ভোলার উপকূলবর্তী মৎস্যঘাট ঘুরে এসে: সবে সকাল ৭টা। নদীতীরে সূর্য উঠি উঠি করছে।
কিন্তু আড়তদার ও জেলেদের চরম ব্যস্ততার কাছে শীতের কোনো পাত্তাই নেই। নদী থেকে ছোট-বড় ট্রলারে করে আসছে ইলিশ। চটজলদি দক্ষ হাতে এসব মাছ নামিয়ে আড়তে স্তুপ করে রাখছেন কিছু লোক। এরপর চলছে স্তুপকৃত মাছের প্যাকেট ও বরফজাতকরণ প্রক্রিয়া।
অন্যসময়ে এ কাজে যে ক্ষিপ্রতা ও উৎসাহ দেখা যায়, এবার তার দেখা মিললো না। না আড়তদার, না জেলে, না শ্রমিক কারো মুখে।
টানা অবরোধে অব্যাহত লোকসান গুণতে হচ্ছে ভোলার মাছ ব্যবসায়ী ও আড়তদারদের। ফলে একরকম ধস দেখা দিয়েছে ইলিশের ব্যবসায়।
সকালে মাছঘাট ঘুরে জানা গেল, প্যাকেট ও বরফজাত মাছ বিক্রির উদ্দেশে নিয়ে যাওয়া হবে জেলার বাইরে। তাই সাত-সকালে এতো ব্যস্ততা। কিন্তু শঙ্কাও কম নয়। পথে বাধা হরতাল আর অবরোধ। পথের নানা প্রতিকূলতা পেরিয়ে মোকামে নিয়ে গেলেও সেখানে মিলছে না পাইকারদের খোঁজ। আবার পাইকার পেলেও মিলছে না কাঙ্ক্ষিত দাম। বাধ্য হয়েই তাই কম মূল্যে বিক্রি করে ফিরতে হচ্ছে ইলিশ ব্যবসায়ী ও আড়তদারদের।
গত ১৩ দিন ধরে এভাবেই চরম দুর্ভোগ ও লোকসান বয়ে বেড়াতে হচ্ছে সদর উপজেলার বৃহৎ মাছের আড়ত বিশ্বরোড এলাকার মাছঘাটের ব্যবসায়ীদের।
একাধিক ব্যবসায়ী জানান, অবরোধের প্রভাবে ইলিশসহ সব মাছের দাম নেমে এসেছে। ফলে প্রতিদিন গড়ে একেকজন ব্যবসায়ীকে ১৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত লোকসান গুণতে হচ্ছে। এতে ধস নামতে শুরু করেছে তাদের ব্যবসায়।
চলমান টানা অবরোধে ইলিশের ব্যবসায় ধস নামার এ একই চিত্র ভোলার বিভিন্ন মাছঘাটে। নদী থেকে আহরণকৃত ইলিশ জেলার বাইরে বিক্রি করতে হচ্ছে অনেকটা কম মূল্যে। অনেক আড়তদার ও পাইকার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে নিজ জেলার বিভিন্ন বাজারেও এসব ইলিশ বিক্রি করে খরচ তুলতে পারছেন না।
একই অবস্থা জেলেদের। সারাদিন নদীতে জাল বেয়েও ন্যায্য দাম না পাওয়ায় চরম সংকটের মধ্যে দিনানিপাত করছেন তারা।
চলমান রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে ইলিশের ব্যবসা ও বিক্রি গত মাসের তুলনায় এবারে অর্ধেকে নেমে আসবে বলে আশঙ্কা খোদ জেলার মৎস্য কর্মকর্তাদের।
বিভিন্ন ঘাট ঘুরে জানা গেলো, ভোলার নদীর উপকূলবর্তী এলাকার বেশিরভাগ মানুষই মৎস্য পেশার সঙ্গে যুক্ত। অপেক্ষাকৃত দাম বেশি পাওয়ায় মেঘনায় আহরণকৃত ইলিশ বিভিন্ন ঘাট ঘুরে আড়তদাররাদের মাধ্যমে ঢাকার কারওয়ান বাজার, যাত্রাবাড়ী, সোয়ারিঘাট, কাঠপট্টি, রামপুরাসহ বড় বড় পাইকারি বাজারে যায়।
কিন্তু গত ১৩ দিনের টানা হরতাল আর অবরোধের কারণে জেলার বাইরে মাছ বিক্রি করতে গিয়ে নানা রকম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে জেলার মাছ ব্যবসায়ীদের।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, অবরোধের প্রভাবে পরিবহন ভাড়া বেশি হলেও লাভের আশায় ইলিশ বিক্রি করতে গিয়ে কম মূল্যেই পাইকারি বাজারে বিক্রিতে বাধ্য হচ্ছেন আড়তদাররা।
ইলিশা বিশ্ব রোড এলাকার মাছ ব্যবসায়ী কামাল হোসেন জানান, গত ১৩ দিনের অবরোধে এ পর্যন্ত দেড় লাখ টাকা লোকসান গুণতে হয়েছে তাকে।
আড়তদার মো. ইমন বলেন, এ পর্যন্ত তার লোকসান দুই লাখ টাকার বেশি। এভাবে চলতে থাকলে ব্যবসা ছেড়ে দিতে হবে।
অপর ব্যবসায়ী আক্তারুজ্জামান বলেন, ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অনেকেই জেলার বাইরে মাছ বিক্রি করতে যান। কিন্তু পথের নানা ভোগান্তি সত্ত্বেও পাইকারি বাজারে তেমন দাম পাচ্ছেন না তারা।
বিশ্বরোড মৎস্য আড়তদার সমিতির সভাপতি তাহের ভুলাই বলেন, এ ঘাটে দুই ডজন আড়তদার রয়েছেন। প্রতিদিন এ ঘাট থেকে ২০/২৫ ঝুড়ির অধিক ইলিশ ঢাকার বিভিন্ন বাজারে যায়। গত অবরোধে এ বিক্রি কমে গেছে। যারা যাচ্ছেন, তারাও কম দামে বিক্রি করছেন।
চড়ার মাথা ঘাটের ঘাটের জেলে আ. হাই বলেন, সারাদিন জাল বেয়ে যে মাছ পাই, তা বিক্রি করে কিছুই হয়না। কারণ আড়তদাররা বেশি দামে মাছ নিতে চায় না।
চড়ার মাথা ঘাটের আড়তদার সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. সাহাবুদ্দিন বলেন, অবরোধের আগেও হালি প্রতি ইলিশের দাম ছিল তিন হাজার থেকে ৩২শ টাকা, কিন্তু এখন ওই মাছ বিক্রি হচ্ছে মাত্র দুই হাজার থেকে ২২শ টাকা দরে।
অন্যদিকে, মণপ্রতি ৩৫ থেকে ৪০ হাজার টাকা দরে আগে ইলিশ বিক্রি হলেও অবরোধে প্রভাবে দাম কমে দাঁড়িয়েছে ১৮ থেকে ২০ হাজার টাকায়।
ভোলার বড় বড় আড়তের মধ্যে ভোলার খাল, তুলাতলী, কুকরী-মুকরী, ঢালচরের বিভিন্ন আড়তদার জানান, ইলিশের বিক্রি কমে যাওয়ায় গত ১৩ দিনে তাদের তিন কোটি টাকার ওপরে লোকসান হয়েছে।
এতে একদিকে যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আড়তদাররা, অন্যদিকে সারাদিন জাল বেয়ে সেই মাছ বিক্রি করে দাম না পাওয়ায় পরিবার-পরিজন নিয়ে কষ্টে আছেন জেলেরা।
তাদের দাবি, হরতাল অবরোধে কবল থেকে দ্রুত মুক্তি পাওয়া। আর এতেই সঙ্কট কাটিয়ে উঠতে পারবেন বলে তাদের আশা।
জেলা মৎস্য অফিস সূত্র জানায়, ডিসেম্বর মাসে জেলার বিভিন্ন আড়ত থেকে মেঘনায় আহরণকৃত পাঁচ কোটি ২৫ হাজার মেট্রিক টন ইলিশ আহরণ হয়েছে। এর বাজার মূল্য প্রায় ২২১ কোটি টাকা। এসব ইলিশের ৯০ শতাংশই জেলার বাইরে বিক্রি হয়েছে।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা প্রীতিষ কুমার মল্লিক বলেন, গত মাসের তুলনায় এ মাসে মাছের বিক্রি অনেকটা কমে গেছে। এতে এ পেশার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের আয় অর্ধেকে নেমে আসতে পারে। এতে জেলে ও মৎস্যজীবীরা চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন বলেও আশঙ্কা তাদের।
বাংলাদেশ সময়: ০২২৭ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২০, ২০১৫