ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

জাতীয়

৫.৫ মাত্রার ভূমিকম্পে আতঙ্কিত হওয়ার কারণ নেই: ঢাবি অধ্যাপক

ইউনিভার্সিটি করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৩৬ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩, ২০২৩
৫.৫ মাত্রার ভূমিকম্পে আতঙ্কিত হওয়ার কারণ নেই: ঢাবি অধ্যাপক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিজাস্টার সায়েন্স অ্যান্ড ক্লাইমেট রেজিলিয়েন্স বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মো. জিল্লুর রহমান

ঢাকা: রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন অঞ্চলে ৫ দশমিক ৫ মাত্রার ভূমিকম্পে আতঙ্কিত হওয়ার কারণ নেই বলে জানিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিজাস্টার সায়েন্স অ্যান্ড ক্লাইমেট রেজিলিয়েন্স বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মো. জিল্লুর রহমান।

তিনি বলেন, এ ধরনের ভূমিকম্প দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রায়ই হতে পারে।

অবকাঠামো নির্মাণে যথাযথ পরিকল্পনা, প্রকৌশলীদের কার্যকরী প্রশিক্ষণ ও জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতা তৈরির মাধ্যমে এ ধরনের ঝুঁকি অনেকটাই কমানো সম্ভব।

গতকাল শনিবার (২ ডিসেম্বর) দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ভূ-কম্পনের ঘটনা ঘটে। আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। অনেকেই তাড়াহুড়ো করে খোলা স্থানে ছুঁটতে গিয়ে আহত হন। বিষয়গুলো নিয়ে বাংলানিউজের সাথে কথা বলেন অধ্যাপক ড. জিল্লুর রহমান।

তিনি বলেন, যে ভূমিকম্পটি হয়েছে এটি ক্রাস্টাল ফল্ট (ভূ-ত্বক বিচ্যুতি) থেকে হয়েছে। এর আগেও বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এরকম ভূ-কম্পনের উদ্ভব হয়েছে। ১৯৮৫ সালে মানিকগঞ্জে এরকম একটি ভূ-কম্পনের উদ্ভব হয়। টাঙ্গাইলেও এরকম ভূ-কম্পনের ঘটনা ঘটে। মাটির প্রায় ৩৮ কিলোমিটার গভীরে থাকা ফল্টগুলোর নড়াচড়ার কারণে র‌্যান্ডম ভূ-কম্পন হয়। এ ধরণের ভূমিকম্প সর্বোচ্চ ৭ থেকে ৭ দশমিক ৯ পর্যন্ত হতে পারে। বাংলাদেশের পূর্ব এবং উত্তর পাশে প্লেট বাউন্ডারি এক লাইন বরাবর। পূর্ব বাউন্ডারি থেকে দূরে লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জ উপজেলার একটি স্থান থেকে গতকালকের ভূমিকম্পটি ঘটেছে।

ভিন্ন স্থানে ভূ-কম্পনে নতুন শঙ্কা?
দেশের উত্তর-পূর্বাংশে না হয়ে দক্ষিণাংশে ভূ-কম্পন নতুন কোনো শঙ্কার কারণ হতে পারে কিনা জানতে চাইলে ড. জিল্লুর রহমান বলেন, সেরকম চিন্তার কিছু নেই। এই কম্পনগুলো প্লেট মুভমেন্টের কারণে র‌্যান্ডমলি হচ্ছে। প্রায়শই হতে পারে। এগুলোয় আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। ২০১০ সালে চাঁদপুরর মতলবে এমন একটি ভূ-কম্পনের উদ্ভব হয়েছিল।  

ভূ-কম্পনের সময় হুড়োহুড়ি ঠিক নয়
ভূ-কম্পনের কারণে ঢাকার বিভিন্ন স্থানে মানুষ আতঙ্কে বাসা থেকে বের হয়ে খোলা স্থানে আশ্রয় নেয়। এ সময় সবার মাঝে একটি ভীতি ছড়িয়ে পড়ে। এ বিষয়ে ড. জিল্লুর রহমান বলেন, তাড়াহুড়ো করতে গিয়েই অনেকে বিপত্তি বাধে। দেখা গেল, তার ভূমিকম্পে ক্ষতি হয়নি। তবে আতঙ্কে লাফ দিয়ে হাত ভেঙে ফেলেছেন। ঢাকার মতো জনাকীর্ণ স্থানে ভূ-কম্পনের সময় বাসা থেকে বের হওয়ারই দরকার নেই। ঢাকায় পর্যাপ্ত খোলা জায়গা নেই। ফলে রাস্তায় গিয়ে দাঁড়ালে প্রকট ভূ-কম্পনের কারণে দুপাশে বিল্ডিং তাদের মাথায় পড়তে পারে। যদিও এ ধরনের উঁচুমাত্রার ভূ-কম্পন বাংলাদেশে হয়নি।

তিনি বলেন, ভূমিকম্পে আমাদের যা ক্ষয়ক্ষতি হয়, তার থেকে বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয় তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে। আমরা সবাই আতঙ্কিত হয়ে ছুঁটতে থাকি। অথচ এই ৩০-৪০ সেকেন্ডে তেমন কোনো নিরাপদ দূরত্বে সরে যাওয়ার সুযোগ নেই। আমরা চেষ্টা করব শক্ত বিম, টেবিলসহ শক্ত আসবাবের নিচে আশ্রয় নিতে। এরকম র‌্যান্ডম ভূমিকম্পে ভবন ভেঙে পড়বে না।  

অবকাঠামোগত ব্যাপারে সতর্কতা
ড. জিল্লুর রহমান বলেন, জাপানে, আমেরিকার সানফ্রানসিসকোয় এ ধরনের ভূমিকম্প খুবই স্বাভাবিক। তারা জানে এগুলো হবে। এ মাত্রার কম্পনে তারা ঘর থেকেও বের হয় না। আমাদের এখন ভূমিকম্প হচ্ছে। ১০-১২ বছর আবার কমও হতে পারে। মানুষের আতঙ্কিত হওয়ার কারণ নেই। বাংলাদেশেও বড় ধরনের ভূ-কম্পন হতে পারে।

সরকারি পরিকল্পনায় কোন বিষয়গুলো নজর দেওয়া যেতে পারে
আমাদের সবার প্রথমে অবকাঠামোগুলোকে সঠিক পরিকল্পনা মতো বানাতে হবে। দীর্ঘমেয়াদি চিন্তা করে ভবন তৈরি করতে হবে। প্রকৌশলী, রাজমিস্ত্রিসহ সংশ্লিষ্টদের বিষয়টি সামনে রেখে সবাইকে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। মানুষের মাঝে সচেতনতা তৈরি করতে হবে ব্যাপকহারে। এরপরও ভূমিকম্পে দুর্বল কোনো ভবন ভেঙে পড়তে পারে, তখন উদ্ধারের কাজ কীভাবে করা যায়, তার চিন্তা আসবে। তবে সবার প্রথমে মানুষের জীবন বাঁচানোর দিকে আমাদের নজর দেওয়া উচিত। ছোটখাটো ভূ-কম্পনে অনেক বিল্ডিং কাঁপবে। তবে ভেঙে পড়বে না।

তিনি বলেন, বাংলাদেশে যে মাত্রায় ভূ-কম্পন হলো, তাতে তেমন ক্ষতি হবে না। কিন্তু নেপালে আবার একই মাত্রার ভূমিকম্পে মানুষ মারা গিয়েছে। মরক্কোয় মানুষ মারা গিয়েছে। তাদের পাহাড়ি অঞ্চল। সেকারণে অবকাঠামো অত শক্তিশালী নয়। ফলে আতঙ্কিত না হয়ে সচেতন হওয়াটা বাংলাদেশের জন্য জরুরি।

অবকাঠামো তৈরিতে ফাঁকি
বিভিন্ন স্থানে অবকাঠামো তৈরিতে যথাযত নিয়ম না মানাকে ভীতির কারণ হিসেবে দেখছেন এই অধ্যাপক। তিনি বলেন, আমাদের অবকাঠামোগুলোকে নির্মাণের সময় যে বিষয়গুলো বিবেচনা করা উচিত, তা করা হয় না। অনেকসময় প্রকৌশলী যেভাবে চায় সেভাবেও হয় না। টাকা বাঁচানোর চিন্তা করে আমরা বিল্ডিং করি দুর্বলভাবে। অথচ এটাই গোড়ার কাজ। মালিক টাকা দিতে প্রস্তুত। কিন্তু প্রকৌশলীদের প্রশিক্ষণের অভাবে এমনটা হয়।

তিনি বলেন, আমাদের গ্রাম পর্যায়েও অনেক বিল্ডিং হচ্ছে। প্রকৌশলীর পাশাপাশি রাজমিস্ত্রিকেও সচেতন করতে হবে। গ্রামে বিল্ডিং করেন রাজমিস্ত্রিরা। আমরা ৭ মাত্রা সহনকারী ভবন করতে পারলেই হয়, তাহলে আমাদের ঝুঁকি নেই।

এই ভূ-কম্পন বড় ভূমিকম্পের আভাস দিচ্ছে কিনা?
ড. জিল্লুর রহমান বলেন, সেরকম কিছু নয়। সাধারণত কখনো যদি এক ফল্ট লাইন বরাবর কয়েকটি ছোট ভূমিকম্প হয়, তখন আশঙ্কা করা হয় সেখানে বড় ভূমিকম্প হতে পারে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এক ফল্ট লাইন বরাবর ভূ-কম্পন হয়নি। কোনোটি হয়েছে দোহারে, কোনোটি টাঙ্গাইলে, লক্ষ্মীপুরে, চাঁদপুরে। এগুলো দেখলে বোঝা যায় র‌্যান্ডমলি হয়েছে। বাংলাদেশেও হয়তো বড় ভূমিকম্প হতে পারে। তবে এই ভূমিকম্পগুলো বড় ভূমিকম্পের আভাস নয়।

পুরান ঢাকার ভবনগুলো ঝুঁকিতে
রাজধানীর পুরান ঢাকাসহ কয়েকটি স্থানের ভবন নিয়ে ঝুঁকি রয়েছে। বাসাগুলো পুরনো। ১০০ বছর পুরনো বাড়িতেও মানুষ থাকেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক হলের অবস্থাও একই। ফলে সেখানে শক্তিশালী ভূকম্পন হলে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে। একইসাথে উদ্ধারকাজও বিলম্ব হবে।

সরকার, একাডেমিক, প্রাইভেট সেক্টর, প্রকৌশলী, রাজমিস্ত্রীসহ এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সবাইকে সামনে এগিয়ে আসতে হবে। তবেই ঝুঁকি কমবে বলে মনে করেন ড. জিল্লুর রহমান।

বাংলাদেশ সময়: ১৪৩৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩, ২০২৩
এমজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।