ঢাকা: জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানকে সফল করতে সবাইকে সজাগ ও ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। বিগত বছরগুলোতে পাচার হওয়া হাজার হাজার কোটি টাকা নিয়ে পরাজিত শক্তি সক্রিয় বলেও জানান তিনি।
মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে সোমবার (ডিসেম্বর ১৬) সকালে জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণে তিনি এ আহ্বান জানান।
অধ্যাপক ইউনূস বলেন, এ বছরের বিজয় দিবস বিশেষ কারণে মহা আনন্দের দিন। মাত্র চার মাস আগে একটি অসম্ভব সম্ভব হয়ে গেল, দেশের সবাই মিলে একজোটে হুংকার দিয়ে উঠলো, পৃথিবীর ঘৃণ্যতম স্বৈরাচারী শাসককে পালিয়ে যেতে বাধ্য করে আমাদের প্রিয় দেশকে মুক্ত করেছে ছাত্র-জনতার সম্মিলিত অভ্যুত্থান। যে হাজার হাজার শহীদ এবং আহতদের আত্মত্যাগ এবং ছাত্র-জনতার অটুট ঐক্যের মাধ্যমে এই গণ-অভ্যুত্থান সম্ভব হলো তাদের সবাইকে স্মরণ করি এবং আজ এবারের মহা বিজয়ের দিনে সমগ্র জাতির পক্ষ থেকে তাদের প্রতি সশ্রদ্ধ সালাম জানাই।
তিনি বলেন, নাগরিক অধিকার ও মর্যাদা নিশ্চিতের জন্য, গণতন্ত্রের জন্য, একটি বৈষম্যহীন দেশ গড়ার তাগিদে ছাত্র জনতা স্বৈরাচারের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে রক্ত দিয়ে চার মাস আগে নতুন বাংলাদেশ গড়ার জন্য যে ঐক্য গড়ে তুলেছিল, সে ঐক্য এখনো পাথরের মতো মজবুত আছে। মাত্র কয়েক দিন আগে জাতি আবার গর্জে উঠে সমগ্র পৃথিবীকে সেকথা জানিয়ে দিয়েছে।
গোটা জাতি ঐক্যবদ্ধ জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, যখন পরাজিত শক্তি নড়েচড়ে ওঠার চেষ্টা করছিল, সকল রাজনৈতিক দলের এবং সকল ধর্মের শীর্ষ ব্যক্তিদের এবং ছাত্রদের সমাবেশের মাধ্যমে এক কণ্ঠে সজোরে ঘোষণা দিয়েছিল আমরা যে নিরেট ঐক্যের মাধ্যমে অভ্যুত্থান করেছি সেই ঐক্য আরও জোরদার হয়েছে। চার মাসের ব্যবধানে আমাদের ঐক্য কোথাও শিথিল হয়নি। নতুন বাংলাদেশ গড়ার সংকল্পে আমরা অটুট আছি।
বহির্বিশ্বে চাতুর্যপূর্ণ প্রচারণা দিয়ে যারা আমাদের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টির চেষ্টা করছে, তারা দূরত্ব সৃষ্টি তো করতে পারেইনি, বরং সারা জাতিকে সগৌরবে উচ্চকণ্ঠে তার ঐক্যকে পৃথিবীর সামনে তুলে ধরতে উজ্জীবিত করেছে।
অধ্যাপক ইউনূস বলেন, পরাজিত শক্তি তাদের পরাজয় কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না। তারা প্রতিদিন দেশের ভেতরে এবং বাইরে থেকে জনতার অভ্যুত্থানকে ব্যর্থ করার জন্য বিপুল অর্থব্যয়ে নানা ভঙ্গিতে তাদের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। পাচার করা হাজার হাজার কোটি টাকা তাদের আয়ত্তে রয়েছে। তাদের সুবিধাভোগীরা সর্বত্র ছড়িয়ে আছে। আমাদের ঐক্য অটুট থাকলে তারা আমাদেরকে আমাদের লক্ষ্য অর্জন থেকে ব্যর্থ করতে পারবে না। সজাগ থাকুন। নিজের লক্ষ্যকে জাতির লক্ষ্যের সঙ্গে একীভূত করুন। পৃথিবীর কোনো শক্তিই আমাদেরকে আমাদের লক্ষ্য অর্জন থেকে বিচ্যুত করতে পারবে না।
গণমাধ্যমকর্মীদের সঠিত তথ্য তুলে ধরার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, দেশের গণমাধ্যমকর্মী ও জনগণের প্রতি আহ্বান জানাই, বিশ্বের কাছে দেশের প্রকৃত চিত্র তুলে ধরুন। অপপ্রচারের বিরুদ্ধে সত্যই হোক আমাদের হাতিয়ার।
ড. ইউনূস বলেন, জাতির এই নিরেট ঐক্য এই বছরের বিজয় দিবসকে স্মরণীয় করে রাখবে। ইতিহাসের অনন্য স্থানে প্রতিষ্ঠিত করে রাখবে। এই ঐতিহাসিক অর্জনের জন্য দলমত নির্বিশেষে দেশের সকল তরুণ-তরুণী, যুবক-যুবতী, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা সবাইকে আমার অভিনন্দন জানাচ্ছি। এই ঐক্যের জোরে আমরা আমাদের সকল সমস্যার দ্রুত সমাধান নিশ্চিত করতে পারবো।
আন্তর্জাতিক বিশ্বে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি সমর্থনের কথা তুলে ধরে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, এই বিজয় মাসে আমাদের গণঅভ্যুত্থানকে অভিনন্দন জানাবার জন্য, আমাদের বিজয় দিবসে যোগ দেবার জন্য ঢাকায় এসেছেন পূর্ব তিমুরের রাষ্ট্রপতি নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী প্রেসিডেন্ট হোসে রামোস হোর্তা। তিনি তার দেশের মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছেন। আমাদের দেশের মুক্তিযুদ্ধ তাঁকে অনুপ্রাণিত করেছিল। ২০০২ সালে পূর্ব তিমুর স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। আমাদের জাতীয় উৎসবে শরিক হবার জন্য জাতির পক্ষ থেকে তাঁকে স্বাগত জানাচ্ছি।
তিনি বলেন, কয়েকদিন আগে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ১৯ জন রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে আমার বৈঠক হয়েছে। এই প্রথমবারের মতো ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের প্রায় সকল দেশের রাষ্ট্রদূতগণ একসঙ্গে ঢাকায় এসে সরকারের সঙ্গে বৈঠক করলেন। এই দেশগুলোর বেশিরভাগ দূতাবাস দিল্লিতে। তারা অনেকেই আগে কোনোদিন ঢাকায় আসেননি। এটি একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। একত্রে ঢাকায় আসলেন শুধু এই বার্তা দেবার জন্য যে ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাংলাদেশকে সর্বোচ্চ সমর্থন ও সহযোগিতা দেবার জন্য প্রস্তুত।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সংস্কার উদ্যোগ এবং গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচনের প্রক্রিয়ার কথা আমি তাদেরকে জানিয়েছি। সেটিতে তারা পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছেন এবং সরকারকে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করবেন বলে জানিয়েছেন। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অপপ্রচার এবং ভুল তথ্য প্রচারের বিষয়েও আমি ইউরোপীয় ইউনিয়নের কূটনীতিকদের জানিয়েছি। ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যে যাদের ভিসা অফিস নয়াদিল্লিতে আছে, তাদেরকে ঢাকা বা অন্য কোনো প্রতিবেশী দেশে ভিসা অফিস নিয়ে আসার জন্য আমি অনুরোধ করেছি। আমি বলেছি, ইউরোপীয় দেশগুলোর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য অনেক বাংলাদেশি শিক্ষার্থীর ভিসা পেতে সমস্যা হয়। তারা যদি ভিসা সেন্টার ঢাকায় নিয়ে আসেন তাহলে আমাদের ছেলেমেয়েদের ভোগান্তি কমে যাবে।
তিনি বলেন, এছাড়া অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে তাদের সহযোগিতার মাত্রা বাড়ানোর বিষয়ে আমি আলাপ করেছি। বিশ্ব ব্যাংকসহ অন্যান্য সকল দাতা প্রতিষ্ঠানসমূহের কাছে আমাদের অর্থনীতির ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে আস্থা প্রতিষ্ঠিত করতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সক্ষম হয়েছে। তারা নতুন উদ্যোগে এবং নতুন উৎসাহে আমাদের সঙ্গে নতুন আর্থিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে এগিয়ে এসছে। অর্থনীতির সাফল্যের ব্যাপারে দেশে এবং বিদেশে আস্থা সৃষ্টি হয়েছে।
সবাইকে মহান বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, এটা আমাদের বিজয়ের মাস। ১৬ ডিসেম্বরে যুদ্ধ জয় করে পৃথিবীর বুকে বাঙালি জাতির একটা স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাস। শত্রুকে চূড়ান্তভাবে পরাজিত করার মাস। নিজের শক্তিকে আবিষ্কার করার মাস।
এই বিজয়ের মাসে আমরা সকল প্রস্তুতি নিয়ে দৃঢ় পদক্ষেপে নতুন বাংলাদেশ গড়ার যাত্রা শুরু করলাম। এই যাত্রা শুভ হোক। গন্তব্যে পৌঁছানো নিশ্চিত ও আনন্দদায়ক হোক।
তিনি বলেন, বিজয়ের মাস হোক নারী-পুরুষ, ধর্ম, বর্ণ রাজনৈতিক পরিচয় নির্বিশেষে জাতির মহা ঐক্যের মাস। বিজয়ের মাস হোক ছাত্র জনতার অভ্যুত্থানকে স্মরণ করে নতুন বাংলাদেশ গড়ার শপথ দৃঢ়তার সঙ্গে পুনর্ব্যক্ত করার মাস। বিজয়ের মাস হোক নতুন বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে তরুণদের প্রচণ্ড দুঃসাহস প্রকাশের মাস।
অধ্যাপক ইউনূস বলেন, বিজয়ের মাস হোক নাগরিকদের পরস্পরের মধ্যকার সম্পর্ক স্থায়ীভাবে ভয়বিহীন থাকবে এমন এক সমাজ গড়ার মাস— সংখ্যালঘুদেরকে সংখ্যাগরিষ্ঠদের ভয়ে ভীত হতে হবে না, নারীকে পুরুষের ভয়ে ভীত হতে হবে না, বিত্তহীনকে বিত্তবানদের ভয়ে ভীত হতে হবে না, নিজের মতপ্রকাশে কারো ভয়ে ভীত হতে হবে না। বিজয়ের মাস হোক অসম্ভবকে সম্ভব করার প্রতিজ্ঞা নেবার মাস।
বাংলাদেশ সময়: ১১৩৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৬, ২০২৪
এমইউএম/এমএম