সিলেট: সিলেট-তেলিখাল-সুলতানপুর-বালাগঞ্জ উপজেলার ফতুরখাড়া সেতুর নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার কথা ২০২৫ সালের জুনে। ২০২৩ সালের মে মাসে শুরু হওয়া এ সেতুর কাজ শেষ হয়েছে মাত্র ২৫ শতাংশ।
জানা গেছে, আওয়ামী লীগের ওই নেতার দুর্নীতির কথা জেনেও তাকে ঠিকাদারির কাজ দিয়েছে সড়ক ও জনপথ (সওজ) কর্মকর্তারা। এ বিষয়ে কথা বলতে গেলে তার পক্ষেই কথা বলেছেন সংশ্লিষ্টরা।
অভিযোগ আছে, সিলেটের বালাগঞ্জ ফতুরখাড়া সেতু নির্মাণে আওয়ামী লীগ-বিএনপর যৌথ মালিকানাধীন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানে মেসার্স জনজেবি। অনিয়মে সওজ কর্মকর্তারা সঙ্গী হয়েছেন আর্থিক সুবিধা নিয়ে। দুর্নীতি মামলায় অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠান কাজ পেলেও বিষয়টি জানা নেই সওজ কর্তাদের। প্রতিষ্ঠানটিকে কাজ না দিতে সওজের অন্যান্য কর্মকর্তারা বাধা দিয়েছিলেন। কিন্তু সেটি মানা হয়নি। বরং প্রভাব খাটিয়ে কাজ বাগিয়ে নিয়েছিল ঠিকাদার লুৎফুর রহমান। সেতুর কাজে অনিয়মের পর অনিয়ম করে গেছে এই নেতার প্রতিষ্ঠানটি।
সেতুর কাজ ২৫ শতাংশ শেষ হতেই অনিয়ম: স্থানীয়দের অভিযোগ, সিলেট-৩ আসনের অন্তর্গত সিলেট বালাগঞ্জ উপজেলার আদিতপুর ইউনিয়নের ফতুরখাড়া গ্রামের নামেই ব্রিজটির নাম। স্থানীয়দের অভিযোগে সেতু নির্মাণে সিলেট-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য হাবিবুর রহমান হাবিব একটি প্রকৌশল প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে এন্ট্রিগ্রেডিং টেস্ট করানোয় অনিয়ম ধরা পড়ে।
সওজের একটি সূত্র জানিয়েছে, এন্ট্রিগ্রেডিং টেস্টের পর এক বছরের বেশি সময় নিয়ে সেতুর কাজ মাত্র ২৫ শতাংশ শেষ হয়েছে। এরই মধ্যে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান তুলে নিয়েছে সাড়ে ৫ কোটি টাকা। কাজ না করেই বাকি টাকাও তুলে নিতে পাঁয়তারা করছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি। বর্তমানে সেতুর কাজ অনিয়মের কারণে বন্ধ হয়ে আছে। ফলে উপজেলাবাসীর স্বপ্নের এই সেতুটি নিয়ে অনিয়ম করায় ক্ষোভ তৈরি হয়েছে জনমনে।
এদিকে ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার গোলাপগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি লুৎফুর রহমানের নামে হয়েছে হত্যাসহ একাধিক মামলা। যে কারণে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন এই ঠিকাদার। ফলে নতুন করে কাজ শুরু নিয়ে দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা।
ব্রিজ নির্মাণে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মহা অনিয়ম থাকলেও সেটি মানতে নারাজ সিলেট সড়ক ও জনপথের (সওজ) কর্মকর্তারা। তাদের মতে, সেতু নির্মাণে তেমন অনিয়ম হয়নি। বন্যার কারণে কাজ বন্ধ রয়েছে। অথচ সওজ সিলেটের অতিরিক্ত প্রকৌশলী ফজলে রব্বে জানিয়েছেন, অনিয়মের কারণে সেতুর কাজ বন্ধ রাখা হয়েছে। এটা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
সওজ সিলেট অফিসের সূত্রমতে, ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে বালাগঞ্জের ফতুরখাড়া পিসি গার্ডার ব্রিজ নির্মাণে দরপত্র আহ্বান করে সওজ। সিলেট সড়ক জোনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. ফজলে রব্বে দরপত্রের আহ্বায়ক। দরপত্রে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির যৌথ মালিকানাধীন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স জনজেবি কনস্ট্রাকশন সেতু নির্মাণের কাজ পায়।
দরপত্রে দেখা যায়, সিলেট-বালাগঞ্জ সড়কের ২১তম কিলোমিটারে ৭৬ দশমিক ১ মিটার দৈর্ঘ্যের ফতুরখাড়া পিসি গার্ডার ব্রিজ নির্মাণকাজ ২০২৩ সালের ২৭ মে শুরু হয়। ১৬ কোটি ৪৭ লাখ ৪০ হাজার টাকা সেতুর প্রাক্কলন ব্যয় ধরা হয়। সওজ সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী আমির হোসেন ও উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী মাহমুদুল হাসান নির্মাণ কাজের তদারকি করেন।
সূত্র জানায়, ব্রিজের পাইল ঢালাই চলা সময় নিয়ম অনুযায়ী উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী ও উপ-সহকারী প্রকৌশলী সরেজমিন উপস্থিতি বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু ৩২টি পাইল ঢালাইয়ে তারা প্রকল্পের দ্বারে কাছেও যাননি। ফলে ধরাকে সরা জ্ঞান করে দিনের কাজ রাতে করেছেন। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি অনিয়মের মাধ্যমে ১৬ কোটি টাকার কাজ আট কোটি টাকায় শেষ করতে মরিয়া হয়ে ওঠে। প্রাক্কলন ব্যয়ের অর্ধেক টাকাই পকেটস্থ করতে সচেষ্ট কর্মকর্তাদের নিয়ে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নকশা অনুযায়ী, ব্রিজের প্রতিটি পিলারে চারটি করে খাঁচা মাটির নিচে দেওয়ার কথা। সেখানে তিনটি করে খাঁচা দেওয়া হয়েছে। ব্রিজে ৪৫ মিটার করে ৩২টি পাইল করার কথা। কিন্তু অধিকাংশ পাইল ২৪ মিটার, কোনোটি ৩৬ মিটারও করা হয়েছে। আর ঢালাইয়ে পাথরের মানও নিম্নমানের ছিল।
এ অবস্থায় এলাকাবাসীর অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে সেতুর কাজের অনিয়ম দেখতে একটি বেসরকারি প্রকৌশলী সংস্থাকে দিয়ে তদন্ত করান সিলেট-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য হাবিবুর রহমান। তদন্তে অনিয়মের সত্যতাও মিলে। পরে হাবিবুর রহমান সওজ সিলেটের অতিরিক্ত প্রকৌশলী, নির্বাহী প্রকৌশলী ও ঠিকাদার মিলে ফতুরখাড়া সেতু পরিদর্শন করেন। তিনি কাজের অনিয়ম পেয়ে সাময়িক বন্ধ রাখার নির্দেশ দেন। পরবর্তীতে ঠিকাদার ও প্রকৌশলীরা মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে এমপির সঙ্গে বিষয়টির মীমাংসা করেন। তবে অনিয়মের কারণে এখনো সেতুর কাজ বন্ধ।
এদিকে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর ঠিকাদার লুৎফুর রহমান বিদেশ পাড়ি দিয়েছেন বলে জানা গেছে।
তিনি ছাত্র-জনতার আন্দোলনে হামলা ও হত্যাসহ কয়েকটি মামলায় আসামি হয়েছেন। তিনি আত্মগোপনে আছেন বলে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে।
৫ আগস্টের আগে লুৎফুর রহমানের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বাংলানিউজকে বলেন, ব্রিজের কাজে কোনো দুর্নীতি-অনিয়ম হয়নি। নকশা অনুযায়ী কাজ করেছি।
ব্রিজ নির্মাণে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের অনিয়ম মানতে নারাজ সিলেট সড়ক ও জনপথের (সওজ) কর্মকর্তারা। তাদের মতে, সেতু নির্মাণে তেমন অনিয়ম হয়নি। বন্যার কারণে কাজ বন্ধ রয়েছে। অথচ সওজ
সিলেটের অতিরিক্ত প্রকৌশলী ফজলে রব্বে জানিয়েছেন, অনিয়মের কারণে সেতুর কাজ বন্ধ রাখা হয়েছে। এটা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। কিন্তু ঠিকাদারের পক্ষে সাফাই গেয়ে সওজের নির্বাহী প্রকৌশলী আমির হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, ফতুরখাতা সেতুতে অনিয়ম হয়নি। যে প্রকৌশলী প্রতিষ্ঠান সেতুর উন্নয়ন কাজের অনিয়ম যাচাই করেছে, এ ধরনের কোনো প্রতিষ্ঠান আছে বলে আমার জানা নেই। আর যাচাই করতে হলে ব্রিজের কিছু অংশ ভেঙে পরীক্ষার করার কথা থাকলেও সেটি করা হয়নি। তারা পরীক্ষা করে কোনো ব্যবস্থা নেবেন কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এটির প্রয়োজন নেই।
তিনি বলেন, রাতে কাজ করার বিষয়ে অনেক সময় মেশিন নষ্ট হওয়ার কারণে হয়ত রাতে কাজ করতে পারে। তবে রাতে কাজ করার কোনো নিয়ম নেই।
প্রথমে অনিয়মের কারণে কাজ বন্ধ ছিল জানিয়ে তিনি বলেন, বর্তমানে বন্যার পানির কারণে কাজটি বন্ধ রয়েছে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কর্তার নামে মামলা হয়েছে। কাজ চলমান রাখার বিষয়ে বলেন, ওই প্রতিষ্ঠান করতে না পারলে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
সিলেট-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্যকে আর্থিক সুবিধা দিয়ে নিভৃত করার বিষয়ে আমির হোসেন বলেন, এটা ভিত্তিহীন। তার সঙ্গে সেতুর কাজে অনিয়ম হয়েছে কি না পরিদর্শনে গিয়েছিলাম।
বাংলাদেশ সময়: ১৫১৯ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৪, ২০২৪
এনইউ/এএটি