মাদারীপুর: প্রমত্তা পদ্মা নদী। প্রজনন মৌসুমে ডিম ছাড়তে সাগর থেকে পদ্মাসহ কয়েকটি নদ-নদীতে ছুটে আসে মা ইলিশ।
ইলিশের ডিম ছাড়া নিশ্চিত করতে প্রতিবছর আশ্বিনের শেষ দিক থেকে অমাবস্যা ও পূর্ণিমা মাঝে রেখে ইলিশের বিচরণ ক্ষেত্র হিসেবে পরিচিত নদ-নদীতে মাছ শিকারে নিষেধাজ্ঞা জারি করে সরকার।
এবার ইংরেজি মাসের হিসেবে গত ১৩ অক্টোবর থেকে ৩ নভেম্বর পর্যন্ত ইলিশ ধরা, বিক্রি, পরিবহন, সরবরাহ নিষিদ্ধ। আজ (রোববার ০৩ নভেম্বর) রাতে শেষ হচ্ছে নিষেধাজ্ঞা।
কিন্তু এ নিষেধাজ্ঞার মৌসুম এলেই মৌসুমি জেলেদের আধিপত্য বাড়ে পদ্মা নদীতে। ইলিশ ধরা নিষিদ্ধের ২২ দিনেই এ বছর পদ্মার পাড়ে অনেকটাই প্রকাশ্যে ইলিশ মাছ বিক্রি করতে দেখা গেছে।
পদ্মায় ধরা এসব ইলিশ মাছ বিক্রি করতে পদ্মার পাড়েই একাধিক পয়েন্টে বসেছিল অস্থায়ী ইলিশের হাট। সকাল-বিকেল দুই বেলা ইলিশ বেচাকেনা ঘিরে পদ্মার ওই স্থানগুলোয় ছিল উৎসবমুখর পরিবেশ। নদীর তাজা ইলিশ কিনতে দুর্গম পথ হেঁটেও অসংখ্য নারী-পুরুষকে দেখা গেছে পদ্মার পাড়ে। তবে আগামীকাল সোমবার (৪ নভেম্বর) থেকে আর ইলিশ ধরতে ও কিনতে লুকোচুরি করতে হবে না কাউকে। প্রকাশ্যেই বাজারে মিলবে ইলিশ।
ইলিশ নিষিদ্ধের ২২ দিনে মা ইলিশ রক্ষা কতটুকু সফল হয়েছে তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন পদ্মাপাড়ের সাধারণ বাসিন্দারা। অন্যদিকে প্রশাসনের দাবি, পদ্মা নদীতে কঠোর অভিযান চালানো হয়েছে। গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল ইলিশের অস্থায়ী হাটও। আবার শিবচরের পদ্মাপাড়ের সাধারণ মানুষের মতে, আগের চেয়ে এ বছর অভিযান-নজরদারি ছিল ঢিলেঢালা!
জানা গেছে, মাদারীপুর জেলার শিবচর উপজেলার বন্দরখোলা, চরজানাজাত, মাদবরেরচর এবং কাঁঠালবাড়ী ইউনিয়ন পদ্মাবেষ্টিত। এ চারটি ইউনিয়নের সঙ্গেই পদ্মা নদীর তীর রয়েছে। পদ্মা নদীর প্রায় ১২ কিলোমিটার পথ মাদারীপুর জেলার শিবচর উপজেলার আওতাভুক্ত। জেলার প্রশাসন মূলত এই ১২ কিলোমিটার এলাকাজুড়েই অভিযান চালিয়েছে নিয়মিত। অভিযানে উপজেলা মৎস্য অফিসের পাশাপাশি, জেলা মৎস্য অফিস, উপজেলা প্রশাসন, নৌপুলিশ, কোস্টগার্ড এবং সেনাবাহিনীর অংশগ্রহণ ছিল।
অন্যদিকে নিষেধাজ্ঞার শুরু থেকেই শিবচরের কাঁঠালবাড়ী, চরজানাজাত, বন্দরখোলা ইউনিয়নের পদ্মার চর এলাকায় বসে ইলিশের হাট। বিশেষ করে বন্দরখোলা ইউনিয়নের কাজিরসুরা, চরজানাজাত-কাঁঠালবাড়ী সীমান্ত এলাকার নদীরপাড়সহ কয়েকটি স্থানে দেদারসে বিক্রি হয়েছে হাজার হাজার কেজি ডিমওয়ালা ইলিশ।
ইলিশ কিনতে শিবচর ছাড়াও আশপাশের এলাকার অসংখ্য মানুষের ভিড় থাকতো পদ্মার পাড়ে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ক্রেতার সঙ্গে তখন কথা হলে তারা জানান, এ বছর মাছ কিনে বাড়ি ফিরতে তেমন কোনো সমস্যা হয়নি। বিগত বছরে চর এলাকার প্রবেশ পথেও বেশির ভাগ সময় পুলিশের টহল ছিল। চেকপোস্ট ছিল। এ বছর নির্বিঘ্নে মাছ কিনে আনতে পেরেছে সাধারণ মানুষ।
তারা আরও জানিয়েছেন, একেকজন ক্রেতা সর্বনিম্ন ১০ কেজি করে মাছ কিনতো। কেউ ২০/৩০ কেজি করেও কিনে আনতো। মূলত, বাড়ি ফিরে অনেকেই এই মাছ ভাগ করে নিতো। এছাড়া শিবচরের বিভিন্ন এলাকার মাছ বিক্রেতারাও মাছ কিনে এনে নিজ এলাকায় বিক্রি করেছে।
সাধারণত বাজারদরের তুলনায় একটু কম দামেই মিলতো ইলিশ। নদী থেকে সদ্য ধরে আনার কারণেই ইলিশের চাহিদা ছিল বেশি।
শিবচর উপজেলা মৎস্য অফিস সূত্রে জানা গেছে, গত ১৩ অক্টোবর হতে ২ নভেম্বর পর্যন্ত শিবচরের পদ্মায় ৭৮টি অভিযান হয়েছে। আটক হয়েছে ৬৮ জন জেলে। ৩৩টি ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে ১ লাখ ৯০ হাজার টাকা জরিমানা আদায় এবং ২৮ জন জেলেকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। ধ্বংস করা হয় ২ কোটি ৭৫ লাখ ২০ হাজার টাকা মূল্যের ১৩ লাখ ৭৬ হাজার মিটার নিষিদ্ধ কারেন্ট জাল। উদ্ধার করা হয় ৬৬৮ কেজি ইলিশ।
জানতে চাইলে শিবচরের চরজানাজাত নৌপুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ (পরিদর্শক) মো. হাবিবুল্লাহ জানান, শিবচরের পদ্মা নদীতে নৌপুলিশ সার্বক্ষণিক টহলে ছিল। মা ইলিশ রক্ষায় জেলেদের আটক, বিপুল পরিমাণ জাল জব্দ করেছে নৌপুলিশ।
শিবচর উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা ফেরদৌস ইবনে রহিম জানান, আমরা ২২ দিনই সক্রিয় ছিলাম শিবচরের পদ্মা নদীতে। একাধিক টিম নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করেছে। এছাড়াও সেনাবাহিনীর সহায়তা নিয়ে পদ্মা পাড়ের অস্থায়ী ইলিশের হাট গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
এদিকে শেষ দিকে এসে গত দুইদিনে অভিযান পরিচালনাকারীদের ওপর হামলাও চালিয়েছে জেলেরা। এরপরও আমরা মা ইলিশ রক্ষায় সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি। এছাড়াও অভিযানের সময় উদ্ধারকৃত জেলেদের জালে ধরা পড়া ইলিশ পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে অধিকাংশ ইলিশই ইতোমধ্যে ডিম ছাড়তে পেরেছে।
বাংলাদেশ সময়: ২০৪৪ ঘণ্টা, নভেম্বর ০৩, ২০২৪
এসআই/আরএ