ঢাকা, রবিবার, ২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

শিশু স্বাধীনের খুনিরা এখনো অধরা

উপজেলা করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪২১ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৪, ২০২৩
শিশু স্বাধীনের খুনিরা এখনো অধরা শিশু ওসমান গণি স্বাধীন

নারায়ণগঞ্জ (রূপগঞ্জ): নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের শিশু ওসমান গণি স্বাধীনের ক্ষত-বিক্ষত মরদেহ উদ্ধারের ১৯ দিন পেরিয়ে গেলেও হত্যায় জড়িতরা এখনো রয়েছে ধরাছোঁয়ার বাইরে।

গত ৪ ডিসেম্বর রাজধানীর খিলগাঁওয়ে বালু নদীতে নির্মাণাধীন সেতুর নিচ থেকে ৯ বছরের শিশু স্বাধীনের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ।

স্বাধীন রাজধানী লাগোয়া রূপগঞ্জ উপজেলার কায়েতপাড়া ইউনিয়নের নাওড়া গ্রামের বাসিন্দা শাহীন আলমের ছেলে। স্থানীয় পশ্চিমপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রথম শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল সে। গত ১ ডিসেম্বর সে নিখোঁজ হয়।

স্বাধীনের বাবা শাহীন আলম এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে রংধনু গ্রুপের চেয়ারম্যান এবং স্থানীয় কায়েতপাড়া ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম ও তার ভাই মিজানুর রহমানের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ করে আসছেন। তার ভাষ্য, ভূমিদস্যু রফিককে বাড়ি লিখে না দেওয়ায় তার শিশুসন্তানকে নির্মমভাবে হত্যাকাণ্ডের শিকার হতে হয়েছে।

মরদেহ উদ্ধারের ১৯ দিন পেরিয়ে গেলেও হত্যাকারীদের ধরতে পুলিশের কোনো ভূমিকা নেই অভিযোগ করে শাহীন বলেন, ‘স্বাধীনের মরদেহ সবাই দেখেছে, হত্যা করে আমার ছেলের মুখ বিকৃত করে দিয়েছে, অ্যাসিড দিয়ে শরীর ঝলসে দিয়েছে। লাশ গুম করার সর্বোচ্চ অপচেষ্টা হয়েছে। এত কিছুর পরও প্রভাবশালীদের ইন্ধনে স্থানীয় প্রশাসন হত্যা মামলা না নিয়ে অপমৃত্যুর মামলা দিতে বাধ্য করেছে। এরপর এটিকে হত্যা মামলার মতো গুরুত্ব দিয়ে তদন্তের কথা বলা হলেও মূলত পুলিশের কোনো তৎপরতা নেই। ’

পরিবারটির অভিযোগ, হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে প্রভাবশালী চক্র সরাসরি যুক্ত থাকায় গত ১৯ দিনেও ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন ও ভিসেরা রিপোর্ট পাওয়া যায়নি। ফলে হত্যাকাণ্ডে সম্পৃক্ত কেউ গ্রেপ্তার হয়নি। বরং তারা অনবরত হুমকি দিয়ে যাচ্ছে। শিশু হত্যার বিচার তো মিলছেই না, উল্টো হত্যাকারীদের হুমকি-ধমকিতে বাড়িছাড়া হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করতে হচ্ছে স্বাধীনের পরিবারকে।

এ প্রসঙ্গে মানবাধিকার বিশেষজ্ঞ অ্যাডভোকেট সালমা আলী বলেন, ‘একটা শিশু কোনোভাবেই অপরাধ করতে পারে না। সেখানে পুলিশের একটা দায়িত্ব ছিল সুষ্ঠুভাবে তদন্ত করা। কিন্তু তারা সেটা পারে না প্রভাবশালীদের চাপের জন্য, সেটা কী করে হয়? পুলিশ তার দায়িত্ব পালন করেনি। ’

সততার সঙ্গে পুলিশের দ্রুত তদন্ত কাজ শেষ করা উচিত মন্তব্য করে তিনি আরও বলেন, ‘সমাজে যারা প্রভাবশালী, পেশীশক্তি আছে, টাকা আছে, তারাই আইন লঙ্ঘন করে। পুলিশের একটা কাজ আছে সততার সঙ্গে দ্রুত তদন্ত শেষ করা। কিন্তু সেটা হয় না অনেক সময় ওপর থেকে চাপের কারণে। ’

তিনি আরও বলেন, সাধারণত পলিটিক্যাল লিডাররা মানুষের জমি সব থেকে বেশি দখল করে। সেখানে হয়তো সে ফ্যাক্টরি বানাবে, মাছের ঘের করবে। এটা কিন্তু তার অধিকার খর্ব হচ্ছে। মনিটরিং ও প্রশাসনের জবাবদিহি না থাকার কারণে এগুলো ঘটছে।

জানা যায়, হত্যাকাণ্ডের দুই মাস আগে রংধনু গ্রুপের চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম নিহত স্বাধীনের দাদা রেজাউল আলমকে তাদের বাড়ি নামমাত্র মূল্যে বিক্রির জন্য জোর চাপ দেন। কিন্তু রেজাউল সাফ জানিয়ে দেন তিনি বাড়ি বিক্রি করতে চান না। কেননা বাড়ি বিক্রি করলে তাদের থাকার জায়গা হবে না। তারপরও যদি কখনো বিক্রি করতে হয় তিনি নিজেই রফিকের বাড়িতে গিয়ে প্রস্তাব দেবেন।  

অভিযোগ রয়েছে, রফিক তার ক্যাডার বাহিনী লেলিয়ে দিয়ে দিনের পর দিন নির্যাতনের হুমকি দিয়ে আসছিলেন রেজাউলের পরিবারকে। শুরু হয় হামলা, নির্যাতন, নিপীড়ন ও চাঁদাবাজি। হত্যাকাণ্ডের আগের দুই মাসে পরিবারটির ওপর একাধিকবার হামলার ঘটনা ঘটে। এমনকি স্বাধীনের বাবা শাহীন আলমের দোকানে দুবার হামলা চালিয়ে মারধর করে রফিকের সন্ত্রাসীরা।

স্বাধীন হত্যার এক সপ্তাহ আগে রফিকুলের ভাই মিজানুর রহমান স্বাধীনের পরিবারকে উচিত শিক্ষা দেবেন বলে বাড়িতে গিয়ে হুমকি দিয়ে যান। ঠিক এক সপ্তাহ পর স্বাধীন নিখোঁজ হয়। এরপর তার বীভৎস লাশ নদীতে পায় পরিবার।

শনিবার (২৩ ডিসেম্বর) কথা হয় নিহত শিশু স্বাধীনের মা উম্মে হানি মুন্নীর সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘১৯ দিন হয়ে গেল, কিন্তু আমার সন্তান হত্যার সঙ্গে জড়িতরা মুক্ত বাতাসে শ্বাস নিচ্ছে। রফিক ও তার ভাই মিজানের জমি দখলের ষড়যন্ত্রের বলি হয়েছে আমার ছেলে। কিন্তু রূপগঞ্জের থানা-প্রশাসনের কোনো সহযোগিতা আমরা পাচ্ছি না। ’

শিশু স্বাধীনের বাবা শাহীন আলম বলেন, ‘আমার শিশুসন্তান খুনের পর আমি পুলিশের কাছে গিয়েছি, অপরাধীদের নাম বলেছি। আমি বলেছি তারা আমার দোকান ভাঙচুর করেছে, আমি প্রেস কনফারেন্স করেছি, সেখানেও আমার সঙ্গে খারাপ আচরণ করেছে। বাসায় হামলা করেছে, এখন আমি অন্য জায়গায় থাকি। কিন্তু এখন পর্যন্ত পুলিশ কিছুই করেনি। ’

তিনি প্রশাসনের উদ্দেশে প্রশ্ন তোলেন, ‘আমি প্রশাসনের কাছে বিচার চাইছি। কিন্তু প্রশাসন কোনো কথাই বলছে না। আমি কি স্বাধীন দেশের নাগরিক না? আমি কি কোনো বিচার পাব না? পুলিশ কেন বসে রয়েছে? কেন বিচার করছে না?’

কান্না করতে করতে তিনি বলেন, ‘আমি তো টাকা-পয়সা চাইনি, আমি তো ধনসম্পদ চাইনি। আমি চাই সুষ্ঠু বিচার হোক। আমার সবচেয়ে কষ্ট যারা হত্যা করল, যারা অপরাধ করল, তারা স্বাধীনভাবে ঘুরছে। ওরা শিশু হত্যার মতো জঘন্য একটা কাজ করে স্বাধীনভাবে ঘুরছে, যেন কিছুই মনে করছে না। ’

রফিক টাকার বিনিময়ে ময়নাতদন্ত রিপোর্ট পরিবর্তন করে দিতে পারেন অভিযোগ করে শাহীন বলেন, ‘১৭ দিন হয়ে গেছে, আমার ছেলের ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন আমি এখনো হাতে পাইনি। রফিক টাকার বিনিময়ে রিপোর্ট ঘোরানোর চেষ্টা করছে। ওরা যেন কিছু করতে না পারে, সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে যেন সত্য রিপোর্টে পাই। ’

স্বাধীন হত্যার বিচারের দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী এ হত্যার বিচার করুক। জনগণ দেখুক শিশু হত্যার মতো একটা ঘৃণিত হত্যাকাণ্ডের কেমন বিচার করছেন প্রধানমন্ত্রী। ’

নিরাপত্তাহীনতায় ভোগার কথা জানিয়ে শিশু স্বাধীনের বাবা বলেন, ‘ওরা আমার বাড়িঘর সব জ্বালিয়ে দেওয়ার হুমকি দিচ্ছে। আজকে আমি সন্তানও হারাইছি, বাড়িও হারাইছি। এখন জীবনের নিরাপত্তা পাচ্ছি না। আমি যেখানে থাকি, আতঙ্কের মধ্যে থাকি। কখন জানি আমাকে হত্যা করে আমার বাবাকে হত্যা করে। আমার চাওয়া, প্রশাসন যাতে নীরব না থাকে। প্রশাসন যাতে চুপ না থাকে। প্রশাসন যেন কঠিন পদক্ষেপ নেয়। শিশু হত্যাকারীকে যেন ফাঁসিতে ঝোলায়। ’

বিলাপ করতে করতে স্বাধীনের দাদা রেজাউল আলম বলেন, ‘আমি কী অপরাধ করছি? আমার শিশু নাতি কী অপরাধ করছে? আমি কেন বিচার পাচ্ছি না? আমি বাড়িছাড়া হয়েছি, আমার বাড়িতে হামলা হচ্ছে, সংবাদ সম্মেলন করছি, সেখানেও হামলা হয়েছে। ওরা হুমকি দিয়ে বলতেছে, সব শেষ করে দিছি, সব শেষ করে দিছি, কিছু করতে পারবি না। ’

তিনি বলেন, ‘আমি বাড়ি যেতে পারি না, এক কাপড়ে বাইরে বাইরে ঘুরতেছি। আমি পাগলের মতো ঘুরতেছি, কোথাও বিচার পাই না। ’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের পুলিশ সুপার (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) ইনামুল হক সাগর বলেন, ‘অপরাধ যত ছোট বা বড় যাই হোক না কেন, যিনি অপরাধ করবেন বা নাশকতা করবেন তাকে অবশ্যই আইনের আওতায় নিয়ে আসব আমরা। আপনারা দেখেছেন এটি খুব দ্রুততার সঙ্গে নিয়ে আসার জন্য বাংলাদেশ পুলিশ কাজ করে। আমাদের পক্ষ থেকে মেসেজ এটাই যে অপরাধীদের কোনো ছাড় নেই। এ ক্ষেত্রে আমাদের জিরো টলারেন্স। সে ক্ষেত্রে তাকে যত দ্রুত সম্ভব আইনের আওতায় নিয়ে আসার জন্য আমরা সেই কাজটুকু করে যাই এবং ভবিষ্যতেও সেটি অব্যাহত থাকবে। ’

নৌ পুলিশ ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার (এসপি) গৌতম কুমার বিশ্বাস বলেন, ‘একটি ৯ বছরের শিশুর লাশ কেন নদীতে পাওয়া গেল, এ-সংক্রান্তে অপমৃত্যু মামলা হলেও আমরা হত্যা মামলার মতোই সমান গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করছি। এর সঙ্গে নিশ্চয়তা দিয়ে বলতে পারি, যদি এই শিশুটি প্রকৃতপক্ষে কারও দ্বারা হত্যা হয়ে থাকে, তাহলে সেই ব্যক্তি যেই হয়ে থাকুক না কেন, আমরা তাকে আইনের আওতায় নিয়ে আসব। ’

ময়নাতদন্ত এবং ভিসেরা রিপোর্ট আসতে কত সময় লাগতে পারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটা আসলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের ওপর নির্ভর করে। আমরা তো ৪ তারিখেই (৪ ডিসেম্বর) পাঠিয়ে দিয়েছি। ইতোমধ্যে আমরা একাধিকবার হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। এখানে দুটি বিষয় আছে, ভিসেরা হাসপাতালে হয় না। এটা অন্য একটা জায়গায় হয়। ভিসেরা রিপোর্ট আসার পরই পোস্টমর্টেম ফাইনাল ওপেনিয়ন দিয়ে ডাক্তার মতামত দেন। আমরা যেটা জানতে পেরেছি ভিসারা রিপোর্টটা এখনো হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ পায়নি। সেখানেও আমরা যোগাযোগ করেছি যেন দ্রুত ভিসেরা রিপোর্টটা চলে আসে এবং আমরা ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন পেলে মৃত্যুর প্রকৃত কারণ জানতে পারব। ’

বাংলাদেশ সময়: ১৪১০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৪, ২০২৩
এইচএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।