৫৭) মোংলা পৌর শহরের বাতেন সড়ক এলাকার মৃত মুন্সি মো. হাবিবুল্লার ছেলে। তিনি মাছের ব্যবসা করতেন। হিলটন নাথ মোংলা উপজেলার চিলা গ্রামের মিটু নাথের ছেলে। তিনি পশুর নদী ও সুন্দরবনে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতেন।
মাহে আলমের পরিবার সূত্রে জানা যায়, গত ১০ এপ্রিল সকাল ৯টায় ব্যবসায়ী মাহে আলম মোংলা বাজারে যাওয়ার উদ্দেশে বের হয়ে আর ফিরে আসেননি। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও না পেয়ে তার ছোট ছেলে সুমন রানা ১৪ এপ্রিল মোংলা থানায় নিখোঁজের সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। মোংলার মামারঘাট এলাকায় থাকা পৌরসভার সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজে ১০ এপ্রিল সকালে মাহে আলমকে দেখা যায়। সে সময় তাঁর পরনে নীল সাদা প্রিন্টের হাফহাতা শার্ট ও হাতে একটি শপিং ব্যাগ দেখা যায়। সেই ফুটেজে ট্রলার মাঝি মোশারফকে মাহে আলমের হাত ধরে বোটে নিয়ে যেতে দেখা যায়।
মোশাররফ তাঁকে অপহরণ করে সুন্দরবনের করমজলে নিয়ে যায় এমন অভিযোগ করে সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ ও প্রত্যক্ষদর্শীদের তথ্য-উপাত্ত নিয়ে মোংলা থানায় মামলা করতে চাইলে থানা মামলা নিতে অস্বীকৃতি জানায় বলে গত ২৯ এপ্রিল সংবাদ সম্মেলন করে তাঁর পরিবার। পরে ২ মে মাহে আলমের ছোট ছেলে সুমন রানা বাগেরহাটের সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আমলি আদালত-২–এ থানায় নিয়মিত মামলা হিসেবে গ্রহণের আবেদন করেন। আদালত মোংলা থানাকে ১৫৪ ধারায় এজাহারভুক্ত নিয়মিত মামলা হিসেবে রেকর্ডভুক্ত করার জন্য আদেশ দেন। ওই মামলায় ট্রলার চালক মোশাররফকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। সপ্তাহখানেক আগে মোশাররফ জামিনে বের হয়েছেন।
এদিকে মাহে আলম নিখোঁজের পর ১৩ এপ্রিল রাতে সুন্দরবনের করমজল বন্যপ্রাণী প্রজনন কেন্দ্র থেকে অর্ধগলিত একটি লাশ উদ্ধার করা হয়। ১৪ এপ্রিল দাকোপ থানা–পুলিশ খুলনা মেডিকেল কলেজে লাশটির ময়নাতদন্ত শেষে নিখোঁজ জেলে হিলটন নাথের পরিবারের সদস্যদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে তাঁদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। খ্রিষ্টধর্মীয় রীতি অনুযায়ী হিলটনের পরিবার মোংলা উপজেলার পশ্চিম চিলা গ্রামে ১৫ এপ্রিল ওই মরদেহের শেষকৃত্য করেন।
ওই ঘটনায় দাকোপ থানায় হত্যা ও লাশ গুম করার অভিযোগে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামি করে মামলা করেন হিলটন নাথের মা বীথিকা নাথ। এর মধ্যে নিখোঁজ ব্যবসায়ী মাহে আলমের পরিবারও ছবি দেখে লাশটি দাবি করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে দাকোপ থানা আদালতে ডিএনএ পরীক্ষার আবেদন জানায়। খুলনার সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত ‘গ’ অঞ্চল খুলনার আদেশে ৯ মে ঢাকার সিআইডি ল্যাবে হিলটন নাথের মা বীথিকা নাথ ও মাহে আলমের ছোট ছেলে সুমন রানা নমুনা দেন।
হিলটন নাথের ভাই সাগর নাথ বলেন, ৭ এপ্রিল আমি ও আমার ভাই হিলটন নাথসহ চারজন পশুর নদীতে মাছ ধরছিলাম। রাতে সহকারী বন সংরক্ষক (এসিএফ) মো. মাহবুব হোসেনের নেতৃত্বে বনরক্ষীরা আমাদের তিনজনকে বন বিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জ কার্যালয়ে নিয়ে আটকে রাখেন। তিনজনের মধ্যে আমার ভাই ছিল না। ভাই হিলটন নাথের কথা জানতে চাইলে এসিএফ মো. মাহবুব হোসেন বলেন, পরে আনা হবে। আমাদের প্রচুর মারধর করে বনরক্ষীরা। পরের দিন (০৮ আগস্ট) সকালে আমাদের তিনজনকে আদালতে পাঠালেও, আমার ভাই হিলটনকে আদালতে পাঠায়নি। পরে জানতে পারি আমার ভাইয়ের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে এবং পারিবারিকভাবে তার শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়েছে।
সাগর নাথ আরও বলেন, দুপুরের দিকে শুনলাম মাটি দেওয়া মরদেহ, আমার ভাই হিলটন নাথের নয়। এই মরদেহ ব্যবসায়ী মাহে আলমের। তাহলে আমার ভাইয়ের কি হলো। আমরা যেকোনো মূল্যে আমার ভাইয়ের মরদেহ অথবা জীবিত অবস্থায় ফিরে চাই।
ব্যবসায়ী মাহে আলমের ছোট ছেলে সুমন রানা বলেন, আমার বাবাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। তার মরদেহ হিলটনের বলে চালিয়ে দেওয়া হয়েছে। যা অনেক বড় অপরাধ। ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে বিষয়টি এখন প্রমাণিত যে, কবর দেওয়া মরদেহটি হিলটন নাথের নয়। মরদেহটি আমার বাবা ব্যবসায়ী মাহে আলমের। প্রথমত আদালত এবং প্রশাসনের মাধ্যমে মরদেহ উত্তোলন করে দ্রুত ইসলামী রীতি অনুযায়ী মরদেহ দাফন করতে চাই। বাবাকে যারা পরিকল্পিতভাবে খুন করে মরদেহ গুম করেছে তাদের আইনের আওতায় এনে বিচার দাবি করেন বাবা হারা এই সন্তান।
হিলটন নাথের মা বিথিকা নাথের করা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন খুলনার মিজানুর রহমান বলেন, আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মাহে আলমের ছেলে সুমন রানাকে তার বাবার মরদেহ বুঝিয়ে দেওয়া হবে। আর মাহে আলমকে পরিকল্পিতভাবে খুন এবং লাশ গুম করার অভিযোগ থাকলে মাহে আলমের পরিবারের পক্ষ থেকে পৃথক মামলা করতে হবে।
তৎকালীন চাঁদপাই রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক (এসিএফ) মো. মাহবুব হোসেন বলেন, ৭ এপ্রিল রাতে আমি অভিযানে ছিলাম না। আমার স্টাফরা অভিযানে ছিল। ওইদিন তিনজনকেই আটক করা হয়। তাদের পরে আদালতে সোপর্দ করা হয়। তাদের কাউকে মারধর বা অন্য কেউ নিখোঁজের ঘটনা ঘটেনি। যাদের আটক করা হয়েছিল তাদের সঙ্গে আর কেউ আছে কিনা, তাও জানতে চাওয়া হয়েছিল। তারা বলেছেন আমাদের সঙ্গে কেউ নেই।
তিনি আরও বলেন, মোংলায় একটি সিন্ডিকেট রয়েছে, যারা সুন্দরবন থেকে অবৈধভাবে মাছ আহরণ করেন। শুনেছি ওই সিন্ডিকেটের কর্তা ব্যক্তিরা হিলটন নাথকে ভারতে পাঠিয়ে দিয়েছে।
খুলনার পুলিশ সুপার মোহাম্মদ সাঈদুর রহমান বলেন, মরদেহের পরিচয় সম্পর্কে আমরা নিশ্চিত হয়েছি। দাকোপ থানায় হিলটনকে হত্যা ও গুমের যে মামলা রয়েছে তা নিয়ে পুলিশ আরও গভীরভাবে কাজ করবে। মাহে আলমকে হত্যা ও গুমের মামলা বাগেরহাট আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী চলবে বলে জানান তিনি।
বাংলাদেশ সময়: ২১১০ ঘণ্টা, আগস্ট ১২, ২০২৩
আরএ