বান্দরবান: যোগাযোগ ব্যবস্থা আর আর্থ সামজিক অবস্থান দুটোতেই সবচেয়ে পিছিয়ে রয়েছে পার্বত্য জেলা বান্দরবানের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী খুমী সম্প্রদায়। দুর্গম এলাকার বাসিন্দা হওয়ায় এ সম্প্রদায়ের ছেলে-মেয়েরা বেশি দূর পড়ালেখার সুযোগ পায় না।
তবে ব্যতিক্রম হলেন তংসই খুমী। খুমী সম্প্রদায় থেকে প্রথমবারের মতো নারী শিক্ষার্থী হিসেবে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন তিনি।
সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে চলতি শিক্ষাবর্ষে নৃবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হওয়ায় সুযোগ পেয়েছেন তংসই।
বান্দরবানের রোয়াংছড়ি উপজেলায় তারাছা ইউনিয়নের দুর্গম মংঞো পাড়ায় তংসইয়ের বাড়ি। বান্দরবান সদর থেকে সাঙ্গু নদীর নৌপথেই সেখানে যাওয়ার একমাত্র পথ।
তংসইয়ের এই সাফল্যে খুশি পরিবার আর সহপাঠীরা। নানা বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে এই পর্যায়ে আসতে পেরেছেন তংসই খুমী। কঠোর অধ্যবসায় আর পরিবারের সহযোগিতা তাকে এতদূর এনেছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেয়ে উচ্ছ্বাসিত তংসই।
বাংলানিউজকে তংসই খুমী বলেন, বাবা মারা যাওয়ায় পর মা ঘরে তাঁত বুনে সেটা বিক্রি করে সেই টাকায় আমাদের ভাইবোনদের লেখাপড়ার খরচ জোগাড় করেছেন। অনেক কষ্ট করে তিনি আমাদের সব ভাই বোনকে মানুষ করেছেন, উচ্চশিক্ষার সুযোগ করে দিয়েছেন।
জানা গেছে, তংসই চার ভাই-বোনের মধ্যে তৃতীয়। তার বাকি দুই ভাইও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। তার বড় ভাই সুইতং খুমী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্রাফিক ডিজাইন বিষয়ে মাস্টার্স পর্বে এবং আরেক ভাই তংলু খুমী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা ও গবেষণা বিভাগের তৃতীয় বর্ষে অধ্যায়নরত। সবার ছোট বোন রেংসই খুমী ঢাকার সেন্টে জোসেফ কলেজে উচ্চমাধ্যমিক প্রথম বর্ষে অধ্যায়নরত।
তংসইয়ের বাবা নয়লো খুমীও সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রথম সরকারি চাকরিজীবী ছিলেন। তারাছা ইউনিয়নে তিনি একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক ছিলেন। ২০১৪ সালে তিনি হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।
পরিবারের নানা অভাব অনটন অতিক্রম করে তংসই বান্দরবান সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে ২০১৮ সালে মানবিক বিভাগ থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা জীবন শেষে ভর্তি হন ঢাকা হলি ক্রস কলেজে। সেখান থেকে পাসের পর শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেলেন।
তংসইয়ের এমন সাফল্যে খুশি তার পরিবার ও বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা।
তংসইয়ের মা লিংসাই খুমী বাংলানিউজকে বলেন, শিক্ষা ছাড়া কোনো গতি নাই। তাই সন্তানদের অনেক কষ্ট করে উচ্চশিক্ষার চেষ্টা করে যাচ্ছি। আমার এই প্রচেষ্টায় সকলের সহযোগিতা কামনা করছি।
তংসইয়ের ভাই সুই তং খুমী বাংলানিউজকে বলেন, আমার ছোট বোন তংসই ছোটবেলা থেকেই মেধাবী। বান্দরবান তথা বাংলাদেশে খুমী সম্প্রদায়ের মান আরো এগিয়ে নেবে সে - এই প্রত্যাশা রাখি।
তংসইয়ের এই সাফল্যে খুশি খুমী নেতৃবৃন্দরা। পার্বত্য এলাকায় বসবাসরত ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষা গ্রহণে সরকারের পক্ষ থেকে আরও সহযোগিতা কামনা করেন তারা।
খুমী সম্প্রদায়ের লেখক ও গবেষক লেলুং খুমী বাংলানিউজকে বলেন, খুমী সম্প্রদায়ের বেশির ভাগ জনগণ দুর্গম এলাকার বসবাস করেন আর তারা অত্যন্ত গরিব। খুমী সম্প্রদায় থেকে এমন সাফল্যে আমরা গর্বিত। আমরা তংসই খুমী ও তার পরিবারে সকলের উন্নতি কামনা করছি।
এদিকে তংসইকে এগিয়ে নিতে সার্বিক সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে বান্দরবান জেলা প্রশাসন।
জেলা প্রশাসক (ডিসি) শাহ্ মোজাহিদ উদ্দিন বাংলানিউজকে বলেন, খুমীসহ পার্বত্য এলাকার ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর অনেক শিক্ষার্থী এখন ভালো ফলাফল করছে আর বিভিন্নভাবে সফলতা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর খুমী নারী শিক্ষার্থীর এমন সাফল্যে তাকে শুভকামনা জানাই।
পার্বত্য এলাকার শিক্ষার্থীদের শিক্ষার উন্নয়নে সর্বোচ্চ সহযোগিতার আশ্বাস দেন ডিসি।
তথ্যমতে, পার্বত্য জেলা বান্দরবানে ১১টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বসবাস আর পার্বত্য চট্টগ্রামে সবচেয়ে কম ভাষিক ও বিপন্ন জনগোষ্ঠী হলো খুমি সম্প্রদায়। সরকারি হিসাবে ২০২২ সালের জনশুমারি ও গৃহ গণনা অনুযায়ী তাদের জনসংখ্যা ৩ হাজার ৯৯৪ জন। বান্দরবানের রোয়াংছড়ি, রুমা ও থানচি এই তিন উপজেলায় খুমীদের বসবাস।
বাংলাদেশ সময়: ২০২০ ঘণ্টা, নভেম্বর ১, ২০২৪
এসএএইচ