ঢাকা: ‘এবার ঈদে বাড়ি যাওয়া হচ্ছে না। যে বেতন-বোনাস পাব, তা দিয়ে সবার জন্য কেনাকাটা, যাতায়াতের খরচ মিটিয়ে ঈদের পর সংসারের খরচ চালাতে ঝামেলায় পড়তে হবে।
এমন ঈদ ভাবনা রোজিনার। মিরপুরে আরমানা গ্রুপের পোশাক কারখানা জিতা অ্যাপারেলসের শ্রমিক তিনি। প্রতিষ্ঠানটিতে প্রায় এক যুগ ধরে চাকরি করছেন।
২০০৭ সালে পিরোজপুর থেকে ঢাকায় আসেন রোজিনা। তার বাবার নাম রুস্তম আলী শেখ। বাবার আর্থিক অবস্থা ভালো না হওয়ায় লেখাপড়া করাতে পারেননি। প্রাথমিকেই চুকে যায় রোজিনার লেখাপড়ার পর্ব। এক পরিচিতের সহযোগিতায় ঢাকায় চাকরি নেন।
বর্তমানে জিতা অ্যাপারেলস কারখানায় চাকরি করেন রোজিনা। মাসে বেতন প্রায় ১৫ হাজার টাকা। শুরুতে তিনি একটি কারখানার হেলপার হিসেবে কাজে যোগ দেন। কারখানাটি ছিল সাব-কন্টাক্টের। বেতন নিয়মিত হচ্ছিল। তৈরি পোশাক কারখানার চাকরি সম্পর্কে তার ধারণা হয়ে যায়। চলে যান মহাখালীর আরেকটি কারখানায়। সেখানেও চাকরি নেন হেলপার হিসেবে। কারখানাটি বেশ ভালো। বেতন ঠিক মতো দেয়। শ্রম আইন মানার ক্ষেত্রেও অন্যান্য কারখানার চেয়ে ভালো।
রোজিনা বলেন, হেলপার হিসেবে বেতন কম। বেতনের টাকা দিয়ে ঢাকায় নিজে চলে বাড়িতে পাঠানোর মতো টাকা থাকছিল না। বাড়িতে টাকা পাঠাতে হলে হেলপার থেকে অপারেটর হতে হবে। বাড়িতে বাবা-মা আছে, আছে ছোট্ট একটি ভাই। তাদের জন্য আমাকে এটা করতে হবে। কিন্তু হেলপার থেকে অপারেটর হওয়া সহজ না। অনেক পরিশ্রম করতে হয়। তাই শুরু করলাম... দুপুরে অপারেটররা এক ঘণ্টা সময় ধরে খাওয়া-দাওয়া করে, রেস্ট নেয়। এই সময়ে আমি আধা ঘণ্টার মধ্যে খাওয়া-দাওয়া শেষ করে আমার অপারেটরের মেশিনে বসে কাজ শেখা শুরু করি।
‘এই কাজ করতে হলে সারা দিন বেশি বেশি কাজ করে অপারেটরের মন জোগাতে হয়। তাই করতাম। এভাবে দুপুরের খাওয়ার সময়ে আধা ঘণ্টা করে কাজ শিখি। অপারেটর টয়লেটে গেলে, নিডল বা সাপ্লাই নিতে গেলে আমি মেশিনে বসে কাজ চালিয়ে যাই। এভাবে ছয় মাসের মধ্যে অপারেটরের কাজ শিখে যাই। ’
রোজিনা বলেন, অপারেটর হিসেবে কাজ শিখলেও বেতন বাড়ে অনেক দেরিতে। কাজ করার জন্য মেশিনও দেয়। কিন্তু বেতন বাড়ে খুবই কম। তাই কারখানার এক স্যারের পরামর্শে অন্য কারখানায় অপারেটরের চাকরি নিয়ে চলে যাই। বেতনও বেশি পাই। কিন্তু কিছুদিন যেতেই কারখানাটির বেতন অনিয়মিত হয়ে যায়। শুরু হয় নানা অনিয়ম। তাই সেখান থেকে আবার আগের কারখানায় চলে আসি। এবার অপারেটর হিসেবেই চাকরি পাই। বেতনও বেশি ধরে। তৈরি পোশাক কারখানায় বেশি বেতন পেতে হলে এটাই করতে হয়।
বাবার আর্থিক অবস্থা খারাপ হওয়ায় রোজিনা নিজে লেখাপড়া করতে পারেননি। বাবার সংসারের সেই অভাবকেই দূর করতে চান তিনি। ছোট ভাইকে লেখাপড়া শেখাতে চান। বেতন থেকে নিজের খরচ রাখার পর বাড়তি টাকাগুলো বাড়িতে পাঠিয়ে দেন।
রোজিনার পরিবারের অভাব অনেকটাই ঘুচে যায়। দারিদ্র্য নেই, নেই হতাশা। বাড়ির অভাব দূর হয়েছে। সেই সুখধারা পল্লবিত হয় এক সহকর্মীকে জীবনসঙ্গী হিসেবে বাছাইয়ে। অন্তত তাই মনে করেছিলেন রোজিনা। দুজনের সম্মতিতে হয় বিয়ে। সব পারিপার্শ্বিকতা দূরে ঠেলে হেলপার থেকে অপারেটর হওয়া, কারখানা বদল করে বেশি বেতন পাওয়া, সংসার জীবন শুরু... রোজিনার কাছে যেন অধরা সবকিছুই ধরা দিতে থাকে।
‘শালিক শুক বুলায় মুখ
থল ঝাঁঝির মখমলে,
জরির জাল আংরাখায়
অঙ্গ মোর ঝলমলে। ‘
সত্যেন্দ্র নাথ দত্তের ‘ঝর্নার গান’ কবিতার ছন্দের মতোই আনন্দের সংসার হয় রোজিনার। নিজের সংসারের পাশাপাশি বাড়িতেও টাকা পাঠাতে থাকেন তিনি। সব ঠিকঠাক চলছিল। কিন্তু ‘দুল দোলায় মন ভোলাই‘য়ের দিগ্বিদিকে হঠাৎ করে অশ্বত্থের ছায়া ফেলে। বেতনের টাকা শ্বশুরবাড়িতেও পাঠাতে হবে। একে একে দাবি ওঠে আরও। এই দাবি আস্তে আস্তে রূপান্তর হয় নির্যাতনে।
‘আর সহ্য করতে পারছিলাম না। কারখানার পরিশ্রম, স্বামীর নির্যাতন, বাবা-মায়ের জন্য কিছু টাকা পাঠাতে না পারার কষ্ট...। চাপ সহ্য করতে পারছিলাম না, অসুস্থ হয়ে পড়ি’, বলেন রোজিনা।
এক পর্যায়ে বাপের বাড়ি পিরোজপুরে চলে যান তিনি। সঙ্গে যান তার স্বামীও। এক সময়ে সংসারের অভাব দূর করে সচ্ছলতা এনেছিলেন। অসুস্থতার কারণে বাড়ি গিয়ে আবার সেই অমানিশা জেঁকে বসে। আর বাড়তি বোঝা হিসেবে তো জুটেছে স্বামীও!
রোজিনা বলেন, এ অবস্থায় আমি কূল-কিনারা পাচ্ছিলাম না। এক সময় বাধ্য হয়ে সিদ্ধান্ত নিলাম সংসারই করব না। সুস্থ হলাম। শেষে ২০১২ সালের ডিসেম্বরে বাবা-মায়ের মতামতের বিরুদ্ধে আবার মিরপুরে এসে জিতা অ্যাপারেলস গার্মেন্টস কারখানায় চাকরি নিলাম। এখনো সেই কারখানাতেই চাকরি করছি।
তিনি বলেন, এখন প্রায় ১৫ হাজার টাকা বেতন পাই। এই টাকা থেকে ছোট ভাইকে কিছু দিতে হতো। এখন সেও চাকরি করে। বাবা-মাকে টাকা দেই, বাবা-মা এখন ভালোই আছেন।
সিনিয়র অপারেটরের পাশাপাশি রোজিনা এখন কারখানাটির শ্রমিক প্রতিনিধিও। শ্রমিকদের ভালো-মন্দ দাবি পেশ করেন। শ্রমিকরা তার কাছে সুখ-দুঃখের কথা বলেন। কারখানা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে দেন-দরবার করে কখনো শ্রমিকদের সেই দাবি আদায় করতে পারেন, কখনো পারেন না।
দেশের গুরুত্বপূর্ণ রপ্তানি খাত তৈরি পোশাকশিল্প। মোট রপ্তানি আয়ের প্রায় ৮৫ ভাগ আসে তৈরি পোশাক রপ্তানি করে। প্রায় ৪০ লাখ মানুষ এ শিল্পে কর্মরত। আর রোজিনাদের অংশগ্রহণ এর ৭০ শতাংশের কাছাকাছি। যাদের শ্রম ঘামে বছরে পাঁচ লাখ কোটি টাকার বেশি বৈদেশিক মুদ্রা আসছে, যা দেশকে আর্থিক সক্ষমতা দিয়েছে।
কিন্তু বেতনের টাকা দিয়ে নিজে চলার পাশাপাশি বাড়িতে পাঠানোর পর কোনো সঞ্চয় থাকে না রোজিনার। বাবা-মাকে ঈদের খরচের টাকা পাঠানোর পাশাপাশি আত্মীয়-স্বজনের জন্য কিছু কেনাকাটা করতে হবে। এরপর আর তার হাতে বাড়তি টাকা থাকবে না। বাড়িতে গেলে বাড়তি খরচ করতে হবে, ঈদ বোনাস পেলেও তা দিয়ে কুলাবে না। এ কারণে এবার ঈদে বাড়িতে যাবেন না রোজিনা।
ঈদের ছুটিতে বাবা-মা, চেনা মানুষগুলোর সঙ্গে দেখা হয়। বাড়িতে না গেলে প্রিয় মুখগুলো দেখা হবে না, খুব খারাপ লাগবে। তারপরও যেতে পারছি না। আগামী ঈদে বা কোনো সময়ে দেখা হবে। মোবাইল ফোনে কথা হবে, এতে নিজেকে সান্ত্বনা দেব, বলেন এই লড়াকু পোশাকশ্রমিক।
বাংলাদেশ সময়: ১৬৪৩ ঘণ্টা: মার্চ ২১, ২০২৪
জেডএ/এমজেএফ