ঢাকা, রবিবার, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৮ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্টের দুর্বল ব্যবস্থাপনায় ছন্নছাড়া প্রকল্প

জহিরুল ইসলাম, পটুয়াখালী | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫৩৭ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২, ২০২৪
জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্টের দুর্বল ব্যবস্থাপনায় ছন্নছাড়া প্রকল্প

পটুয়াখালী: পটুয়াখালীর দুমকি উপজেলার লেবুখালী ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের মৃত কান আলী মল্লিকের ছেলে আইয়ুব আলী মল্লিকের নামে ‘জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত দুমকি উপজেলায় নিরাপদ পানি সরবরাহ’ প্রকল্পের আওতায় একটি গভীর নলকূপ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। তবে প্রকল্প সমাপ্ত হলেও তার বাড়িতে কোনো নলকূপ স্থাপন করা হয়নি।

অথচ স্থানীয় প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর দেখিয়েছে আইয়ুব আলীর বাড়িতে ৩০১১ দশমিক ৯৬ মিটারের গভীরতায় একটি সচল নলকূপের উল্লেখ করা হয়েছে।

তবে আইয়ুব আলী মল্লিকের বাড়ি থেকে এক কিলোমিটার দূরে মো. নাসির উদ্দীন নামের এক ব্যক্তির ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের পেছনে আইয়ুব আলীর নামেই স্থাপন করা হয়েছে নলকূপ। এদিকে প্রতিটি নলকূপের বিপরীতে উপকার ভোগীদের কাছ থেকে সরকারি ফি নিয়েও ১০ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধিরা অবৈধ লেনদেন করেছে বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে। শুধু আইয়ুব আলী নয়, এই প্রকল্পের অধিকাংশ জায়গায় বেশ কয়েকটি অনিয়ম দেখা গেছে।

২০২০ সালে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট পটুয়াখালী জেলায় দুমকি উপজেলায় এই প্রকল্পের আওতায় এক কোটি ৫০ লাখ টাকা ব্যয়ে স্থানীয় নাগরিকদের পর্যাপ্ত পরিমাণ নিরাপদ পানি সরবরাহ নিশ্চিতকরণ, পানি সরবরাহের কভারেজ বৃদ্ধি ও জনগণের পানি বাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব হ্রাসকরণে ১৫৫টি গভীর নলকূপ স্থাপন প্রকল্পের অনুমোদন করে।  

ট্রাস্টের ৫২তম সভায় ২০২০ সালে মার্চ মাসে প্রকল্পটি অনুমোদন পাওয়ার পরে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরকে উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) প্রণয়নের নির্দেশ প্রদান করে। পরে স্থানীয় উপজেলা চেয়ারম্যান ড. হারুন অর রশীদ হাওলাদার তার নিজস্ব প্যাডে প্রকল্পের ১৫৫ জন উপকার ভোগীর তালিকা জমা করেন। তালিকা অনুযায়ী একই বছর দুইটি প্যাকেজে নলকূপ স্থাপন টেন্ডার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর। কার্যাদেশ পেয়ে এম/এস কামাল ও এম/এস তারিফ অ্যান্ড কোং নলকূপ স্থাপন শুরু করে।

উপকার ভোগীদের নাম, পিতার ও ঠিকানা অনুযায়ী বরাদ্দ থাকলেও নীতিমালায় একটি বাড়িতে একটি সরকারি নলকূপ স্থাপনের কথা থাকলেও মানা হয়নি কোনো নিয়ম। কারও কারও নলকূপ বসেছে একক পরিবারের রান্না ঘর বা টয়লেটের পাশে। এছাড়াও নীতিমালায় নাম থাকলেও আজ পর্যন্ত কোনো নলকূপ পায়নি অনেকেই।

এরকমই একজন আঙ্গারিয়া ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডে আবু জাফর জোমাদ্দার। তালিকায় নাম থাকলেও আজ পর্যন্ত বসেনি টিউবওয়েল। তার আশপাশের আরও পাঁচটি পরিবার ১/২ কিলোমিটার দূর থেকে তাদের খাবার পানি টেনে আনতে হচ্ছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় কাজসহ নারী ও শিশুরা গোসল ও শৌচা কার্য করছেন নোংরা পরিত্যক্ত জলাশয়ের পানি দিয়ে। এছাড়াও মুরাদিয়া ইউনিয়নে ২ নম্বর ওয়ার্ডের হাবিবুল্লাহ, ৭ নম্বর ওয়ার্ডের মান্নান হাওলাদার, সুমন ফকির, সোহেল মীর ও ৯ নম্বর ওয়ার্ডের লিটন হাওলাদারসহ অসংখ্য মানুষ নিরাপদ পানির কষ্টে হাহাকার করছেন।

লেবুখালী ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের মৃত্যু আখতার সরদারের ছেলে ইউনুস সরদারের নামে একটি নলকূপ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে এটি তার রান্না ঘরে পাশে বসানো হয়। কিন্তু এই বাড়িতে পাশাপাশি তিনটি মাত্র ঘর। একই বাড়িতে অন্য প্রকল্পের আরও দুইটি নলকূপ থাকলেও জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্টের বরাদ্দে আরও একটি নলকূপ বসানো হয়। এটিও এককভাবে বসানো হয়। বেশির ভাগই রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী, জনপ্রতিনিধিদের আত্মীয় স্বজন ও কর্মী, ইউনিয়ন পরিষদের জনপ্রতিনিধিদের বাড়িতে। অধিকাংশ পরিবার আর্থিকভাবে সচ্ছল ও স্বাবলম্বী। এরা সবাই নলকূপের সঙ্গে বৈদ্যুতিক মোটর সংযোগ লাগিয়ে পানির ট্যাংক ব্যবহার করেছেন। অথচ এই প্রকল্প প্রান্তিক জনগোষ্ঠী ও নিম্ন আয়ে গ্রামের মানুষের নিরাপদ পানির সুবিধা প্রদান ছিল মূল উদ্দেশ্য। যা ৯৫% শতাংশ পূরণ করা হয়নি।

ডিপিপি অনুযায়ী প্রকল্প বাস্তবায়ন, মনিটরিং ও রক্ষণাবেক্ষণে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরকে দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছে। মাঠ পর্যায়ে এত অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার বিষয়টি মাথায় না নিয়েই নামমাত্র ও ছন্নছাড়া অবস্থায় প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে সংস্থাটি। এই প্রকল্প ছাড়াও এই অধিদপ্তরের নিরাপদ পানি সরবরাহে আরও কয়েকটি প্রকল্প চলমান রয়েছে। তাতেও যে যার মত করে সরকারি নলকূপের এককত্ব দখল নিয়ে আছে। অথচ এই উপজেলায় এখন নিরাপদ পানির অভাবে আছে শত শত পরিবারের হাজার হাজার মানুষ।

আমরা প্রকল্পের কয়েকজন উপকার ভোগীদের সঙ্গে কথা বলেছি। এদের মধ্যে লেবুখালী ১ নম্বর ওয়ার্ডের শাহআলম খান বাড়ির নাসিমা বেগম জানান, সরকারি এই নলকূপটি পেতে তাদের খরচ হয়েছে ৩০ হাজার টাকা। আঙ্গারিয়া ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডে সৈয়দ বাড়িতে একই প্রকল্পের নলকূপ বসেছে পাঁচটি। তারা সবাই সরকারি দলের রাজনৈতিক কর্মী। তাদেরও একটি নলকূপের জন্য ১৫/২০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে বলে জানিয়েছেন উপকারভোগীর ভাইয়ের ছেলে ইমরান হোসন ও উপকার ভোগী সৈয়দ শাহিনের স্ত্রী সৈয়দ জাহিদা বেগম।  

এছাড়াও মুরাদিয়া ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডে মজিদ হাওলাদারের ছেলে খলিলুর রহমানের নাম জলবায়ু ট্রাস্টের প্রকল্পে থাকলেও নলকূপ বসেছে অন্য প্রকল্পের। একই নামে দুইটি নলকূপ বরাদ্দ দেওয়া হলেও একটি বসিয়ে অন্যটিও বাস্তবায়ন দেখানো হয়েছে।

প্রকল্প সংশ্লিষ্টরাও একে অপরের ওপর দোষ চাপাচ্ছেন। কেউ দাপ্তরিক অ-সক্ষমতা ও জনবল সংকট ও রাজনৈতিক প্রভাবের কথাও বলেছেন। এই সুযোগে ফায়দা লুটে নিচ্ছে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা, সরকারি প্রকল্পের টাকায় নিজেদের ভোটের রাজনীতি শক্ত করছেন। লুটে নিচ্ছে অবৈধ অর্থ।

এ বিষয়ে দুমকি জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের উপ-সহকারী প্রকৌশলী নিপা বেগম বলেন, আমরা মন্ত্রণালয় বা অধিদপ্তর থেকে তালিকা পেয়ে সে অনুযায়ী টেন্ডার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছি। তালিকায় থাকা ব্যক্তির জাতীয় পরিচয়পত্র যাচাই করে সাইট নির্ধারণ করে দেই। সেখানে ঠিকাদার নলকূপ বসায়। তবে এক বাড়িতে অনেক সরকারি নলকূপ বা কেউ টয়লেট বা রান্না ঘরে বসিয়েছে এমন অভিযোগ পাইনি। আমরা তদন্ত করে দেখবো।  

প্রকল্পের পরিচালক ও গোপালগঞ্জের জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী ফয়েজ আহমেদ বলেন, আমাদের গাইড লাইন আছে। কোনো বাড়িতে সরকারি নলকূপ থাকলে নতুন করে আর নলকূপ স্থাপনের সুযোগ নেই। প্রকল্পের ডিপিপিতে সাইট সিলেকশন করা থাকে, বাহিরে যাওয়ার সুযোগ নেই। আমরা স্থানীয় সংসদ সদস্য ও উপজেলা চেয়ারম্যানের থেকে তালিকা পাই সে অনুযায়ী কাজ করি। তবে আগে কে নলকূপ পেয়েছে বা কে পাইনি এসব তথ্য আমাদের কাছে থাকে না। আমরা শুধু কাজটা বাস্তবায়ন করি।

দুমকি উপজেলা চেয়ারম্যান ড. হারুন অর রশীদ হাওলাদার সব অনিয়ম ও অবৈধ লেনদেন বিষয় অস্বীকার করে বলেন, আমরা স্থানীয় চেয়ারম্যান ও ইউপি সদস্যদের মাধ্যমে তালিকা তৈরি করে অনুমোদন করিয়ে এনে দেই। তারপর এটা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর ও ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান মিলে বাস্তবায়ন করে। তারা কোথায় কী করে জানি না। কেউ যদি আমার নামে অবৈধ অর্থ লেনদেন করে থাকে, তাহলে আমার করার কিছু নেই।

বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সরকারের অতিরিক্ত সচিব মো. জয়নাল আবেদীন বলেন, যে সব অভিযোগ গুলো আসছে, তা অবশ্যই নিন্দনীয়। আসলে আমাদের জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে কোনো জনবল নেই। ট্রাস্টি বোর্ডের সভায় অনুমোদিত তালিকা সংশ্লিষ্ট দপ্তরে বাস্তবায়নের জন্য পাঠিয়ে দেন। তারা তাদের নীতিমালা অনুযায়ী ও জনপ্রতিনিধিদের নির্দেশনা অনুযায়ী বাস্তবায়ন করে।  

প্রকল্প বাস্তবায়নে আমরা সম্পূর্ণ অন্য দপ্তরের ওপর নির্ভরশীল। যারা বাস্তবায়ন করে, তারা কেউ আমার অধীন নয়, যে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব। আমরা পারি তদন্ত করে সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তরের কাছে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য অনুরোধ করতে। এটাই নিয়ম, মাঠপর্যায়ে প্রকল্প দেখার মতো সক্ষমতা নেই। আমরা অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেব।

বাংলাদেশ সময়: ১৫৩৭ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২, ২০২৪
এসএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।