কুমিল্লা: দেশব্যাপী শিক্ষার্থী হত্যা, নিপীড়ন ও হয়রানির প্রতিবাদে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুবি) শিক্ষকরা মানববন্ধনে দাঁড়ানোর জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে যেতে চাইলে সরকার দলীয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত স্থানীয় লোকজন বাধা দেন। শেষমেশ ছয়জন শিক্ষকই দাঁড়াতে পেরেছেন এই মানববন্ধনে।
বৃহস্পতিবার (১ আগস্ট) বেলা ১১ টা ৫৬ মিনিটে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের সামনে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক কাজী এম. আনিছুল ইসলামের সঞ্চালনায় এই মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়।
মানববন্ধনে উপস্থিত ছয়জন শিক্ষক হলেন- বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. কামরুন নাহার শীলা, নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. শামীমা নাসরিন, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক মাহবুবুল হক ভূঁইয়া, ফার্মাসি বিভাগের শিক্ষক জয় রাজ বংশী, বাংলা বিভাগের প্রভাষক গোলাম মাহমুদ পাভেল।
মানববন্ধনে নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. শামীমা নাসরিন বলেন, আমরা আজকে সবাই এখানে দাঁড়িয়েছি একটা বিচারহীন রাজনীতির বিরুদ্ধে কথা বলার জন্য। শুধু নিজের মৌলিক অধিকার চাইতে গিয়ে যেভাবে শতশত শিক্ষার্থী, সাধারণ জনগণ সেখানে শিশু, কিশোর, তরুণ, যুবক তাদেরকে মেরে ফেলা হয়েছে সেটা গণহত্যা। এই গণহত্যার মধ্যে দিয়ে যা করা হয়েছে সেটি একবারে নিজের যে ক্ষমতা সেটির চর্চা। সেটি কোনোভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। আমি এই নির্মম গণহত্যার বিচার চাই এবং তীব্র প্রতিবাদ করছি।
তিনি আরও বলেন, এখন আপনারা প্রশ্ন করতে পারেন আমি কার কাছে বিচার চাচ্ছি? আমি রাষ্ট্রযন্ত্রের কাছে বিচার চাই না। কারণ এই যে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে এটার সাথে রাষ্ট্র প্রত্যক্ষভাবে জড়িত আছে। আমি বিচারকের কাছেও বিচার চাইতে যাব না। আমি বিচার চাই আমার দেশের সাধারণ জনগণের কাছে, তারা দেখেছেন, দেখবেন এবং অবশ্যই তারা এর বিচার করবেন। কারণ আমরা জানি, জনগণের বাণীই ঈশ্বরের বাণী এবং আপনি যদি ক্ষমতাকে ঈশ্বর মনে করে থাকেন তাহলে সেটা হবে চরম ভুল, যা এখন হচ্ছে তা সামনেও হবে। এই অরাজকতা, এই বিচারবিহীন রাজনীতি এবং হত্যাযজ্ঞের বিপরীতে আমাদের দাঁড়াতে হবে। হয়ত আমাদের ক্ষতি হতে পারে। কিন্তু যা হওয়ার হয়ে গেছে। আমরা সকলে দাঁড়াব, একে একে দাঁড়াব, দুইয়ে দুইয়ে দাঁড়াব, দশে দশে দাঁড়াব।
বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও গত ১৮ জুলাই কোটবাড়ি বিশ্বরোডে পুলিশের গুলিতে আহত হওয়া সারাফ সামির জামান মেঘের মা ড. কামরুন নাহার শিলা বলেন, আমার সন্তানও আহত হয়েছে। আমি সেই কারণে আসিনি। শুরু থেকেই সাধারণ মানুষের ওপর যে নিপীড়ন শিক্ষার্থীদের হত্যা এই বিষয়ে সকল শিক্ষকদের মতো আমিও মর্মাহত ছিলাম। আমাদের আরো আগেই নামা উচিত ছিল। আমরা আসলে লজ্জিত। আমার নিজের জীবনে যেহেতু একটা দুর্বিপাক ঘটে গেছে, এর কারণে আমি আগে পদক্ষেপ নিতে পারিনি। আমার ছেলে আহত হয়েছে। আমার ছেলে মারাও যেতে পারতো। সেদিন বুঝতে পেরেছি এতো এতো শিক্ষার্থীদের পরিবার কী মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে আছে! আমার ছেলে ছোট। তাকে টার্গেট করে গুলি করা হয়েছে। আমরা দেখেছি নিরস্ত্র শিক্ষার্থীদের ওপর কীভাবে টার্গেট করে গুলি করা হয়েছে। এই যে একটা নৈরাজ্য অবস্থা তৈরি হয়েছে তার দ্রুত নিরসন চাই আমরা।
মানববন্ধনে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রবেশে আটকে দেওয়ার ব্যাপারে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মাহবুবুল হল ভূঁইয়া বলেন, কর্মসূচিটি বেলা ১১টায় করার কথা থাকলেও আমরা করতে পারিনি। আমাদের অনেক সহকর্মীকে আটকে দেওয়া হয়েছে কোটবাড়ি। তারা শিক্ষক পরিচয় দিয়েও তাদের কর্মস্থলে আসতে পারেননি। প্রক্টরকে জানানো হলেও আসতে দেওয়া হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা তাদের ক্যাম্পাসে আসতে পারবেন না? তারা কারা? তারা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী? বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা তাদের ক্যাম্পাসে কেন আসতে পারবেন না? আমরা কোনো ব্যবস্থার মধ্যে বাস করছি যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা তাদের ক্যাম্পাসে আসতে পারবেন না? আমি যে প্রতিষ্ঠানে কাজ করি, যে প্রতিষ্ঠানের সাথে আমার দায়িত্ব জড়িত, আমার কাজ জড়িত, আমার ইমোশন জড়িত, আমার শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা হচ্ছে। আমরা কেন আসতে পারব না?'
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, পলিটেকনিক মোড়, ক্যাডেট কলেজ মোড় ও আনসার ক্যাম্পের সামনে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা সব ধরনের যানবাহন চেক করছেন। যারাই বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিমুখে যেতে চাইছেন তাদেরকে ফিরিয়ে দেয়া হয়। এ সময় তাদের হাতে দেশীয় অস্ত্র, শটগানসহ নানা অস্ত্র দেখা যায়। ছাত্রলীগ, যুবলীগের বাধার মুখে পড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা হলেন- গণিত বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আবদুল হাকিম, অধ্যাপক খলিফা মোহাম্মদ হেলাল, আনোয়ার হোসেন, বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. জি এম মনিরুজ্জামান।
আনসার ক্যাম্পের মোড়ে সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আমিনুল ইসলাম টুটুল নেতাকর্মীদের নিয়ে অবস্থান করছেন। ক্যাডেট কলেজ মোড়ে গিয়ে দেখা যায় সদর উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান আহমেদ নিয়াজ পাবেল নেতাকর্মীদের দাঁড়িয়ে আছেন। মুঠোফোনে আহমেদ নিয়াজ পাবেল জানান, কোনো শিক্ষককে তারা ফিরিয়ে দেননি। জামায়াত-বিএনপি যেন ক্যাম্পাসে প্রবেশ করতে না পারে সে জন্য তারা মোড়ে মোড়ে অবস্থান নিয়েছেন।
এ ব্যাপারে গণিত বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আবদুল হাকিম বলেন, আমরা কোটবাড়িতে আসার পর কয়েকজন মানুষ আমাদের পথরোধ করে। আমরা শিক্ষক পরিচয় দিলেও নমনীয় হয়নি। আমাদেরকে শহরের দিকে চলে যেতে বলে। আমরা প্রক্টরকে জানিয়েছি, রেজিস্ট্রারকে জানিয়েছি। দীর্ঘ একঘণ্টা অপেক্ষা করেও কোনো পুলিশ বা কারো থেকে কোনো সাহায্য আসেনি। আমাদেরকে বাধ্য হয়ে ফিরে যেতে হয়েছে।
কুমিলা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর (ভারপ্রাপ্ত) ড. কাজী ওমর সিদ্দিকী বলেন, একজন শিক্ষক জানিয়েছিলেন যে উনি আসতে পারছিলেন না। সাথে সাথে আমি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জানিয়েছি। প্রক্টরিয়াল বডির দায়িত্ব ক্যাম্পাসের ভিতরে। বাইরে যদি কোনো ঘটনা ঘটে সেটার জন্য আমরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে অবহিত করতে হয়। সেটা আমরা করেছি।
সদর দক্ষিণ থানার অফিসার্স ইনচার্জ আলমগীর ভূঁইয়া বলেন, সরকার দলীয় লোকেরা শিক্ষকদের বিশ্ববিদ্যালয়ে আসতে বাধা দিচ্ছে - এই ব্যাপারে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর আমাকে ফোন দিয়েছিলেন। আমি একটু আগে ঘুরে আসলাম এমন কিছু লক্ষ্য করিনি।
বাংলাদেশ সময়: ১৫০১ ঘণ্টা, আগস্ট ০১, ২০২৪
এসএএএইচ