ঢাকা: আমার বাড়ির পাশ্ববর্তী আব্দুর রশিদের বাড়িতে রাজাকাররা আগুন দিলে আব্দুর রশিদ ঘর থেকে বের হয়ে দৌঁড়ে পালাবার চেষ্টা করলে হাসান আলী তার পেছনে ধাওয়া করেন। এক পর্যায়ে হাসান আলী পেছন থেকে গুলি করে আব্দুর রশিদকে হত্যা করেন।
একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত কিশোরগঞ্জের তাড়াইল থানার রাজাকার কমান্ডার (ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাসিন্দা) পলাতক সৈয়দ মো. হাসান আলী ওরফে হাছেন আলীর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দানকালে এসব কথা বলেছেন মো. আতাহার আলী ভূঁইয়া। তিনি হাসান আলীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের ১২তম সাক্ষী।
সোমবার (২ ফেব্রুয়ারি) আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ সাক্ষ্য দেন মো. আতাহার আলী ভূঁইয়া। সাক্ষ্যগ্রহণে সহায়তা করেন প্রসিকিউটর মোহাম্মাদ আলী। সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে তাকে জেরা করেন হাসান আলীর পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী আব্দুস শুকুর খান। মঙ্গলবার (৩ ফেব্রুয়ারি) হাসান আলীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের ১৩তম সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণের দিন ধার্য করেছেন চেয়ারম্যান বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল।
বর্তমানে ৫৭ বছর বয়সী সাক্ষী আতাহার আলী ভূঁইয়া কিশোরগঞ্জের তাড়াইল উপজেলার পশ্চিম সাতাইল (বালিগাতি) গ্রামের বাসিন্দা। ১৯৭১ সালে তার বয়স ছিল ১৪/১৫ বছর। তখন তিনি কৃষিকাজ করতেন। বর্তমানে তিনি মুদি দোকানি।
সাক্ষ্যে আতাহার আলী বলেন, ১৯৭১ সালের ১১ ডিসেম্বর বেলা সাড়ে তিনটার দিকে রাজাকার হাসান আলী পাকিস্তানি সেনাসহ ৪০/৫০ জন রাজাকার নিয়ে বালিগাতি গ্রামে আক্রমণ চালান। এদিন সাক্ষীর নিজের বাড়িসহ পাড়ার ৬৪টি বাড়ি পুড়িয়ে দেয় রাজাকাররা।
সাক্ষী বলেন, আমার বাড়ির পাশ্ববর্তী আব্দুর রশিদের বাড়িতে রাজাকাররা আগুন দিলে আব্দুর রশিদ ঘর থেকে বের হয়ে দৌঁড়ে পালাবার চেষ্টা করলে হাসান আলী তার পেছনে ধাওয়া করেন। এক পর্যায়ে হাসান আলী পেছন থেকে গুলি করে আব্দুর রশিদকে হত্যা করেন।
বাড়ির পাশে ঝোঁপের আড়াল থেকে এ হত্যাকাণ্ড দেখতে পান বলে সাক্ষ্যে উল্লেখ করেন সাক্ষী আতাহার আলী।
সাক্ষ্যে আতাহার আলী আরো বলেন, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর এক মাস পর পাকিস্তানি সেনারা তাড়াইল হাইস্কুলে ক্যাম্প স্থাপন করে। এর কিছুদিন পর রাজাকার কমান্ডার হাসান আলী তাড়াইলের বিভিন্ন এলাকার বাড়ি-ঘর লুটপাট এবং নিরীহ মানুষের ওপর নির্যাতন শুরু করেন।
হাসান আলী অধিকাংশ সময়ই তাড়াইল থানায় অবস্থান করতেন। এ সমস্ত লুটপাট ও মানুষের ওপর নির্যাতনের ঘটনা রাজাহার কমান্ডার হাসান আলীর নির্দেশেই হতো বলেও সাক্ষ্যে বলেন আতাহার আলী।
সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে সাক্ষি আতাহার আলী ভুঁইয়াকে জেরা করেন রাষ্ট্র নিযুক্ত আসামী পক্ষের আইনজীবী আব্দুশ শুকুর খান। জেরা শেষ হলে পরবর্তী সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য ট্রাইব্যুনাল আগামীকাল দিন ধার্য করেন।
গত বছরের ৮ ডিসেম্বর শুরুর পর থেকে হাসান আলীর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছেন রাষ্ট্রপক্ষের আরও দশজন সাক্ষী। তারা হচ্ছেন, শহীদপুত্র রেনু চন্দ্র পাল, শহীদপুত্র সমেন্দ্র চন্দ্র পাল, শহীদপুত্র সুনীল চন্দ্র পাল, শহীদপুত্র খগেশ চন্দ্র পাল, নূরুল হক লাল মিয়া, রাহিমা ওরফে আবুনি, মোঃ এমদাদ হোসেন ভূঁইয়া, মোঃ শাহজাহান ভূঁইয়া, রেখা রানী ঘোষ, সঞ্জিব কুমার সরকার এবং বাঁধন চক্রবর্তী।
গত বছরের ৭ ডিসেম্বর হাসান আলীর বিরুদ্ধে সূচনা বক্তব্য উপস্থাপন করেন প্রসিকিউটর মোহাম্মদ আলী।
গত বছরের ১১ নভেম্বর হাসান আলীর বিরুদ্ধে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় হত্যা, গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ, লুট, আটক ও নির্যাতনের ৬টি মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযোগ গঠন করেন ট্রাইব্যুনাল। এতে ২৪ জনকে হত্যা, ১২ জনকে অপহরণ ও আটক এবং ১২৫টি ঘরে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের অভিযোগ রয়েছে।
গত বছরের ২২ অক্টোবর ও ২২ সেপ্টেম্বর অভিযোগ গঠনের পক্ষে রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন প্রসিকিউটর মোহাম্মদ আলী ও প্রসিকিউটর আবুল কালাম আজাদ। অন্যদিকে ২২ সেপ্টেম্বর অভিযোগ গঠনের বিপক্ষে শুনানি করেন হাসান আলীর পক্ষে রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবী আব্দুস শুকুর খান।
গত বছরের ১৫ সেপ্টেম্বর সৈয়দ মোঃ হাসান আলীর অনুপস্থিতিতে মামলার বিচারিক কার্যক্রম শুরুর নির্দেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। একই সঙ্গে তার পক্ষে কোনো আইনজীবী না থাকায় আব্দুস শুকুর খানকে রাষ্ট্রীয় খরচে আসামিপক্ষের আইনজীবী নিয়োগ দেওয়া হয়।
গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির আগে থেকেই পালিয়ে থাকা হাসান আলীর বিরুদ্ধে গত বছরের ২৪ আগস্ট আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) আমলে নেন ট্রাইব্যুনাল। ওই দিনই পলাতক এই রাজাকার কমান্ডারকে হাজির হওয়ার নির্দেশ দিয়ে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেওয়ার আদেশ দেওয়া হয়। পরে তাকে হাজির হতে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেন প্রসিকিউশন।
গত বছরের ২১ আগস্ট ট্রাইব্যুনালে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) দাখিল করেন প্রসিকিউটর আবুল কালাম আজাদ।
গত বছরের ২৯ জুন সৈয়দ মোঃ হাসান আলীর বিরুদ্ধে ৪৭ পৃষ্ঠার তদন্তের চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রসিকিউশনের কাছে হস্তান্তর করেন তদন্ত সংস্থা।
হাসান আলীর বিরুদ্ধে গত বছরের ৩ এপ্রিল ট্রাইব্যুনাল-১ গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করার পর গত সাড়ে ৯ মাসেও তাকে গ্রেফতার করা যায়নি।
২০১৩ সালের ৬ জুন থেকে তার বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেন তদন্ত সংস্থা। গত বছরের ১৯ জুন পর্যন্ত তদন্ত কার্যক্রম শেষে তদন্ত প্রতিবেদন চূড়ান্ত করেন তদন্তকারী কর্মকর্তা হরি দেবনাথ।
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় কিশোরগঞ্জের তাড়াইল থানার রাজাকার কমান্ডার ছিলেন হাসান আলী। সে সময় তিনি তাড়াইল থানা এলাকায় ‘রাজাকারের দারোগা’ নামে পরিচিত ছিলেন। তবে মুক্তিযুদ্ধের পর তিনি কিশোরগঞ্জের তাড়াইলে না থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মাছিহাতা গ্রামে বসবাস করতেন।
মুক্তিযুদ্ধের সময় ত্রাস ছিলেন রাজাকার হাসান আলী। হাসান আলী অন্যান্য সহযোগীসহ তাড়াইল থানার বিভিন্ন এলাকাসহ কিশোরগঞ্জে নির্যাতন, হত্যা, গণহত্যা, বাড়িঘর লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ, জোর করে টাকা আদায় ও ধর্মান্তরিতকরণসহ যাবতীয় মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটন করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় হিন্দু ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের বাড়িঘর লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন তিনি। তার নির্দেশেই তাড়াইলে হত্যাকাণ্ডগুলো সংঘটিত হয়েছে।
রাজাকার কমান্ডার হিসেবে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকেও মানবতাবিরোধী অপরাধ কর্মকাণ্ডে সকল প্রকার সাহায্য-সহযোগিতা করতেন তিনি।
সৈয়দ হাসান আলীর পিতা সৈয়দ মোসলেম উদ্দিন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টির ভাইস চেয়ারম্যান এবং কিশোরগঞ্জ মহকুমা শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন। তার অন্য এক ভাইও রাজাকার ছিলেন।
বাংলাদেশ সময়: ১৮২৩ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০২, ২০১৫