ঢাকা, শুক্রবার, ১২ পৌষ ১৪৩১, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

জাতীয়

ঘোষণা দিয়ে নৈরাজ্য, সরকারের কঠোর হুঁশিয়ারি

নিউজ ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০০২ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৬, ২০২৪
ঘোষণা দিয়ে নৈরাজ্য, সরকারের কঠোর হুঁশিয়ারি ছবি: শাকিল আহমেদ

ঢাকা: রোববারের (২৪ নভেম্বর) হামলার জের ধরে ঘোষণা দিয়ে ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজে সোমবার (২৫ নভেম্বর) ব্যাপক হামলা, ভাঙচুর ও তাণ্ডব চালিয়েছেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং কবি নজরুল সরকারি কলেজের শিক্ষার্থীরা। এ সময় তিন কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষ ও ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয়।

এতে রাজধানীর ডেমরা-যাত্রাবাড়ী এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। হামলায় শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও কবি নজরুল কলেজের সঙ্গে যোগ দেন সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা। আর মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগ দেন স্থানীয় লোকজন।  

প্রায় দুই ঘণ্টার সংঘর্ষে শতাধিক ব্যক্তি আহত হয়েছেন বলে জানা গেছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সেনাবাহিনী, র‌্যাব, এপিবিএন, বিজিবি ও পুলিশের কয়েকশ’ সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। সোমবার দুপুর সাড়ে ১২টায় এ সংঘর্ষ শুরু হয়। বিকেল ৩টায় মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের ভেতরে সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ ও কবি নজরুল সরকারি কলেজের বেশ কিছু শিক্ষার্থী আটকা পড়েন বলে জানা যায়। তাদের উদ্ধারে যৌথ বাহিনী মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের ভেতরে প্রবেশ করতে চাইলে কলেজটির শিক্ষার্থীদের বাধার মুখে পড়ে তারা।  

সোমবার বিকেলে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজ কর্তৃপক্ষ জানায়, তথাকথিত সাত কলেজ শিক্ষার্থীদের ব্যানারে বহিরাগত একদল সন্ত্রাসী তাদের কলেজে প্রবেশ করে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। এ হামলায় শতাধিক শিক্ষার্থী ও শিক্ষক আহত হয়েছেন। এ হামলায় কিছু ছাত্র নামধারী ব্যক্তি নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের মদতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অস্থিতিশীল করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল। হামলাকারীদের অধিকাংশই শিক্ষার্থী নয়, বরং সন্ত্রাসী কার্যক্রমে লিপ্ত। শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষের জেরে সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজে দুদিন ক্লাস বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন কলেজটির অধ্যক্ষ ড. কাকলী মুখোপাধ্যায়। একইসঙ্গে কবি নজরুল সরকারি কলেজও মঙ্গলবার (২৬ নভেম্বর) শ্রেণি কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করে ওয়েবসাইটে নোটিশ দিয়েছে।

এদিকে সংঘর্ষে না জড়িয়ে শিক্ষার্থীদের শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়েছে সরকার। এসব সংঘাতের পেছনে কোনো ধরনের ইন্ধন থাকলে তা কঠোর হাতে দমন করা হবে বলেও জানানো হয়।  

প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, সম্প্রতি বেশ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যে সংঘাত-সংঘর্ষ হয়েছে, সরকার নজর রাখছে। আমরা ছাত্র-ছাত্রীদের কোনো ধরনের সংঘর্ষে না জড়িয়ে শান্ত থাকার আহ্বান জানাচ্ছি।

ডিএমপি বলছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দুজন নিহতের যে খবর ছড়িয়ে পড়ে তা সঠিক নয়। তবে সংঘর্ষে ২৫ জন শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন।

এ সংঘর্ষের সূত্রপাত ঘটে ঢাকা ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। অভিযোগ ওঠে, ওই হাসপাতালের চিকিৎসকের গাফিলতির কারণে গত ১৮ নভেম্বর ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের শিক্ষার্থী অভিজিতের মৃত্যু হয়। তার মৃত্যুর বিচার দাবি করে রোববার দুপুর থেকেই বিভিন্ন কলেজের শিক্ষার্থীরা ন্যাশনাল মেডিকেল ঘেরাও করেন। এক পর্যায়ে এ বিক্ষোভ সংঘর্ষে রূপ নেয়। হাসপাতালটি ছাড়াও শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও কবি নজরুল কলেজেও ব্যাপক ভাঙচুর চালানো হয়। কলেজ ক্যাম্পাসে হামলা ও ভাঙচুরের প্রতিবাদে সোমবার ‘মেগা মানডে’ কর্মসূচি পালন করার ঘোষণা দেন কবি নজরুল কলেজ এবং সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজের শিক্ষার্থীরা।  

সরেজমিনে দেখা যায়, এ কর্মসূচি বাস্তবায়নে সোমবার সকাল ১০টা থেকে ধীরে ধীরে কবি নজরুল সরকারি কলেজের মূল ফটকের সামনে জড়ো হতে থাকেন শিক্ষার্থীরা। লাঠিসোঁটা হাতে সোহরাওয়ার্দী কলেজের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থীরাও খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে এখানে জড়ো হন। এ সময় তারা ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজসহ যেসব কলেজ রোববারের হামলায় জড়িত ছিল তাদের বিচারের দাবিতে স্লোগান দেন।  

কবি নজরুল কলেজের অধ্যক্ষ ড. মো. হাবিবুর রহমান আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের শান্ত করার জন্য মাইকিং করে বলেন, তোমরা শান্ত হও, তোমাদের সঙ্গে আমরা আছি। রোববারের ঘটনায় অনুপ্রবেশকারীরা ছিল। তাদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনা হবে। তার এ আহ্বানে দুই কলেজের শিক্ষার্থীরা ‘ভুয়া, ভুয়া’ স্লোগান দিতে থাকেন।

কবি নজরুল কলেজের শিক্ষার্থী রিয়াদ বলেন, রোববার সুপার সানডে ঘোষণা দিয়ে ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের শিক্ষার্থীরা আমাদের কলেজ ও সোহরাওয়ার্দী কলেজে হামলা চালিয়েছে। তারই প্রতিবাদে সোমবার আমরা মেগা মানডে কর্মসূচি পালন করার ঘোষণা দিয়েছি। বেলা সাড়ে ১১টায় বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা রায়সাহেব বাজারের দিকে অগ্রসর হয়ে সাত কলেজের অন্যান্য শিক্ষার্থীর সঙ্গে জড়ো হতে থাকেন। দুপুর সাড়ে ১২টায় যাত্রাবাড়ীর মাতুয়াইলে মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজে গিয়ে হামলা শুরু করেন সোহরাওয়ার্দী ও কবি নজরুল কলেজের শত শত শিক্ষার্থী। সেখানে মোল্লা কলেজের শিক্ষার্থী ও স্থানীয়দের সঙ্গে সোহরাওয়ার্দী ও নজরুল কলেজের শিক্ষার্থীদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও সংঘর্ষ চলে। মুহূর্তেই যাত্রাবাড়ী-ডেমরা সড়ক রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। সংঘর্ষে আহত হন প্রায় অর্ধশতাধিক। পরে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা মোল্লা কলেজে অনেকটা নির্বিঘ্নে ভাঙচুর চালাতে থাকে।  

ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, শুরুতে হামলাকারী শিক্ষার্থীরা কোনো প্রতিরোধের মুখে পড়েননি। দুপুর ১টার কিছু আগে তাদের ধাওয়া দেন মোল্লা কলেজের শিক্ষার্থী ও স্থানীয় বাসিন্দারা। এরপরই ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া শুরু হয়। সংঘর্ষে ওই সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। আশপাশের সড়কে দেখা দেয় তীব্র যানজট। সংঘর্ষ চলাকালে বিভিন্ন সড়কে শিক্ষার্থীদের লাঠিসোঁটা হাতে দৌড়াদৌড়ি করতে দেখা যায়। ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার কারণে এলাকাজুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় পুলিশ উপস্থিত থাকলেও তাদের ভূমিকা ছিল নীরব। দুপুর আড়াইটার দিকে কলেজটির সামনে সেখানকার শিক্ষার্থী ও এলাকাবাসী অবস্থান নেন। শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও কবি নজরুল কলেজের শিক্ষার্থীদের তখন ওই এলাকায় আর দেখা যায়নি। হামলার পর মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজে গিয়ে ব্যাপক ভাঙচুরের চিত্র দেখা গেছে। কলেজটির ১০ তলা ভবনের সব তলায় ভাঙচুর চালানো হয়েছে। লুটপাট করা হয়েছে কম্পিউটারসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম ও আসবাব।  

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ওয়ারী বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মো. ছালেহ উদ্দিন বলেন, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে বিপুলসংখ্যক পুলিশ সদস্য মোতায়েন করা হয়। পাশাপাশি সেনাবাহিনীর সদস্যরাও কাজ করেন।  

তিনি বলেন, সকাল থেকে আমরা যাত্রাবাড়ী মোড়ে প্রস্তুত ছিলাম, যাতে মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজ আক্রান্ত না হয়। আমরা যাত্রাবাড়ী মোড়ে পর্যাপ্ত সংখ্যক পুলিশ এপিসিসহ প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলাম। হাজার হাজার ছাত্র আমাদের ব্যারিকেড ভেঙে মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজে এসে ভাঙচুর করেছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে ডেমরা এলাকায় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) মোতায়েন করা হয়।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ মোহাম্মদ ফারুক জানান, বিকেল সোয়া ৪টা পর্যন্ত হাসপাতালের জরুরি বিভাগে ৩০ জনকে আহত অবস্থায় আনা হয়। এদের মধ্যে সোহরাওয়ার্দী কলেজের উচ্চ মাধ্যমিক প্রথম বর্ষের রাজীব (১৯) ও দ্বিতীয় বর্ষের শাহেদুল (২০), কবি নজরুল সরকারি কলেজের উচ্চ মাধ্যমিক প্রথম বর্ষের রানা (২০), মারুফ (১৯), রুমান (১৯), হাসিনুর (১৯), আরাফাত (১৯), একই কলেজের স্নাতক প্রথম বর্ষের অনুপম দাস (২৩) ও দ্বিতীয় বর্ষের সুমন (২২) এবং ইম্পেরিয়াল কলেজ হাতিরঝিল শাখার উচ্চ মাধ্যমিক প্রথম বর্ষের হুমায়ুন (২০)। সংঘর্ষে আহত হয়ে ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে সোহরাওয়ার্দী ও নজরুল কলেজের অন্তত ৩০ শিক্ষার্থী। তারা হলেন- নাইম (২০), সিয়াম (১৯), মোল্লা সোহাগ (১৮), রাজিম (১৭), শরিফুল (১৭), জাহিদ (২৫), মোস্তফা (২৩), রাতুল (২১), শফিকুল ইসলাম (২৬), মেহেদী হাসান (২৪), সজীব বেপারী (২৮), ফয়সাল (১৯), সাগর (২১), ইমনসহ (২৪), সিয়াম (১৮)।  

হাসপাতালটির চিকিৎসক ডা. মাহমুদ বলেন, আহতদের মধ্যে ১০ জনের অবস্থা গুরুতর।  

ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আশরাফ সামীর বলেন, আমাদের এক থেকে ১২ তলা পর্যন্ত সব ধ্বংস করে দিয়েছে, আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। আমাদের কোটি টাকার ওপরে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এমন হামলার আশঙ্কায় রোববার রাত থেকে আমাদের চেয়ারম্যান প্রশাসনের কাছে সহযোগিতা চেয়েছে, প্রশাসন সহযোগিতা করলে আজ এমন হতো না। হামলায় তার কলেজেরই শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন বলে তিনি দাবি করেন।  

সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের এমডি হামলায় প্রকৃত দোষীদের দ্রুত শনাক্ত ও গ্রেপ্তার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি, কলেজে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার, লুট করা সম্পদ উদ্ধার ও ক্ষতিগ্রস্ত নথি পুনরুদ্ধারের দাবি জানিয়েছেন।

বাংলাদেশ সময়: ০৯৫৮ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৬, ২০২৪
আরবি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।