ঢাকা, শুক্রবার, ২৬ পৌষ ১৪৩১, ১০ জানুয়ারি ২০২৫, ০৯ রজব ১৪৪৬

জাতীয়

বাবাকে হত্যা করে মেয়েকে ধর্ষণ করেন ফোরকান

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৩২ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৯, ২০১৫
বাবাকে হত্যা করে মেয়েকে ধর্ষণ করেন ফোরকান ফোরকান মল্লিক

ঢাকা: ফোরকান মল্লিক এবং আলী আকবর হাতেম আলীর মেয়ে আলেয়াকে টেনে-হিঁচড়ে বের করে গানবোটে নিয়ে যায়। আলেয়াকে বাড়ি থেকে বের করার সময় তার বাবা হাতেম আলী বাধা দিলে ফোরকান মল্লিক হাতে থাকা রাইফেল দিয়ে গুলি করেন।

ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়। আলেয়াকে পটুয়াখালী সার্কিট হাউজে নিয়ে ফোরকান মল্লিকসহ অন্যান্য রাজাকাররা ধর্ষণ করে। ধরে নিয়ে যাওয়ার তিনদিন পর মুমূর্ষু অবস্থায় বাড়ির সামনে ফেলে রেখে যান।

একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত পটুয়াখালীর ফোরকান মল্লিকের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে গিয়ে এসব কথা বলেছেন মো. হাবিবুর রহমান বাদশা। তিনি ফোরকান মল্লিকের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের প্রথম সাক্ষী।

সোমবার (১৯ জানুয়ারি) আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এ সাক্ষ্য দেন মো. হাবিবুর রহমান বাদশা। তার মাধ্যমে শুরু হয়েছে ফোরকান মল্লিকের বিরুদ্ধে সাক্ষ্যগ্রহণ। সাক্ষ্যগ্রহণে সহায়তা করেন প্রসিকিউটর মোখলেছুর রহমান বাদল ও সাবিনা ইয়াসমিন মুন্নি।

সাক্ষ্য শেষে সাক্ষীকে জেরা শুরু করেনে ফোরকান মল্লিকের আইনজীবী আব্দুস সালাম খান। জেরা অসমাপ্ত অবস্থায় বুধবার (২১ জানুয়ারি) মুলতবি করেছেন চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে ৩ সদস্যের ট্রাইব্যুনাল।

এর আগে ফোরকান মল্লিকের বিরুদ্ধে সূচনা বক্তব্য (ওপেনিং স্টেটমেন্ট) উপস্থাপন করেন প্রসিকিউটর মোখলেছুর রহমান বাদল।
 
বর্তমানে ৫৯ বছর বয়সী প্রসিকিউশনের প্রথম সাক্ষী মো. হাবিবুর রহমান বাদশা পটুয়াখালীর মীর্জাগঞ্জ উপজেলার কাকড়াবুনিয়া গ্রামের বাসিন্দা।

সাক্ষ্যে তিনি বলেন, ১৯৭১ সালের ২৬ এপ্রিল পাকিস্তানি সেনারা পটুয়াখালীতে ব্যাপক বোমা বর্ষণ করে শহর দখল করে নেয়। এরপর স্থানীয় মুসলীম লীগ নেতা হামিদ খান, আজাহার খান ও মজিবর শিকদারের নেতৃত্বে শান্তি কমিটি এবং ফোরকান মল্লিক, শাহজাহান শিকদার ও আলী আকবর গাজীর নেতৃত্বে রাজাকার বাহিনী গঠন করা হয়। রাজাকাররা সুবিদখালী বাজারের পুরাতন হাসপাতাল ভবনে ক্যাম্প স্থাপন করে।

সাক্ষী বলেন, ১৯৭১ সালের ২২ আগস্ট বেলা দেড়টার দিকে পাকিস্তানি বাহিনী কাকড়াবুনিয়া বাজারে এসে এলোপাতাড়ি গুলি শুরু করে। গুলিতে সনদ কুমার সাহাসহ আরো একজন শহীদ হন। ফোরকান মল্লিক পাকিস্তানি বাহিনীর সহায়তায় বাজারে ব্যাপক লুটতরাজ চালান। মাছ ব্যবসায়ী সুন্দর আলীসহ অন্যদের দিয়ে লুটের মালামাল নদীতে রাখা গানবোটে নিয়ে রাখেন তিনি।

হাবিবুর রহমান বলেন, এরপর ফোরকান মল্লিকের নেতৃত্বে রাজাকার আকবর আলী এবং পাকিস্তানি সেনারা আমাদের গ্রামে এসে আওয়ামী লীগের সমর্থক হাতেম আলীর বাড়িতে ঢোকে।

পরে হাতেম আলীর ভাতিজা সেলিম ও অন্যান্যদের কাছে শুনতে পাই, ফোরকান মল্লিক এবং আলী আকবর হাতেম আলীর মেয়ে আলেয়াকে টেনে-হিঁচড়ে বের করে গানবোটে নিয়ে যান। আলেয়াকে বাড়ি থেকে বের করার সময় তার বাবা হাতেম আলী বাধা দিলে ফোরকান মল্লিক হাতে থাকা রাইফেল দিয়ে গুলি করেন। ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়।

ওই দিন ফোরকান মল্লিক ও তার সঙ্গে আসা রাজাকাররা হিন্দু অধ্যুষিত উত্তর কাকড়াবুনিয়াতে গিয়ে লুটপাট চালায়। পরবর্তীতে আমি জানতে পারি, হাতেম আলীর মেয়ে আলেয়াকে পটুয়াখালী সার্কিট হাউজে নিয়ে গিয়ে ফোরকান মল্লিকসহ অন্যান্য রাজাকাররা ধর্ষণ করেন। ধরে নিয়ে যাওয়ার তিনদিন পর মুমূর্ষু অবস্থায় বাড়ির সামনে ফেলে রেখে যান।

তখন আলেয়ার বয়স ছিল ১৮-২০ বছর। তিনি এখনো বেঁচে আছেন বলেও সাক্ষ্যে উল্লেখ করেন সাক্ষী মো. হাবিবুর রহমান বাদশা। আসামির কাঠগড়ায় থাকা ফোরকান মল্লিককে শনাক্ত করার মাধ্যমে সাক্ষ্য শেষ করেন তিনি।

গত বছরের ১৮ ডিসেম্বর ফোরকান মল্লিকের বিরুদ্ধে হত্যা-গণহত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ, ধর্মান্তরকরণ ও দেশান্তরকরণের ৫টি মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযোগ (চার্জ) গঠন করা হয়। এর মধ্যে রয়েছে ৮ জনকে হত্যা ও গণহত্যা, ৪ জনকে ধর্ষণ, ৩ জনকে ধর্মান্তরকরণ, ১৩টি পরিবারকে দেশান্তরকরণ, ৬৪টি বসতঘর ও দোকানপাটে লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগের অভিযোগ।

এর আগে গত বছরের ৯ ডিসেম্বর ফোরকান মল্লিকের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের পক্ষে শুনানি করেন প্রসিকিউটর মোখলেসুর রহমান বাদল। বিপক্ষে শুনানি করেন ফোরকান মল্লিকের আইনজীবী আব্দুস সালাম খান।

গত বছরের ২ ডিসেম্বর ফোরকান মল্লিকের বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের দাখিল করা আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) আমলে নেন ট্রাইব্যুনাল। ১৭ নভেম্বর এ আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করেন প্রসিকিউটর মোখলেসুর রহমান বাদল। পরে তিনি অভিযোগ আমলে নেওয়ার পক্ষে শুনানি করেন।

গত বছরের ২৭ অক্টোবর ফোরকান মল্লিকের বিরুদ্ধে তদন্তের চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করেন তদন্ত সংস্থা। ২৮ অক্টোবর এ প্রতিবেদন প্রসিকিউশনের কাছে জমা দেওয়া হয়।

গত বছরের ২৬ জুন শুরু করে ২৭ অক্টোবর পর্যন্ত মামলাটির তদন্ত করেন তদন্ত কর্মকর্তা সত্যরঞ্জন রায়।

ফোরকানের বাড়ি পটুয়াখালী জেলার মির্জাগঞ্জ উপজেলার ছইলাবুনিয়া গ্রামে। দীর্ঘদিন পলাতক থাকার পর গোপন সংবাদের ভিত্তিতে গত বছরের ২৫ জুন সকালে পটুয়াখালী গোয়েন্দা শাখার একটি দল বরিশালের রুপাতলী বাসস্ট্যান্ড এলাকা থেকে ফোরকান মল্লিককে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় হত্যা, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগের দায়ে ২০০৯ সালের ২১ জুলাই ফোরকানের বিরুদ্ধে মির্জাগঞ্জ থানায় আবদুল হামিদ নামে এক ব্যক্তি মামলা দায়ের করেন।

২০১০ সালের ফেব্রুয়ারিতে ফোরকান মল্লিকের বিরুদ্ধে পটুয়াখালীর আদালতে বিচারিক প্রক্রিয়া শুরু হয়। এ সময় তিনি উচ্চ আদালত থেকে ছয় মাসের জামিন নেন। গত বছরের ৩০ মার্চ বিচারিক কার্যক্রম চলাকালে আদালতে হাজির না হওয়ায় তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়।

ফোরকান মল্লিকের বিরুদ্ধে বিচারিক প্রক্রিয়া চলাকালে তার বিরুদ্ধে হত্যা, লুণ্ঠন, খুন, ধর্ষণসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের প্রমাণ পান পটুয়াখালীর আদালত। তখন মামলাটি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হয়।

ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রার একেএম নাসির উদ্দিন মাহমুদ মামলাটি গত বছরের ২৫ জুন তদন্ত সংস্থার কাছে পাঠান। তদন্ত সংস্থা মামলাটি গ্রহণ করে ২৬ জুন থেকে তদন্ত শুরু করেন তদন্তকারী কর্মকর্তা সত্যরঞ্জন রায়।
 
গত বছরের ৩০ জুন ফোরকান মল্লিককে মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলায় গ্রেফতার দেখানো (শ্যোন অ্যারেস্ট) ও তদন্তের স্বার্থে ট্রাইব্যুনালে হাজির করানোর আবেদন জানান প্রসিকিউটর প্রসিকিউটর মোখলেসুর রহমান বাদল। শুনানি শেষে ফোরকান মল্লিককে ৩ জুলাই ট্রাইব্যুনালে হাজির করানোর জন্য কারা মহাপরিদর্শককে আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল-২।

৩ জুলাই ফোরকান মল্লিককে হাজির করা হয়ে গ্রেফতার দেখিয়ে (শ্যোন অ্যারেস্ট) কারাগারে পাঠান ট্রাইব্যুনাল।

বাংলাদেশ সময়: ১৬৩২ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৯, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।