ঢাকা, শুক্রবার, ২৬ পৌষ ১৪৩১, ১০ জানুয়ারি ২০২৫, ০৯ রজব ১৪৪৬

জাতীয়

নিজ হাতে দাদাকে হত্যা করেন হাসান আলী

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০৪৭ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৯, ২০১৫
নিজ হাতে দাদাকে হত্যা করেন হাসান আলী

ঢাকা: আমার দাদা কামিনী ঘোষ ও জীবন ঠাকুরকে হাসান দারোগা নিজ হাতে পেছন থেকে গুলি করে হত্যা করেন। এরপর হাসান দারোগা বাঁশিতে ফুঁ দিলে সকল রাজাকাররা একত্রিত হয়।

যাদেরকে হত্যা করা হয়েছে তাদেরকে পোড়ানো যাবে না, বাকি সকলকে মুসলমান হতে হওয়ার নির্দেশ দেন হাসান দারোগা।   ওই দিন বিকাল আনুমানিক ৪/৫টার দিকে হাসান দারোগা লুণ্ঠন করা মালামালসহ সেখান থেকে চলে যান। আমি ঘটনাস্থলে থেকেই এসব ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছি।

একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত কিশোরগঞ্জের তাড়াইল থানার রাজাকার কমান্ডার (ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাসিন্দা) পলাতক সৈয়দ মো. হাসান আলী ওরফে হাছেন আলীর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দানকালে এসব কথা বলেছেন সঞ্জিব কুমার সরকার।   তিনি হাসান আলীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের দশম সাক্ষী।

সোমবার (১৯ জানুয়ারি) আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ সাক্ষ্য দেন সঞ্জিব কুমার সরকার। সাক্ষ্যগ্রহণে সহায়তা করেন প্রসিকিউটর আবুল কালাম। সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে তাকে জেরা করেন হাসান আলীর পক্ষে রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবী আব্দুস শুকুর খান। বুধবার (২১ জানুয়ারি) পর্যন্ত হাসান আলীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের ১১তম সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণের দিন ধার্য করেছেন চেয়ারম্যান বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল।

বর্তমানে ৫৭ বছর বয়সী সাক্ষী সঞ্জিব কুমার সরকার কিশোরগঞ্জের তাড়াইল উপজেলার আড়াইউড়া গ্রামের বাসিন্দা। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিনি অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র ছিলেন।

সাক্ষী বলেন, ১৯৭১ সালের ৮ অক্টোবর দুপুর ১২টার দিকে ১৫ থেকে ২০ জন রাজাকার আমাদের বাড়িতে আক্রমণ করে। তাদের মধ্যে একজন বলেন, ‘সকলে সাবধান, আমি হাসান আলী দারোগা, তাড়াইল থানা রাজাকার কমান্ডার, কেউ পালানোর চেষ্টা করলে গুলি করা হবে’। ওই লোকটির পরনে ছিল খাকি পোশাক, মাথায় সাদা টুপি ও মুখে হালকা দাড়ি।

এ সময় রাজাকাররা হাসান দারোগার নির্দেশে আমাদের বাড়ি-ঘর লুটপাট করে। এরপর আমার দাদা কামিনী ঘোষকে ঘর থেকে ধরে এনে পিঠমোড়া করে বেধে উঠানো নিয়ে এসে তার ওপর নির্যাতন করে। হাসান দারোগার নির্দেশে রাজাকাররা আমাদের ঘরে বিভিন্ন দেব-দেবীর ছবি খুলে এনে উঠানে ফেলে তা পা দিয়ে পাড়াতে থাকে এবং আমার দাদাকে ওই ছবিগুলোর ওপর পস্রাব করতে বলে।

সাক্ষী সঞ্জিব কুমার বলেন,  এরপর হাসান দারোগা ৫ জন রাজাকারকে আমাদের পাশের গ্রামের জীবন ঠাকুরকে ধরে আনার জন্য পাঠান। আনুমানিক আধ ঘণ্টা পরে তারা জীবন ঠাকুরকে ধরে আমাদের বাড়ির উঠানে নিয়ে আসে। জীবন ঠাকুর হাসান দারোগার কাছে প্রাণভিক্ষা চান।

এরপর আমার দাদা কামিনী ঘোষ ও জীবন ঠাকুরকে হাসান দারোগা নিজ হাতে পেছন থেকে গুলি করে হত্যা করেন। এরপর হাসান দারোগা বাঁশিতে ফুঁ দিলে সকল রাজাকাররা একত্রিত হয়। যাদেরকে হত্যা করা হয়েছে তাদেরকে পোড়ানো যাবে না, বাকি সকলকে মুসলমান হতে হওয়ার নির্দেশ দেন হাসান দারোগা।   ওই দিন বিকাল আনুমানিক ৪/৫টার দিকে হাসান দারোগা লুণ্ঠন করা মালামালসহ সেখান থেকে চলে যান। আমি ঘটনাস্থলে থেকেই এসব ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছি।

এরপর ঘটনাস্থলে জীবন ঠাকুরের স্ত্রীসহ পরিবারের অন্যান্যরা এসে বলেন, তাদের বাড়িও লুট করা হয়েছে।

জীবন ঠাকুরের মরদেহ তার আত্মীয়-স্বজনরা নিজ বাড়িতে নিয়ে গিয়ে মাটি চাপা দেন। অন্যদিকে সাক্ষীর দাদা কামিনী রায়কে মুসলমানের সহায়তায় মাটি চাপা দেয়া হয় বলে তিনি উল্লেখ করে তার জবানবন্দি শেষ করেন।

গত বছরের ৮ ডিসেম্বর শুরুর পর থেকে হাসান আলীর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছেন রাষ্ট্রপক্ষের আরও নয়জন সাক্ষী। তারা হচ্ছেন, শহীদপুত্র রেনু চন্দ্র পাল, শহীদপুত্র সমেন্দ্র চন্দ্র পাল, শহীদপুত্র সুনীল চন্দ্র পাল, শহীদপুত্র খগেশ চন্দ্র পাল।
 
গত বছরের ৭ ডিসেম্বর হাসান আলীর বিরুদ্ধে সূচনা বক্তব্য উপস্থাপন করেন প্রসিকিউটর মোহাম্মদ আলী।

গত বছরের ১১ নভেম্বর হাসান আলীর বিরুদ্ধে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় হত্যা, গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ, লুট, আটক ও নির্যাতনের ৬টি মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযোগ গঠন করেন ট্রাইব্যুনাল। এতে ২৪ জনকে হত্যা, ১২ জনকে অপহরণ ও আটক এবং ১২৫টি ঘরে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের অভিযোগ রয়েছে।

গত বছরের ২২ অক্টোবর ও ২২ সেপ্টেম্বর অভিযোগ গঠনের পক্ষে রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন প্রসিকিউটর মোহাম্মদ আলী ও প্রসিকিউটর আবুল কালাম আজাদ। অন্যদিকে ২২ সেপ্টেম্বর অভিযোগ গঠনের বিপক্ষে শুনানি করেন হাসান আলীর পক্ষে রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবী আব্দুস শুকুর খান।

গত বছরের ১৫ সেপ্টেম্বর সৈয়দ মোঃ হাসান আলীর অনুপস্থিতিতে মামলার বিচারিক কার্যক্রম শুরুর নির্দেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। একই সঙ্গে তার পক্ষে কোনো আইনজীবী না থাকায় আব্দুস শুকুর খানকে রাষ্ট্রীয় খরচে আসামিপক্ষের আইনজীবী নিয়োগ দেওয়া হয়।

গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির আগে থেকেই পালিয়ে থাকা হাসান আলীর বিরুদ্ধে গত বছরের ২৪ আগস্ট আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) আমলে নেন ট্রাইব্যুনাল। ওই দিনই পলাতক এই রাজাকার কমান্ডারকে হাজির হওয়ার নির্দেশ দিয়ে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেওয়ার আদেশ দেওয়া হয়। পরে তাকে হাজির হতে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেন প্রসিকিউশন।

গত বছরের ২১ আগস্ট ট্রাইব্যুনালে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) দাখিল করেন প্রসিকিউটর আবুল কালাম আজাদ।

গত বছরের ২৯ জুন সৈয়দ মোঃ হাসান আলীর বিরুদ্ধে ৪৭ পৃষ্ঠার তদন্তের চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রসিকিউশনের কাছে হস্তান্তর করেন তদন্ত সংস্থা।

হাসান আলীর বিরুদ্ধে গত বছরের ৩ এপ্রিল ট্রাইব্যুনাল-১ গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করার পর গত সাড়ে ৯ মাসেও তাকে গ্রেফতার করা যায়নি।

২০১৩ সালের ৬ জুন থেকে তার বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেন তদন্ত সংস্থা। গত বছরের ১৯ জুন পর্যন্ত তদন্ত কার্যক্রম শেষে তদন্ত প্রতিবেদন চূড়ান্ত করেন তদন্তকারী কর্মকর্তা হরি দেবনাথ।

একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় কিশোরগঞ্জের তাড়াইল থানার রাজাকার কমান্ডার ছিলেন হাসান আলী। সে সময় তিনি তাড়াইল থানা এলাকায় ‘রাজাকারের দারোগা’ নামে পরিচিত ছিলেন। তবে মুক্তিযুদ্ধের পর তিনি কিশোরগঞ্জের তাড়াইলে না থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মাছিহাতা গ্রামে বসবাস করতেন।

মুক্তিযুদ্ধের সময় ত্রাস ছিলেন রাজাকার হাসান আলী। হাসান আলী অন্যান্য সহযোগীসহ তাড়াইল থানার বিভিন্ন এলাকাসহ কিশোরগঞ্জে নির্যাতন, হত্যা, গণহত্যা, বাড়িঘর লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ, জোর করে টাকা আদায় ও ধর্মান্তরিতকরণসহ যাবতীয় মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটন করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় হিন্দু ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের বাড়িঘর লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন তিনি। তার নির্দেশেই তাড়াইলে হত্যাকাণ্ডগুলো সংঘটিত হয়েছে।

রাজাকার কমান্ডার হিসেবে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকেও মানবতাবিরোধী অপরাধ কর্মকাণ্ডে সকল প্রকার সাহায্য-সহযোগিতা করতেন তিনি।

সৈয়দ হাসান আলীর পিতা সৈয়দ মোসলেম উদ্দিন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টির ভাইস চেয়ারম্যান এবং কিশোরগঞ্জ মহকুমা শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন। তার অন্য এক ভাইও রাজাকার ছিলেন।

বাংলাদেশ সময়: ২০৪৭ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৯, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।