রাত ১২টা। রাজধানীর বারিধারার কোকাকোলার টেকবাড়ী এলাকার বাসিন্দা নজরুলের ছয় মাসের মেয়ে হালিমা পেটের অসুখে কাহিল।
তখন একজন পরিচিত ব্যক্তি পরামর্শ দেন ব্যাটারিতচালিত অটোরিকশার চালক সোহেলের মোবাইল নম্বরে কল দিতে। নম্বর পেয়ে নজরুল কল দেন সোহেলের নম্বরে। অসুস্থ মেয়েকে হাসপাতালে নিতে হবে বললে দ্রুতই অটোরিকশা নিয়ে ছুটে আসেন সোহেল। নজরুল, তার স্ত্রী ও মেয়েকে নিয়ে চলে যান কলেরা হাসপাতালে। সেখানে ভর্তি করে চিকিৎসা দেওয়া হয় হালিমাকে। ঘড়ির কাঁটায় তখন রাত আড়াইটা। নজরুল ভাড়া দিতে জোরাজুরি করলেও সোহেল নেননি।
হালিমার বয়স এখন দেড় বছরের বেশি। দিনে দিনে খুনসুটিতে হচ্ছে বড়। বছরখানেকেরও বেশি সময় আগে, অর্থাৎ ২০২৩ সালের ১৭ এপ্রিল রাতে ছোট্ট হালিমার জন্য সোহেলের সেই ছুটে আসা, হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া এখনো মনে আছে নজরুলের।
বাংলানিউজের সঙ্গে আলাপকালে নজরুল বলছিলেন, ‘সোহেল ভাই আমার মেয়েকে নিয়ে হাসপাতালে দিয়ে এসেছেন। ভাড়া দিতে চেয়েছি, জোরাজুরি করেছি, উনি নেননি!’
শুধু হালিমা নয়, এমন কয়েক ডজন রোগীকে গভীর রাতে বিনা ভাড়ায় হাসপাতালে পৌঁছে দিয়েছেন সোহেল। এদের মধ্যে একজন মো. নাজমুল। গত বছরের ৩০ জুলাই তাকে রাত ৪টার সময় কুড়িলের কুড়াতলী এলাকা থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে পৌঁছে দিয়েছেন সোহেল। ওই বছরের ৯ এপ্রিল রাত ২টার দিকে নর্দা থেকে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে পৌঁছে দিয়েছেন ফয়জুল ইসলাম নামে এক রোগীকে।
পটুয়াখালী সদরের বাসিন্দা সোহেল থাকেন বারিধারার কোকাকোলার টেকবাড়ী এলাকায়। পরিবারে আছে তার স্ত্রী-সন্তান। বাবা বেঁচে নেই। জন্মদাত্রী মা-ও বেঁচে নেই। আছেন তার ছোট মা (বাবার দ্বিতীয় স্ত্রী)।
মঙ্গলবার (৩ জুলাই) রাত ১১টার দিকে নর্দা বাসস্ট্যান্ড এলাকায় দেখা মেলে সোহেলের। লাল-সবুজ বাতি দিয়ে সজ্জিত অটোরিকশা। ঝলমলে আলোয় সহজেই আলাদা করা যায় তার গাড়ি। সামনে লেখা, ‘রাত ১০টার পর হইতে ভোর ৫টা পর্যন্ত ঢাকার মধ্যে যে কোনো হাসপাতালে রোগী নেওয়ার জন্য অটোরিকশা ভাড়া সম্পূর্ণ ফ্রি। আমি যে রোগী হাসপাতালে নিয়ে যাবো, ওই রোগী যদি টাকার জন্য ওষুধ কিনতে না পারে আমার তরফ থেকে যতটুকু সম্ভব সহযোগিতা করবো’। এই বার্তার পর উল্লেখ করা আছে সোহেলের নাম ও মোবাইল নম্বর।
সোহেলের সঙ্গে কথা হচ্ছিল বাংলানিউজের। তিনি বলছিলেন, যে কোনো রোগী রাতে হাসপাতালে যেতে চাইলে তিনি বিনা ভাড়ায় পৌঁছে দিয়ে থাকেন। এমনকি কোনো রোগীর কাছে যদি টাকা না থাকে, প্রয়োজনে ওষুধ কেনার জন্য যথাসাধ্য সহায়তাও করে থাকেন তিনি।
সোহেল এই কাজটি করছেন দুই বছর ধরে। শুরু করার কারণ হিসেবে বলেন, ‘খ্রিস্টান বিল্ডিং (ভাটারা) এলাকায় একদিন অনেক রাতে দেখলাম, এক নারী রাস্তায় তার বাচ্চাকে নিয়ে কাঁদছেন। হাসপাতালে নিতে পারছেন না। এলাকায় অতো রিকশাও নেই। আবার যারা আছে, তারা এলাকায় চলে, দূরে যায় না। পরে আমি তাদের ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যাই। ওই মা খুব আবেগ প্রকাশ করেছিলেন সেদিন। ওইদিন মনে হলো, কেউ এভাবে বিপদে পড়লে যেন আমাকে ডাকে, যেন তাদের হাসপাতালে পৌঁছে দিতে পারি, সেজন্য গাড়িতে আমার নম্বরসহ এটা লিখে দিয়েছি। ’
এই মানবিক কাজ করার উদ্দেশ্য কী জানতে চাইলে সোহেল বলেন, ‘এই কাজটা করি, যেন আমার ভালো কাজের সুবাদে আমার (মরহুম) মা-বাবার ভালো হয়। ’
সোহেল প্রথম দিকে রোগীদের এভাবে পৌঁছে দেওয়ার কোনো তথ্য রাখতেন না। তার ভাষ্যে, পরে একজন পুলিশ কর্মকর্তা সোহেলকে রাস্তাঘাটে চলাচলসহ আইনি ঝামেলা এড়াতে তথ্য নথিভুক্ত করার পরামর্শ দেন। সেজন্য এখন যে রোগীকে হাসপাতালে পৌঁছে দেন, ওই রোগীর নাম ও নম্বর লিখে রাখেন ডায়েরিতে।
শুধু রোগীই নয়, কারও কাছে টাকা না থাকলেও তাকে গন্তব্যে পৌঁছে দেন সোহেল। এ বিষয়ে তার গাড়ির পেছনে লেখা আছে, ‘আমার গাড়িতে রোগী ছাড়া যে ভাইয়েরা আপনার নিজ গন্তব্যে যাবেন, আপনি খুশি হয়ে কয় টাকা ভাড়া দেবেন, তাই আমি খুশি হয়ে নেব। আপনার কাছে যদি ভাড়ার টাকা না থাকে, আপনার নিজ গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়া হবে। আপনার কাছে টাকা থাকা অবস্থায় যদি না বলেন, তাহলে নিজেই নিজেকে ঠকালেন। ’
চারপাশে অটোরিকশা ছিনতাইসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড ঘটে। গভীর রাতে রোগী নিয়ে চলাচলে এ ধরনের কোনো ভয়ভীতি কাজ করে কি না জানতে চাইলে সোহেল বলেন, ‘এখন পর্যন্ত এমন কোনো ভয়ভীতি আসেনি। এটা একটা ভালো কাজ, সেজন্য ভয়ভীতির কোনো কারণ দেখি না। ’
সোহেলের পরিকল্পনা আছে, অর্থকড়ি হলে ভবিষ্যতে একটি মাইক্রো গাড়ি নেবেন, যাতে মারা যাওয়া রোগীর মরদেহ দেশের যে কোনো প্রান্তে বিনা ভাড়ায় পৌঁছে দিতে পারেন।
মধ্যবয়স পেরোনো সোহেলের আরেকটি পরিকল্পনা আছে নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য। সাইকেল, রিকশা, অটোরিকশাসহ এ জাতীয় যানবাহন যারা চালান, তাদের বাহনে কোনো ত্রুটি হলে যেন কারিগরি সহায়তা নিয়ে তারা নিজেরাই বিনা খরচে তা মেরামত করতে পারেন, সেজন্য একটি সার্ভিসিং দোকান দেবেন।
বাংলাদেশ সময়: ১৮৪৯ ঘণ্টা, জুলাই ০৪, ২০২৪
এইচএ/