ঢাকা, শুক্রবার, ১২ পৌষ ১৪৩১, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

জাতীয়

বিদায়ী বছরে বিশ্বব্যাপী আলোচিত না.গঞ্জের সাত খুন

ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯২৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩১, ২০১৪
বিদায়ী বছরে বিশ্বব্যাপী আলোচিত না.গঞ্জের সাত খুন

নারায়ণগঞ্জ : বিদায়ী বছরে দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিদেশের গণমাধ্যমেও আলোচিত ছিল নারায়ণগঞ্জের ৭ খুন। গত ৮ মাস ধরে ৭ খুনের খবর গুরুত্ব পেয়েছে গণমাধ্যমে।

নৃশংস সেই হত্যাকান্ড নাড়া দিয়েছে দেশবাসীর বিবেককে। ৭ খুনের পর বিদায়ী বছর জুড়েই প্রাচ্যের ডান্ডিখ্যাত বাণিজ্যনগরী নারায়নগঞ্জ দেশবাসীর কাছে পরিচিত ছিল গুম খুন আর আতঙ্কের নগরী হিসেবে।

গত ২৭ এপ্রিল দুপুর ২ টার দিকে ঢাকা-নারায়নগঞ্জ লিংক রোডের ফতুল্লার লামাপাড়া এলাকা থেকে নাসিকের প্যানেল মেয়র নজরুল, তার বন্ধু মনিরুজ্জামান স্বপন, তাজুল ইসলাম, লিটন, গাড়িচালক জাহাঙ্গীর আলম, আইনজীবী চন্দন কুমার সরকার ও তার গাড়িচালক ইব্রাহীম অপহৃত হন। ওইদিন থেকেই উত্তাল হয়ে উঠে নারায়ণগঞ্জ। অপহৃতদের মুক্তির দাবিতে দফায় দফায় চলে ঢাকা-চট্টগ্রাম ও ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক এবং ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোড অবরোধ।

পরে শীতলক্ষ্যা নদী থেকে ৩০ এপ্রিল ৬ জনের ও ১ মে একজনের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। মদনগঞ্জের শান্তিনগর ও চর ধলেশ্বরী এলাকায় শীতলক্ষ্যা নদীর পূর্বপাড়ে অভিনব কায়দায় বস্তাবন্দি ইটের সঙ্গে রশি দিয়ে বেধে লাশগুলো ডুবিয়ে রাখা হয়েছিল।

লাশ উদ্ধারের পর ১ মে শিমরাইল মোড়ে নিহত প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম ও তার সহযোগী তাজুল ইসলামের নামাজে জানাজা শেষে বিক্ষুব্ধ জনতা অগ্নিসংযোগ করে সিদ্ধিরগঞ্জের ভিন্ন এক সাম্রাজ্যের রাজা কাউন্সিলর নূর হোসেনের আস্তানা খ্যাত শিমরাইল ট্রাক টার্মিনালের অফিসে। গুড়িয়ে দেয় নূর হোসেনের অশ্লীলতার যাত্রা মঞ্চ ও জুয়ার আসর। ৩ মে নূর হোসেনের বাড়িতে অভিযান চালিয়ে রক্তমাখা হাইএইস গাড়ি জব্দ করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

৭ খুনের পরে নারায়ণগঞ্জে প্রশাসনে গণবদলির হিড়িক পড়ে। একযোগে বদলি করা হয় জেলা প্রশাসক মনোজ কান্তি বড়াল, পুলিশ সুপার সৈয়দ নুরুল ইসলাম, ফতুল্লা মডেল থানার ওসি, সিদ্ধিরগঞ্জ থানার ওসি, জেলা গোয়েন্দা পুলিশের ওসিসহ ৮৪ জন পুলিশ কর্মকর্তাকে। চাকরিচ্যুত করা হয় র‌্যাব-১১ এর অধিনায়ক লে. কর্ণেল তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, উপ অধিনায়ক মেজর আরিফ হোসেন, ক্রাইম প্রিভেনশন স্পেশাল কোম্পানির ইনচার্জ লে. কমান্ডার এম এম রানাকে।

উদ্ধারকৃত লাশগুলোর সঙ্গে র‌্যাব-১১ তে ব্যবহৃত বস্তা, রশি ও ইটের সঙ্গে সাদৃশ্য থাকা এবং ৪ মে র‌্যাব-১১ এর ৩ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নূর হোসেনের নিকট থেকে ৬ কোটি টাকার বিনিময়ে হত্যার অভিযোগ ওঠার পর ৭ হত্যাকাণ্ড আলোড়ন তুলেছিল দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিদেশেও। এছাড়া অপহরণের থেকে শুরু করে হত্যাকাণ্ড ও লাশ ডুবিয়ে রাখার ঘটনায় এলিট ফোর্স র‌্যাব-১১ এর তিন চাকরিচ্যুত কর্মকর্তা ও সদস্যদের সম্পৃক্ততা থাকায় বিশ্বের প্রভাবশালী মিডিয়ার দৃষ্টিও ছিল নারায়ণগঞ্জের প্রতি।

পরে ৬ মে নারায়ণগঞ্জ জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট সাখাওয়াত হোসেন খান, আমরা নারায়ণগঞ্জবাসী সংগঠনের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শ্রমিক নেতা অ্যাডভোকেট মাহবুবুর রহমান ইসমাইল ও অ্যাডভোকেট চন্দন কুমার সরকারের মেয়ে জামাতা ডা. বিজয় কুমার পাল র‌্যাব কর্মকর্তাদের গ্রেফতারে হাইকোর্টে রিট দায়ের করলে হাইকোর্ট তাদেরকে নির্দেশ দেয়। ওই নির্দেশের পর সেনাবাহিনী ও নৌবাহিনী থেকে অবসরে পাঠানো হয় তারেক, আরিফ ও রানাকে।

লাশ উদ্ধারের পর থেকে নানা নাটকীয়তা অন্য কোন হত্যাকাণ্ডের বেলাতে ছিলনা। উচ্চ আদালতের নির্দেশের পর র‌্যাবের তিন কর্মকর্তা গ্রেফতারের প্রতিটি মুহূর্তেই ছিল নাটকীয়তা ভরপুর। ওই সময় সারা বিশ্বের দৃষ্টি ছিল নারায়ণগঞ্জের প্রতি। ১৭ মে ভোরবেলায় প্রথমে তারেক সাঈদ ও আরিফকে গ্রেফতার করে মামলার তদন্তকারী সংস্থা ডিবি পুলিশ। পরদিন গ্রেফতার করা হয় রানাকে। তাদেরকে ৪র্থ দফা রিমান্ডের পরে তারা স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেয়। তাদের স্বীকারোক্তির পর বেরিয়ে আসতে শুরু করে থলের বেড়াল।

৭ খুনের সঙ্গে র‌্যাব-১১ এর চাকুরীচ্যুত ৩ কর্মকর্তাসহ ২৭ জন ছাড়াও নূর হোসেন ও তার বাহিনীর জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠে র‌্যাবের কর্ণেল জিয়া, তারেক সাঈদের শ্বশুর ত্রাণ মন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া ও তার পুত্রের বিরুদ্ধেও।

৭ খুনের পরে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী ও সংসদ সদস্য শামীম ওসমানের বিরোধ আরো তুঙ্গে ওঠে। ৭১ চ্যানেলের একটি লাইভ অনুষ্ঠানে তাদের উত্তপ্ত বাকযুদ্ধে দেশব্যপী সমালোচনার ঝড় ওঠে।

৭ খুনের খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে অনেক বেগ পেতে হয়েছে মিডিয়া কর্মীদের। অনেককে নির্ঘুম রাত কাটাতে হয়েছে। নারায়ণগঞ্জের যে সকল মিডিয়া কর্মী আয়েশী জীবনযাপন করতেন তাদেরকেও দেখা গেছে চাকরি বাঁচাতে সার্বক্ষণিক সংবাদের পেছনে ছুটতে। শুরু থেকে অদ্যবধি ৭ খুনের মামলা সংশ্লিষ্ট প্রতিটি খবরই মিডিয়ায় গুরুত্ব সহকারেই প্রকাশিত হয়েছে।

৭ খুনের দু’টি মামলায় এ পর্যন্ত র‌্যাবের ১৭ জন সদস্যসহ মোট ৩০ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। অপহরণ ও হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা দিয়ে চাকরিচ্যুত তিন র‌্যাব কর্মকর্তাসহ ১৯ জন আদালতে দোষ স্বীকার করে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন। এছাড়াও ঘটনার সাক্ষী হিসেবে ইতিমধ্যে ১৭ জন আদালতে সাক্ষী জবানবন্দি দিয়েছেন।

এছাড়া সরকারের নির্দেশে গঠিত জনপ্রশাসন মন্ত্রনালয়ের উচ্চ পর্যায়ের একটি তদন্ত কমিটিও তদন্ত শুরু করে। তারা সংসদ সদস্য শামীম ওসমান, মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী, প্রাক্তন জেলা প্রশাসক মনোজ কান্তি বড়াল, প্রাক্তন পুলিশ সুপার সৈয়দ নুরুল ইসলামসহ তিন শতাধিক ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে।

মামলার তদন্তকারী সংস্থা জেলা গোয়েন্দা পুলিশ ও জনপ্রশাসন মন্ত্রনালয়ের তদন্ত কমিটি ছাড়াও র‌্যাবের একটি তদন্ত দলও তদন্ত শেষে হাইকোর্টে তাদের তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে।

৭ খুনের মামলার প্রধান আসামি নূর হোসেন ভারতে গ্রেফতারের পরে তাকে দেশে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। তবে ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছে মামলার এজাহার নামীয় আসামী সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের বহিষ্কৃত সাধারণ সম্পাদক হাজী ইয়াসিনসহ ৫ জন ও নূর হোসেনের ঘনিষ্ট সহযোগীরা। যাদের কাছে রয়েছে নূর হোসেনের অবৈধ অস্ত্র ও সম্পদের বিবরণী। এখনো অরক্ষিত নূর হোসেনের বিশাল সম্পদের পাহাড়। নূর হোসেনের অবৈধ সম্পদের বিষয়ে কোন ধরনের পদক্ষেপ নেয়নি নখদন্তহীন দুদক।

বাংলাদেশ সময় : ১৯২৬ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩১, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।