ফরিদপুর: ফরিদপুরের মধুখালীর পঞ্চপল্লীতে দুই কিশোর সহোদরকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় ডুমাইন ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান শাহ মো. আসাদুজ্জামান তপন ও মেম্বার অজিত কুমার সরকারকে গ্রেপ্তারে সহায়তা করতে পুরস্কার ঘোষণা করেছে জেলা প্রশাসন।
শুক্রবার (২৬ এপ্রিল) সন্ধ্যায় মধুখালীর ঘটনা পরবর্তী সামগ্রিক বিষয় নিয়ে প্রেস ব্রিফিংয়ে জেলা প্রশাসক কামরুল আহসান তালুকদার এ ঘোষণা দেন।
এসময় জেলা প্রশাসক বলেন, চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান তপন একজন হ্যাভিচ্যুয়াল অফেন্ডার (স্বভাবগত অপরাধী)। কোথায় কখন কীভাবে লুকিয়ে থাকতে হয় সেটি তিনি ভালো জানেন। তিনি আত্মগোপনে যাওয়ার আগে মোবাইল ফোন রেখে গেছেন। এর আগে আমরা মাগুরায় তার অবস্থান শনাক্ত করি। কিন্তু যখন তাকে ধরার জন্য অভিযান চালানো হয় তখন যশোরে পালিয়ে যান। এরপর যশোরে তাকে ধরতে অভিযান চালানো হলেও পাওয়া যায়নি।
কামরুল আহসান তালুকদার বলেন, ইউপি চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান তপনকে এর আগে দুইবার বরখাস্ত করা হয়েছিল। একবার ইউএনওর ওপরে হামলার ঘটনায় এবং আরেকবার টিসিবির কার্ড দুর্নীতির কারণে। দুইবারই উচ্চ আদালতে আপিল করে তিনি পদ ফিরে পান। এ কারণে তার মধ্যে এক ধরনের বেপরোয়া মনোভাব তৈরি হয়েছে। তিনি ভেবেছিলেন, যতো অপরাধই করুক না কেন তিনি পার পেয়ে যাবেন।
ঘটনার পর ধর্মমন্ত্রী ফরিদুল হক খানের পঞ্চপল্লী সফরের সময়েও চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান তপনকে মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা গেছে, এ প্রশ্নের জবাবে জেলা প্রশাসক বলেন, তার দ্বৈত ভূমিকার কারণে তাকে সেভাবে সন্দেহের তালিকায় রাখা হয়নি। তবে যখন ভিডিও ফুটেজ প্রকাশ হয়, তখন তিনি আত্মগোপনে চলে যান।
জেলা প্রশাসক এ ঘটনায় জড়িতদের উদ্দেশ্যে বলেন, তারা যেন দ্রুত আত্মসমর্পণ করেন। তারা তাদের আইনগত সুবিধা নিতে পারেন।
তিনি বলেন, এ ঘটনায় দায়ের মামলার আসামিদের গ্রেপ্তারে সবার সহযোগিতা চাই। তাদের ধরিয়ে দেওয়ার জন্য আমরা সবার সহযোগিতা চাই। কেউ যদি অন্য আসামিদের অবস্থানও জানাতে পারেন, তাহলে তাদের উপযুক্ত পুরস্কার দেওয়া হবে।
তিনি পঞ্চপল্লীর ঘটনায় গণমাধ্যমের ভূমিকার প্রশংসা করে বলেন, এ ঘটনার পর ফরিদপুরের সাংবাদিকেরা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট হতে পারে এমন একটি নিউজও করেননি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও ফরিদপুরের সাংবাদিকদের এই আচরণে তাদের প্রশংসা করেছেন। ঘটনার পর আমাদের সঙ্গে ওই রাতে ঘটনাস্থলেও থেকেছেন তারা। তারা প্রত্যেকটি জায়গায় উপস্থিত থেকে পুরো বিষয়টি যথাযথভাবে উপস্থাপন করায় এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে যে বিষবাষ্প ছড়ানোর আশঙ্কা ছিল, সেই সুযোগ কেউ পায়নি।
‘এ পর্যন্ত আপনারা যথেষ্ট দায়িত্বশীল আচরণ করেছেন। এটি সমগ্র ফরিদপুরের মর্যাদা রক্ষা করেছে। বাকি দিনগুলোতে যেন আমরা সবাই মিলে ফরিদপুরে এই সহাবস্থান অব্যাহত রাখতে পারি, সে আহ্বান জানাচ্ছি। ’
জেলা প্রশাসক বলেন বলেন, এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করার পাঁয়তারা চালানোর চেষ্টার কোনো খবর যদি থাকে, সে বিষয়ে তথ্য দেওয়ার জন্য আপনাদের কাছে অনুরোধ করছি।
তবে কোনো কোনো মহল এ ঘটনাকে সাম্প্রদায়িক হিসেবে চিহ্নিত করতে চেষ্টা চালাচ্ছেন বলেও অভিযোগ করেন জেলা প্রশাসক। তিনি বলেন, তারা এটিকে হিন্দুদের হাতে মুসলিম শ্রমিকদের হত্যা হিসেবে উপস্থাপন করছেন। এটি সঠিক নয়।
তিনি নিহতদের পরিবারকে ধর্মমন্ত্রী এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রীর পক্ষ থেকে নগদ আর্থিক সহায়তা করা ছাড়াও জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সার্বিক সহায়তার তথ্য তুলে ধরেন। পাশাপাশি এ ঘটনায় আহতদের চিকিৎসা ও তাদের পরিবারকে জীবিকা নির্বাহের জন্য খাদ্য সামগ্রী প্রদান ও কর্মসংস্থানের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে বলে জানান।
এ ঘটনাকে যেন সাম্প্রদায়িক উসকানির কাজে কেউ ব্যবহার করতে না পারে সেদিকেও সবাইকে সতর্ক থাকার অনুরোধ জানান তিনি।
জেলা প্রশাসক বলেন, এ ঘটনার পর অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (নেজারত) মো. আলী সিদ্দিকীকে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। তবে ঘটনার পর উদ্ভূত পরিস্থিতিতে তদন্ত যথাসময়ে সম্পন্ন করা যায়নি। এজন্য তারা সময় চেয়েছে। তাদের লিখিত আবেদনের প্রেক্ষিতে তদন্ত কমিটির মেয়াদ আরও সাতদিন বাড়ানো হয়েছে।
তিনি বলেন, এ ঘটনায় নিরপরাধ ব্যক্তিদের ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই। কোনো বাড়িতে আক্রমণ করে পরিস্থিতি ভিন্নখাতে প্রবাহের চেষ্টা চলছে। এজন্য আসামিরা গ্রেপ্তার না হওয়া পর্যন্ত এবং তদন্ত রিপোর্ট না দেওয়া পর্যন্ত মধুখালীতে পর্যাপ্ত পুলিশ মোতায়ন থাকবে।
সংবাদ সম্মেলনে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (নেজারত) মোহাম্মদ আলী সিদ্দিকী, ডিডিএলজির উপপরিচালক রওশন চৌধুরী, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) ইয়াসিন কবীর, সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তামান্না তাসনিম, ফরিদপুর প্রেসক্লাবের সভাপতি কবিরুল ইসলাম সিদ্দিকীসহ জেলা প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা এবং সংবাদকর্মীরা উপস্থিত ছিলেন।
গত ১৮ এপ্রিল সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে মধুখালীর ডুমাইনের পঞ্চপল্লিতে কালি মন্দিরে আগুন দেওয়ার সন্দেহে গুজব ছড়িয়ে বাঁশ, লাঠি ও রড দিয়ে পিটিয়ে ও ইট দিয়ে থেতলিয়ে দুই কিশোর সহোদর শ্রমিক আশরাফুল খান (১৭) ও আরশাদুল খানকে (১৫) হত্যা করা হয়। গুরুতর জখম করা হয় আরও পাঁচজনকে। তারা সেখানে পঞ্চপল্লী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শৌচাগার নির্মাণে কাজ করছিলেন। এ ঘটনায় চারটি মামলা করা হয়েছে।
বাংলাদেশ সময়: ২২০৭ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৬, ২০২৪
এইচএ/