ঢাকা, রবিবার, ২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

সামনে নির্বাচন, চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে আসছে অস্ত্র-বিস্ফোরক

ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪১৮ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৫, ২০২৪
সামনে নির্বাচন, চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে আসছে অস্ত্র-বিস্ফোরক

চাঁপাইনবাবগঞ্জ: নির্বাচনকে সামনে রেখে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে ভারী আগ্নেয়াস্ত্র, গুলি ও বিস্ফোরক দ্রব্য আসছে। মূলহোতারা গ্রেপ্তার না হওয়ায় বন্ধ করা যাচ্ছে না এসব চোরাচালান।

 

সর্বশেষ গত ১৩ দিনেই সাতটি আগ্নেয়াস্ত্র, ভারী ও হালকা অস্ত্রের আড়াইশ গুলি এবং ১৪ কেজি বিস্ফোরক জব্দ করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।  

শুধু তাই নয়, জব্দ করা হয়েছে ৪১টি তাজা ককটেলও। আর অস্ত্র ও গুলির এসব বড় চালান কারা দেশে আনছে বা মজুদ করছে, তা এখনও জানতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। একদিকে বিস্ফোরক চোরাচালান বাড়ছে অন্যদিকে হামলা চালানো হচ্ছে জেলা প্রশাসন, নির্বাচন অফিসসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোতে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ৮ অক্টোবর রানিহাটি থেকে পাঁচ ককটেল উদ্ধার হয়। একই দিন শিবগঞ্জের আজমতপুর সীমান্তে মোটরসাইকেলে আগ্নেয়াস্ত্র পাচারের সময় পিস্তল, গুলি ও ম্যাগজিনসহ দুজনকে আটক করা হয়। ১৫ নভেম্বর শিবগঞ্জ সীমান্তে একটি পিস্তল, দুটি ম্যাগজিন ৩৬ রাউন্ড গুলি উদ্ধার করা হয়। ওই দিনই সদর উপজেলার মহারাজপুর থেকে তিন কেজি ৪২০ গ্রাম বিস্ফোরকসহ একজনকে আটক করা হয়। ৫ ডিসেম্বর শিবগঞ্জের মনাকষা বাজারে ককটেল বানানোর কারখানায় অভিযান চালিয়ে পাঁচটি তাজা ককটেল, বিভিন্ন দেশীয় অস্ত্র ও ককটেল বানানোর বিভিন্ন সরঞ্জামসহ একজনকে আটক করা হয়। ২০ ডিসেম্বর শিবগঞ্জ সীমান্তে বিদেশি পিস্তল, গুলি ও ম্যাগজিনসহ এক নারী আটক হন। একই রাতে একই সীমান্তে পরিত্যক্ত অবস্থায় ছয়টি বিদেশি পিস্তল, ১২টি ম্যাগজিন, ২৩৬ রাউন্ড পিস্তলের গুলি, ৫১ রাউন্ড মেশিনগানের গুলি ও ৩৫ বোতল ফেন্সিডিল উদ্ধার করা হয়।

২৯ ডিসেম্বর রাতে শিবগঞ্জের লাভাঙ্গার একটি পরিত্যক্ত বাড়িতে অভিযান চালিয়ে ৪১টি তাজা ককটেল জব্দ করা হয়। ৩১ ডিসেম্বর শিবগঞ্জ সীমান্তে পরিত্যক্ত অবস্থায় দুটি বস্তায় ১২ কেজি বিস্ফোরক পাওয়া যায়। সর্বশেষ ৩ জানুয়ারি শিবগঞ্জের মনাকষায় একটি বাড়িতে রাখা ককটেলের একটি বিস্ফোরিত হলে একটি শিশু আহত হয়।

বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) দেওয়া তথ্যে জানা যায়, গত ১১ মাসে ২০টি পিস্তল, ৩৭৩ রাউন্ড গুলি, ৩২ ম্যাগজিন এবং মেশিনগানের ৫১ রাউন্ড গুলি উদ্ধার হলেও নির্বাচনের প্রতীক বরাদ্দের পর মাত্র ১৩ দিনে সাতটি বিদেশি পিস্তল এবং বিপুল পরিমাণ গুলি জব্দ করা হয়। এসময়ে মেশিনগানের ৫১ রাউন্ড গুলি জব্দ হওয়ায় খোদ বিজিবির কর্মকর্তারাও চিন্তিত।  

অন্যদিকে এসব ঘটনায় শুধু এক নারী আটক হলেও এখনও এসব অস্ত্রের চালান কারা কোথা থেকে আনা হয়েছে, তা চিহ্নিত করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। শুধু তাই নয়, গত এক মাসে জব্দ হওয়া অস্ত্র ও বিস্ফোরক প্রসঙ্গে প্রতিবারই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী স্বীকার করেছে যে নির্বাচনকে সামনে রেখেই নাশকতার উদ্দেশে এসব অস্ত্র চোরাচালান হচ্ছে।

বিশেষ করে গত ২১ ডিসেম্বর দুপুরে ৫৯ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল গোলাম কিবরিয়া ও রিজিয়ন কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল খোন্দকার শফিকুজ্জামান পিএসসি উদ্বেগের সঙ্গে জানান, এ ধরনের ভারী অস্ত্রের গুলি উদ্ধারের পর সীমান্তে আরও নজরদারি বাড়ানো হচ্ছে। এ ধরনের গুলি শুধু বড় ধরনের নাশকতার উদ্দেশেই আনা হয়েছে। আর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বাইরে এসব অস্ত্র সহজলভ্য হলে দেশের জন্য বিপজ্জনক বলেও মন্তব্য করেন।  
তারা সাংবাদিকদের জানান, বিজিবি দিবস ২০২৩ উদযাপন উপলক্ষে বিজিবি কর্মকর্তা ও সদস্যরা কর্মব্যস্ততা ছিল। সেই সঙ্গে নির্বাচন উপলক্ষে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য মাঠ পর্যায়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তা এবং বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে রাজশাহীতে মতবিনিময় সভায় অংশ নেয় বিজিবি। এ সুযোগে চোরা কারবারিরা এ ধরনের অস্ত্র ও গুলির বড় চালান দেশে এনেছে।

অন্যদিকে সীমান্তে বিস্ফোরক চোরাচালান ও ককটেল মজুদও বেড়েছে। গত মাসের প্রথমদিকে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) ককটেল তৈরির কারখানার সন্ধান পায়। এরপর এখনও এ কারখানার মূল কারিগর সাইদুল ইসলাম ওরফে রানাকে ধরতে পারেনি র‌্যাব।  

২৯ ডিসেম্বর লাভাঙ্গার পরিত্যক্ত বাড়িতে অভিযান চালিয়ে জব্দ করা ৪১টি তাজা ককটেলের মূলহোতাও ধরা ছোঁয়ার বাইরে। আর ৩১ ডিসেম্বর দুটি বস্তায় ১২ কেজি বিস্ফোরক জব্দের পর মালিককে শনাক্ত করতে পারেনি বিজিবি।  

সর্বশেষ ৩ জানুয়ারি মনাকষার এক বাড়িতে মজুদ করা ককটেল থেকে একটি বিস্ফোরিত হয়ে একটি শিশু আহত হলেও বাড়ির মালিককে ধরা সম্ভব হয়নি।  

তবে প্রতিটি ক্ষেত্রে বলা হচ্ছে, নির্বাচনকে ঘিরে নাশকতার উদ্দেশে এসব বিস্ফোরক, অস্ত্র, গুলি ও ককটেল মজুদ করা হচ্ছিল।

এদিকে নির্বাচনকে সামনে রেখে সীমান্ত দিয়ে অস্ত্র ও বিস্ফোরক চোরাচালান বাড়ার পাশাপাশি বেড়েছে ককটেল হামলার ঘটনাও। চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা প্রশাসকের বাসভবনের পাশেসহ শহরের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলো লক্ষ্য করে চলছে ককটেল হামলা। এতে শহরজুড়ে আতঙ্ক বাড়ছে। ৪ ডিসেম্বর রাতে দুই ঘণ্টার ব্যবধানে তিনটি স্থানে ককটেল হামলা হয়েছে।  

এর আগে গত ২০, ২৬, ২৮ নভেম্বর ও ২ ডিসেম্বর শান্তিমোড়ের একটি কুরিয়ারের গাড়িতে পেট্রোল বোমা হামলার চেষ্টা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ বাস ও মিনিবাস মালিক সমিতির কার্যালয় সামনে, শান্তিমোড়ে, বিশ্বরোড মোড়ে, জেলা নির্বাচন অফিস এবং বিএনপি থেকে সদ্য পদত্যাগ করা বিএনএম মনোনীত এমপি প্রার্থী সাবেক মেয়র মাওলানা আব্দুল মতিনের বাড়ি লক্ষ্য করে ককটেল বিস্ফোরণ ঘটানো হয়।

সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) চাঁপাইনবাবগঞ্জ  জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক মনোয়ার হোসেন জুয়েল জানান, নির্বাচনকে সামনে রেখে অস্ত্র ও বিস্ফোরকের চোরাচালান বেড়েছে। সীমান্তে বন্ধ হচ্ছে না চোরাচালান। ধরা পড়ছে না মূলহোতারা। এমনকি শহরের ককটেল হামলাগুলো কারা করেছে, সেটাও শহরবাসী অবগত নয়। নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে, ততই আতঙ্ক বাড়ছে। এতে প্রকৃত হামলাকারীরা আরও উৎসাহিত হবে।

জেলা শহরের শান্তিমোড়ের এক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী তৌহিদ জানান, একের পর এক ককটেল বিস্ফোরণের কারণে তারা অনেকটা আতঙ্কে রয়েছেন। ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলে রাখতে যেমন ভয় হচ্ছে, তেমনি এসব ককটেল ফোটার কারণে ক্রেতাও আসছে না। আর নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে, আতঙ্ক ততই বাড়ছে।  

এ ব্যাপারে ৫৯ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল গোলাম কিবরিয়া দাবি করেন, নির্বাচনকে সামনে রেখে চোরাচালান বাড়লেও বিজিবির কঠোর নজরদারির কারণে তা অনেকটাই এখন নিয়ন্ত্রণে। আর যেসব অস্ত্র বা বিস্ফোরক নাশকতার উদ্দেশে আনার চেষ্টা হয়েছে, সবগুলোই জব্দ করা সম্ভব হয়েছে। মূল আসামিরা আটক না হলেও সীমান্ত সম্পূর্ণ বিজিবির নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। তাই নির্বাচনকে সামনে রেখে উদ্বিগ্ন হওয়ার কোনো কারণ নেই।
এ বিষয়ে র‌্যাবের চাঁপাইনবাবগঞ্জ ক্যাম্প কমান্ডার মেজর মারুফুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তা সম্ভব হয়নি।  

সচেতন নাগরিক সমাজের (সনাক) ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য অ্যাডভোকেট সাইফুল ইসলাম রেজা জানান, এবারের নির্বাচনে যে প্রাণ থাকার কথা, সেটা নেই। তারপরও যেটুকু আছে, নির্বাচন কমিশনকে সেটুকু ধরে রাখতে হবে। নিরাপত্তা পুরোপুরি নিশ্চিত করতে হবে। আর সীমান্ত দিয়ে যেভাবে অস্ত্র ও বিস্ফোরক চোরাচালান বাড়ছে, তা উদ্বেগজনক। যে কোনো মূল্যে এসব চোরাচালান বন্ধের পাশাপাশি এর মূলহোতাদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে হবে। না হলে এ নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হবে।

চাঁপাইনবাবগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. আবুল কালাম শাহিদ জানান, নির্বাচনকে সামনে রেখে চাঁপাইনবাবগঞ্জে নাশকতার আশঙ্কা তো রয়েছেই। তবে পুলিশ সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থায় রয়েছে। যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যথেষ্ট তৎপর রয়েছে। নির্বাচনের আগ দিয়ে সীমান্ত দিয়ে যে সমস্ত আগ্নেয়াস্ত্র ও বিস্ফোরক এসেছে, তার বড় অংশই জব্দ করতে সক্ষম হয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তারপরও নির্বাচনকে ঘিরে যেন কোনো অঘটন না ঘটে, এজন্য সব রকম প্রস্তুতি রেখেছে পুলিশসহ সব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

বাংলাদেশ সময়: ১৪০৯ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৫, ২০২৪
এসআই

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।